মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘে দেয়া তাঁর প্রথম বক্তব্যে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন৷ ইরান, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন৷
বিজ্ঞাপন
উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি সারা বিশ্বের জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্প৷দেশটির নেতা কিম জং উনকে ‘রকেট ম্যান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘‘রকেট ম্যান নিজের ও তাঁর শাসনামলের জন্য আত্মহত্যামূলক মিশনে নেমেছেন৷’’ যুক্তরাষ্ট্রকে যদি নিজ দেশ ও তাঁর মিত্রদের রক্ষা করতে বাধ্য করা হয়, তাহলে ‘উত্তর কোরিয়াকে পুরো ধ্বংস’ করে দেয়ার অঙ্গীকার করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷
ট্রাম্পের সহযোগীরা জানিয়েছেন, বক্তব্য শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে প্রেসিডেন্ট নিজেই ‘রকেট ম্যান’ শব্দটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷
জাতিসংঘে ট্রাম্পের বক্তব্য শুরুর আগে অধিবেশন স্থল ত্যাগ করেন উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত ও ঊর্ধ্বতন আরেক কূটনীতিক৷
উত্তর কোরিয়ায় কিম বংশের ‘রাজত্ব’
কিম পরিবার গত ৭০ বছর ধরে উত্তর কোরিয়া শাসন করছে৷ রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় কিম ইল-সুং, কিং জং-ইল ও কিম জং-উন প্রায় দেবতার সমান৷ কিন্তু কিংবদন্তির পিছনে মানুষগুলি কারা?
ছবি: picture alliance / dpa
তরুণ নেতা
উত্তর কোরিয়ার প্রথম ও ‘চিরন্তন’ প্রেসিডেন্ট কিম ইল-সুং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে ক্ষমতায় আসেন ১৯৪৮ সালে৷ উত্তর কোরিয়ার সরকারি বর্ষপঞ্জির শুরু কিম ইল-সুং-এর জন্মবর্ষ ১৯১২ সাল থেকে৷ ছবিতে কিম ১৯৫৩ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন, যে চু্ক্তির মাধ্যমে কোরিয়া যুদ্ধের বাস্তব সমাপ্তি ঘটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বীরগাথা
কোরিয়া যুদ্ধের পর দশকের পর দশক ধরে পিয়ংইয়ং-এর প্রচারণা যন্ত্র কিম ইল-সুং-কে ঘিরে এক কিংবদন্তির মায়াজাল সৃষ্টি করেছে৷ কিমের ছোটবেলা আর ত্রিশের দশকে জাপানিদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের ভিত্তিতে তাঁকে এক অদ্বিতীয় সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিভা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে৷ ১৯৮০ সালের পার্টি কংগ্রেসে কিম ঘোষণা করেন যে, তাঁর পুত্র কিম জং-ইল তাঁর উত্তরাধিকারী হবেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আমৃত্যু শাসক
১৯৯২ সালে কিম ইল-সুং তাঁর স্মৃতিকথা লিখতে ও প্রকাশ করতে শুরু করেন৷ নাম দিয়েছিলেন ‘এক শতাব্দীর স্মৃতি’৷ স্মৃতিকথায় কিম দাবি করেছেন যে, তিনি ছয় বছর বয়সে একটি জাপানি বিরোধী প্রতিবাদসভায় যোগদান করেন ও আট বছর বয়স থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে সংশ্লিষ্ট হন৷ ১৯৯৪ সালে কিমের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিকথা অসমাপ্তই থেকে যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/JIJI Press
‘দ্য কিম ইজ ডেড, লং লিভ দ্য কিম’
পিতার মৃত্যুর পর কিম জং-ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেন৷ ইতিপূর্বে তিনি বহু বছর ধরে ক্ষমতাশীল ওপরমহলের সদস্য ছিলেন৷ তাঁর ১৬ বছরের শাসনে দরিদ্র দেশটি দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে৷ কিন্তু কিম ও তাঁর পরলোকগত পিতাকে নিয়ে ব্যক্তিপূজার ঐতিহ্য অব্যাহত থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/KCNA via Korean News Service
উঠতি তারকা
রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে একটি সামরিক শিবিরে কিম জং-ইল-এর জন্ম হয়েছিল বলে উত্তর কোরিয়ার বাইরে ইতিহাসবিদদের ধারণা৷ কিন্তু কিমের সরকারি জীবনী অনুযায়ী, তাঁর জন্ম কোরিয়ার পবিত্র পাইচু পর্বতে, ১৯৪২ সালের ১৫ই এপ্রিল তারিখে, অর্থাৎ তাঁর বাবার জন্মদিনের ঠিক ৩০ বছর পরে৷ কিমের জন্মের সময় নাকি আকাশে একটি নতুন তারা ও একটি যমজ রামধনু দেখা দেয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
পারিবারিক জটিলতা
কিম জং-ইল তিনজন পৃথক মহিলার সঙ্গে মোট তিন পুত্র ও দুই কন্যার জনক হন৷ ১৯৮১ সালের এই ছবিটিতে কিমকে তাঁর পুত্র কিম জং-নাম-এর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যিনি ২০১৭ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উত্তরাধিকারী
২০০৯ সালে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম খবর দেয় যে, কিম জং-ইল তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র কিম জং-উনকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেছেন৷ ২০১০ সালে একটি সামরিক কুচকাওয়াজে দু’জনকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল৷ পরের বছর কিম জং-ইল পরলোকগমন করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Yu
পিতাপুত্র
পিয়ংইয়ং-এর কাহিনী অনুযায়ী, ২০১১ সালে কিম জং-ইল-এর মৃত্যুর সময় একাধিক রহস্যজনক ঘটনা ঘটে৷ পবিত্র পাইচু পর্বতের উপর একটি হ্রদে জমা বরফ বরফঝড় চলাকালীন হঠাৎ বিকট আওয়াজ করে ফেটে যায়৷ অপরদিকে পাহাড়ের গায়ে এক অগ্নিময়ী বার্তা ফুটে ওঠে৷ কিম জং-ইল-এর মৃত্যুর পর পিয়ংইয়ং-এ তাঁর বাবার মূর্তির পাশে কিম-এর একটি ২২ মিটার উঁচু মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রহস্যময় অতীত
ক্ষমতা গ্রহণের আগে কিম জং-উন পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরেই ছিলেন৷ তাঁর সঠিক বয়স নিয়েও বিতর্ক আছে৷ তবে তিনি ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে ধরে নেওয়া হয়৷ তাঁর শিক্ষা সুইজারল্যান্ডে বলে কথিত আছে৷ ২০১৩ সালে তিনি সাবেক মার্কিন বাস্কেটবল তারকা ডেনিস রডম্যান-এর সঙ্গে পিয়ংইয়ং-এ মিলিত হয়ে দুনিয়াকে চমকে দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কিমাশ্চর্য
আগের কিমদের মতো কিম জং-উনকে নিয়েও নানা ‘কিম’-বদন্তি, অর্থাৎ কিংদন্তি রয়েছে৷ ২০১৫ সালে উত্তর কোরিয়ার শিক্ষকদের জন্য একটি নতুন ম্যানুয়ালে নাকি দাবি করা হয় যে, কিম তিন বছর বয়সেই গাড়ি চালাতে পারতেন৷ ২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার খবর: পাইচু পর্বতের উপর কিম-এর জন্য একটি স্মৃতিসৌধ সৃষ্টি করা হবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/Kctv
পারমাণবিক উচ্চাশা
পিতা ও পিতামহের চাইতে অনেক কম বয়সে ক্ষমতায় আসা সত্ত্বেও কিম শক্ত হাতে ক্ষমতা আঁকড়ে রয়েছেন৷ ২০১৭ সালে বিদেশে আততায়ীর হাতে তাঁর সৎভাই কিম জং-নাম-এর মৃত্যুর পর নির্মম একনায়ক হিসেবে পশ্চিমে কিম জং-উন-এর ভাবমূর্তি আরো দৃঢ় হয়েছে৷ এছাড়া কিম তাঁর দেশের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার অভূতপূর্ব ভাবে বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP/A. Young-joon
11 ছবি1 | 11
ইরানের সমালোচনা করে ট্রাম্প বলেন, দেশটির প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে ‘সহিংসতা, রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা’৷ সিরিয়ার আসাদ, লেবাননের হিজবুল্লাহ জঙ্গি গোষ্ঠী ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী গ্রুপদের সমর্থনে তেহরান তার সম্পদ ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধে সব দেশকে একত্রে কাজ করার আহ্বানও জানান তিনি৷ জাতিসংঘের সমর্থনে ইরানের সঙ্গে সই হওয়া চুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘একটি অস্বস্তি’ বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্প৷ চুক্তিটি অন্যতম বাজে আন্তর্জাতিক চুক্তি বলেও মনে করেন তিনি৷
এছাড়া ট্রাম্প জাতিসংঘে দেয়া তাঁর প্রথম বক্তব্যে সিরিয়ার আসাদ সরকারকে ‘ক্রিমিনাল রেজিম’ এবং ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘দুর্ভাগ্যমূলক শাসনামল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ তবে রাশিয়া সম্পর্কে খুব কম কথাই বলেছেন তিনি৷
প্রতিক্রিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের হুমকিকে ‘কঠোর’ ও ‘সুনির্দিষ্ট’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে৷
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পের বক্তব্য সম্পর্কে টুইটারে লিখেছেন, ‘‘জাতিসংঘে আমার ৩০ বছরের অভিজ্ঞতায় এমন সাহসী বক্তব্য আর শুনিনি৷’’
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেছেন, ট্রাম্পের ‘হেট স্পিচ’ মধ্যযুগের সঙ্গে মানানসই, একবিংশ শতকের সঙ্গে নয়৷ তাই ট্রাম্পের বক্তব্য প্রতিক্রিয়া জানানোর মতো নয় বলে মনে করেন তিনি৷
এদিকে, ডয়চে ভেলের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি আলেকজান্দ্রা ফন নামেনের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্পের বক্তব্য সম্পর্কে নিজের প্রতিক্রিয়া জানান ন্যাটো মহাসচিব ইয়েন্স স্ট্যোলেনব্যার্গ৷