মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সামরিক অভিযান বন্ধের পর বেশ কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে সেখানে ফিরে গেছেন৷ অনেকেই বলেছেন, স্ত্রী, সন্তান অথবা বাবা-মায়ের খোঁজে অথবা ফেলে আসা সম্পদ রক্ষা করতেই ফিরেছেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
কক্সবাজারের কুতুপালাং অরিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান আবু সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘নির্যাতনের মুখে অনেকে তাঁদের বৃদ্ধ বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনকে ফেলে রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন৷ এঁদেরই কেউ কেউ এখন আবার বাবা-মা ও স্বজনরা কেমন আছেন – তা দেখতে সময় বুঝে মিয়ানমারে ফিরে যাচ্ছেন৷ সুযোগ পেলেই তাঁরা বাবা-মাকে নিয়ে কক্সবাজারে ফিরে আসবেন৷ দু-একজন ইতিমধ্যে এসেছেন বলেও শুনেছি৷''
ভুলে যাওয়া শরণার্থীরা: বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা
গত অক্টোবরে মিয়ানমারে দমনপীড়ন শুরুর পর ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন৷ মুসলিমপ্রধান দেশটিতে বর্তমানে পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছেন৷ কুতুপালংয়ের মতো জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে তাদের অনেকের বাস৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
মিয়ানমার থেকে পালানো
মিয়ানমারে গত অক্টোবরে নয় পুলিশ হত্যার অভিযোগ ওঠে এক রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে৷ তারপর থেকে সেদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর আবারো দমনপীড়ন শুরু হয়৷ ফলে সত্তর হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷ তারা যেসব ক্যাম্পে বসবাস করেন সেগুলোর একটি এই কুতুপালং৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
স্বনির্ভরতা দরকার
কুতুপালং ক্যাম্পের শরণার্থীরা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে নিরাপদ আছে বটে, তবে জীবন সেখানে মোটেই সহজ নয়৷ সেখানে সত্যিকারের কোনো অবকাঠামো নেই, সবই শরণার্থীদের গড়া অস্থায়ী আবাস৷ তারা নিজেদের দেশ ছেড়ে এসেছেন, কেননা, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং অসংখ্য মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ করেছে৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
শিশুদের খেলা নয়
আশ্রয়শিবিরটির অধিকাংশ এলাকায় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই৷ কয়েক হাজার শরণার্থী শিশুর খেলোধুলারও কোন ব্যবস্থা নেই৷ ক্যাম্পের লেক থেকে মাটি সংগ্রহ করছে এই শিশুটি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
কুঁড়েঘরে বসবাস
কাদা মাটি এবং সহজলভ্য অন্যান্য উপাদান দিয়ে ঘর তৈরি করে বাস করেন শরণার্থীরা, যাতে মাথার উপরে অন্তত ছাদ থাকে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস
সেই ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সেদেশে রোহিঙ্গারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ তাদেরকে নাগরিকত্ব এবং ভোট দেয়ার অধিকার দিচ্ছে না সরকার৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
বাংলাদেশেও বৈষম্যের শিকার?
বাংলাদেশেও বৈষম্যে শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা৷ ক্যাম্পে আর জায়গা নেই- বলে বাংলাদেশে জলপথে আশ্রয় নিতে আসা অসংখ্য রোহিঙ্গাকে তাদের নৌকাসহ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে সীমান্তরক্ষীরা৷ পাশাপাশি কক্সবাজার ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একটি দুর্গম দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার৷ স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, দ্বীপটি বর্ষাকালে অধিকাংশ সময় পানির নীচে তলিয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
নির্জন দ্বীপে সরিয়ে নেয়া
ঠ্যাঙ্গার চর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর মোহনায় কয়েকবছর আগে জেগে ওঠা এক দ্বীপ৷ শুধুমাত্র নৌকায় করে সেখানে যাওয়া যায় এবং চরটিতে অতীতে একাধিকবার জলদস্যু হানা দিয়েছে৷ এক উন্নয়নকর্মী সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন যে দ্বীপটিতে কর্মসংস্থানেরও তেমন কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী স্বীকার করেছেন যে, ঠ্যাঙ্গার চরকে বসবাসের উপযোগী করতে আরো অনেক কাজ করতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘দ্বীপটিতে উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করার পর রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেয়া হবে৷’’ তবে সরকার অতীতে এরকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি৷ কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের তেমন কোন উন্নয়ন সাধন করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
ইতিহাস থেকে মোছার চেষ্টা
নিরাপদ আবাসভূমি না থাকায় রোহিঙ্গাদে ভবিষ্যত ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে৷ অন্যদিকে, মিয়ানমার তাদের অতীত মুছে ফেলতে কাজ করছে৷ দেশটির সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিহাস বিষয়ক পাঠ্যবই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে যেখানে রোহিঙ্গাদের কথা একেবারেই উল্লেখ থাকবে না৷ গত ডিসেম্বরে মন্ত্রণালয়টি দাবি করেছে, মিয়ানমারের ইতিহাসে কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে কখনো রোহিঙ্গা নামে আখ্যায়িত করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
9 ছবি1 | 9
তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা গেছেন তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে৷ তাঁরা জানিয়েছেন যে, সেখানকার পরিস্থিতি এখনো ভালো না৷ সামরিক অভিযান বন্ধের কথা বলা হলেও বন্ধ হয়নি৷ এমনকি কয়েকদিন আগেও চারজন নিহত হয়েছে বলে আমরা খবর পেয়েছি৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘আমার জানা মতে যাঁরা মিয়ানমারে গেছেন, তাঁরা সিঙ্গেল৷ কোনো পরিবার ফিরে যায়নি৷ তাছাড়া সংখ্যায় তাঁরা চার/পাঁচশ'র বেশি হবে না৷''
আবু সিদ্দিক
অন্যদিকে লেদা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান দুদু মিয়া একই ধরনের কথা বলেন ডয়চে ভেলেকে৷ তবে তিনি বলেন, ‘‘মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা এক হাজারের মতো হতে পারে৷''
তিনি বলেন, ‘‘অনেকে ভয়ে পালিয়ে এসেছিলেন৷ তাঁদের ওপর তখনো আক্রমণ হয়নি৷ তাঁদের কেউ কেউ ফিরে গেছেন ফেলে আসা বাবা-মাকে দেখতে, তাঁরা কেমন আছেন তা জানতে৷ আবার অনেকে স্ত্রী-সন্তান ফেলে এসছেন৷ এই মুহূর্তে পরিস্থিতি একটু ভালো থাকায় তাঁরা এই সুযোগ নিচ্ছেন৷ তাঁদের খোঁজ নিতে যাচ্ছেন৷ আবার অনেকে পালানোর সময় মাটির নীচে মূল্যবান ধন-সম্পদ পুঁতে রেখে এসেছেন৷ কেউ কেউ তার খোঁজেও গেছেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘তবে কেউই মিয়ানমারে থাকার জন্য গেছেন বলে মনে হয় না৷ তাঁরা পরিস্থিতি দেখে বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে আবারো ফিরে আসতে পারেন৷''
দুদু মিয়া
টেকনাফে বিজিবির কমান্ডার লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সম্প্রতি রাখাইন প্রদেশে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসার প্রেক্ষাপটে অনেক রোহিঙ্গা ফিরছেন৷ তবে কী পরিমাণ ফেরত যাচ্ছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ ফেরত যাওয়ার প্রবণতার কথা সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বীকার করছেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন৷ বলেন, ‘‘সপ্তাহখানেক ধরে এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে৷ তবে এই সংখ্যাটা একেবারেই নগণ্য৷''
বাংলাদেশে কক্সবাজারে দু'টি নিবন্ধিত ক্যাম্পে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী আাছে৷ এর বাইরে আরো চার লাখ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী আছেন বাংলাদেশে৷ গত অক্টোবর মাসে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন প্রদেশে মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর হামলা শুরু পর থেকে শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন, হাজারো রোহিঙ্গা গৃহহারা হয়েছেন এবং প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন৷''
বন্ধু, এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷
বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের কথা
জাতিসংঘের ত্রাণকর্মীদের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, নভেম্বরের ১৯ থেকে ২১ তারিখ, এই তিনদিনে বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে শত শত রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
সহিংসতা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৮৬ জন প্রাণ হারিয়েছে৷ গৃহহীন হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার জন৷ অক্টোবরের ২৭ তারিখে তোলা এই ছবিতে ঐ রাজ্যের একটি গ্রামের বাজার দেখা যাচ্ছে, যেটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল৷ শিশুরা সেখান থেকে বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করছে৷
ছবি: Reuters/Soe Zeya Tun
পালিয়ে বাঁচা
সহিসংতা থেকে বাঁচতে নভেম্বরের ১৯ থেকে ২১ তারিখ শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের ত্রাণকর্মীরা৷ উপরের ছবিটি ২১ নভেম্বরের৷ কক্সবাজারের কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রে বসবাসরত রোহিঙ্গা নারীরা নতুন আসা শরণার্থীদের দেখছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
নতুন শরণার্থী
মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন নতুন শরণার্থীরা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
ধরা পড়ায় কান্না
অবৈধভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত পার হওয়ায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা তাদের ধরেছে৷ মুসলিম নারী ও তাঁর সন্তানরা তাই কাঁদছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
অপেক্ষা
কুটুপালাং ক্যাম্পে ঢোকার অপেক্ষায় নতুন আসা রোহিঙ্গারা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
সন্তানসহ মা
মুসলিম এই রোহিঙ্গা নারী তাঁর সন্তানকে নিয়ে কুটুপালাং শিবিরে ঢোকার অপেক্ষায় আছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
শরণার্থী শিশু
কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রের রোহিঙ্গা শিশুরা স্কুলে পড়াশোনার ফাঁকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
আদি বাসিন্দা
কুটুপালাং ক্যাম্পে নিজেদের বাড়িতে শিশুরা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
বাড়ির আঙিনায়
একজন রোহিঙ্গা নারী তাঁর সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে কুটুপালাং শরণার্থী শিবিরে তাঁর বাড়ির সামনে বসে আছেন৷