দুটি ঘটনার মাঝে কেটেছে পাঁচটি বছর৷ দিল্লি গণধর্ষণের স্মৃতি ফিরে এল হরিয়ানায় গণধর্ষণের ঘটনায়৷ এবারের শিকার ১৫ বছরের এক কিশোরী৷
বিজ্ঞাপন
ফিরে এল দিল্লি ধর্ষণের স্মৃতি৷
২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে দিল্লির বাসে ধর্ষিত হয়েছিলেন এক তরুণী৷ গণধর্ষিতা সেই তরুণী জীবনযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জিততে পারেননি৷ জিততে পারলেন না দিল্লির অনতিদূরে হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রের কিশোরীও৷ ১৫ বছর বয়সি ধর্ষিতা কিশোরীর মরদেহ উদ্ধার হলো জলাশয় থেকে৷ অভিযোগ, গণধর্ষণের সময় ওই তরুণীর উপর পৈশাচিক অত্যাচার চালানো হয়৷ ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা গেছে, কিশোরীর শরীরে অন্তত ১৯টি আঘাতের চিহ্ন আছে৷ তার যৌনাঙ্গে রডজাতীয় কিছু দিয়ে বারংবার আঘাতের চিহ্নও মিলেছে৷ শুধু তাই নয়, হাতে, মুখে, বুকে রয়েছে অসংখ্য আঘাতের দাগ৷
এছাড়াও তার ফুসফুস ফেটে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা৷ আশঙ্কা, গণধর্ষণের সময় তার বুকের উপর বসে অত্যাচার চালানো হয়েছিল৷ তারই জেরে ফেটে গিয়েছে ফুসফুস৷
ছোট পোশাক পরাই কি ধর্ষণের কারণ?
ভারতে প্রতিদিন অন্তত ৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ যখনই এ ধরনের কোন মামলা আদালতে উঠেছে তখন প্রথম যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, ধর্ষণের শিকার ঐ নারী কি ধরনের পোশাক পরেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুগের সাথে পোশাক
যুগে যুগে পোশাকের ধরনে পরিবর্তন এসেছে৷ আদিমকালে ছিল পশুর চামড়া, গাছের ছাল আর এখন রয়েছে নানা ধরনের পোশাক৷ বর্তমানে দেশ, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, কাজের ধরন, অনুষ্ঠান, পছন্দ ও ফ্যাশানের ভিত্তিতে বহু ধরনের পোশাক পরে থাকেন নারীরা৷
ছবি: AP
শরীর প্রদর্শন মানেই কি ধর্ষককে আমন্ত্রণ?
ভারতে বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলায় দেখা গেছে, ধর্ষিতা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরেছিলেন৷ অর্থাৎ যাকে বলা হয় ভারতীয় নারীর আদর্শ পোশাক, সে ধরনের পোশাকই তাঁরা পরেছিলেন৷ অর্থাৎ এ জরিপ থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শরীর প্রদর্শন না করে বা তথাকথিত ‘আধুনিক’ পোশাক না পরেও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷
ছবি: Reuters
আইনের ভয় নেই
২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷
ছবি: Fotolia/DW
ধর্ষণ যখন বিনোদনের মাধ্যম
ভারতের উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এর কারণ হিসেবে পুলিশ নারীদের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার ও ছোট পোশাক পরিধানকে উল্লেখ করেছে৷ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ পুলিশ বলেছে, সেখানকার পুরুষরা তাদের বিনোদনের অভাব পূরণ করছে ধর্ষণের মাধ্যমে৷
ছবি: dapd
নারীদের দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার
রাস্তা, অফিস বা যে কোনো পাবলিক প্লেসে পুরুষের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীদের দাবিয়ে রাখতে পুরুষরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷
ছবি: UNI
পরিচিতদের দ্বারাই বেশি ধর্ষণ
২০১৩ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, সে বছর ১০০ জন ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে ৯৮ জন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাঁদের পরিচিত৷ আদালতে যেসব মামলা ওঠে, বা গণমাধ্যমে যেসব ঘটনা প্রকাশ পায় সেগুলো বেশিরভাগই বাইরের লোকের হাতে৷ ফলে পরিচিত ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/Ahmad Masood
যৌন নিগ্রহ সর্বত্র
ভারতে জন্মের আগে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি হলেও, খুব সাধারণ ঘটনা৷ ফলে পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা এত কম যে, সমাজে নারী-পুরুষের অনুপাতে হেরফের হয়৷ এছাড়া বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মা হওয়া, সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও মৃত্যুবরণ করছেন নারীরা৷ পরিবারের ভেতরেও চলে যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ৷ এরপরও কি আপনারা ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করবেন?
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
২০১২ সালে ঠিক এভাবেই অত্যাচার চালানো হয়েছিল দিল্লির গণধর্ষিতার উপর৷ তফাৎ একটাই৷ সেবার ধর্ষিতার বন্ধু এবং ধর্ষিতার কাছ থেকে কিছু তথ্য পেয়েছিল পুলিশ৷ সেই মোতাবেক গ্রেফতার হয়েছিল ধর্ষণকারীরা৷ কিন্তু এবারের ঘটনায় অভিযুক্তদের কোনো তথ্য এখনও পর্যন্ত পায়নি পুলিশ৷ তবে খোঁজ চলছে৷ জানা গেছে, কিছুদিন আগে গ্রামেরই একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়েছিল ওই কিশোরী৷ তার বাবা থানায় সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপহরণের মামলাও করেছিল৷ তবে সেই ব্যক্তির সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনার সম্পর্ক আছে কিনা, তা নিয়ে নিশ্চিত নয় পুলিশ৷
এদিকে ঘটনার পর রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে হরিয়ানা এবং রাজধানী দিল্লিতে৷ বস্তুত দেশ জুড়েই ঘটনার প্রতিবাদে পথে নেমেছেন মানুষ৷ তরুণীর বাবা পেশায় দর্জি৷ পুলিশ তাঁর হাতে মেয়ের মৃতদেহ তুলে দিতে গেলে তিনি নিতে অস্বীকার করেন৷ দাবি করেন, পুলিশ নয়, ঘটনার তদন্ত করতে হবে সিবিআইকে৷ শুধু তাই নয়, পরিবারের একজনের সরকারি চাকরি, দু'টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স এবং নির্ভয়াফান্ড থেকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণও চেয়েছেন তিনি৷ উল্লেখ্য, দিল্লি গণধর্ষণের ঘটনার পর সরকার ধর্ষিতাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ‘নির্ভয়াফান্ড' তৈরি করেছিল৷ হরিয়ানার মন্ত্রী কেকে বেদীর হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত অবশ্য ধর্ষিতার বাবা মেয়ের মৃতদেহ নিতে রাজি হন৷ বেদী জানিয়েছেন, পরিবারের দাবিগুলি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হবে৷ ক্ষতিপূরণও পাওয়া যাবে৷
অন্যদিকে হরিয়ানা পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, ঘটনাটির তদন্তের জন্য একটি বিশেষ দল তৈরি করা হয়েছে৷ তাঁদের আশা, দ্রুত অপরাধীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা যাবে৷ ইতিমধ্যেই তদন্তের কাজ শুরু হয়েছে৷
কিছুদিন আগে পাকিস্তানের কাসুর শহরে এক শিশুকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা ঘটেছিল৷ পাকিস্তান জুড়ে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছিল৷ অনেকেই সেই ঘটনার সঙ্গে দিল্লি ধর্ষণের তুলনা টেনেছিলেন৷ শুধু তাই নয়, প্রতিবাদ বিক্ষোভের ধরনের মধ্যেও দিল্লি ধর্ষণকাণ্ড পরবর্তী আন্দোলনের মিল খুঁজেছিলেন অনেকে৷ এবার দিল্লির কাছেই আবার একইরকম ঘটনা ঘটলো৷ প্রশ্ন উঠছে, আন্দোলনের ঢেউ কি আবার ২০১২ সালের চেহারা পাবে? নাগরিক সমাজ কি রাস্তায় নামবে? নাকি ঘটনাগুলি ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে?
ধর্ষিতার দুই আঙুল পরীক্ষা
কোনো নারী ধর্ষিতা হয়েছেন কিনা, তা নিরূপণের জন্য বিতর্কিত দুই আঙুল পরীক্ষা চালু করতে চেয়েছিল ভারত৷ এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়৷ শেষে অবশ্য বিশেষ কারণ ছাড়া পরীক্ষাটি বাতিল করা হয়৷ কী এই পরীক্ষা?
ছবি: AP
প্রমাণ করার জন্য
ধর্ষণকারীকে সাজা দিতে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনাটাই যথেষ্ট নয়৷ ধর্ষণ যে হয়েছে, সেটা প্রমাণ করতে হয়৷ তাই এতদিন পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরা দুই আঙুল পরীক্ষা করতেন৷
ছবি: Fotolia/detailblick
সম্ভোগের অভ্যাস
নিগৃহীতা মহিলার যৌনসম্ভোগের অভিজ্ঞতা বা অভ্যাস আছে কিনা, তা যাচাই করা হতো, কোথাও কোথাও এখনও হয়ে থাকে যোনিপথে আঙুল ঢুকিয়ে৷
ছবি: AP
কুমারিত্বের প্রমাণ
আঙুলের স্পর্শে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন, একজন নারীর সতীচ্ছদ অক্ষত আছে কিনা, অর্থাৎ সেই নারীর কুমারিত্ব অক্ষুণ্ণ আছে কিনা৷
ছবি: Fotolia/NinaMalyna
ভিত্তিহীন ধারণা
আঙুলের সাহায্যে নাকি বোঝা যায়, বলপূর্বক যৌন সম্পর্ক হয়েছিল, না সম্মতি নিয়ে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পদ্ধতিকে ভিত্তিহীন বলে নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
সর্বোচ্চ রায়
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালেই বলেছিল, দুই আঙুল পরীক্ষা ধর্ষিতার পক্ষে শারীরিক ও মানসিকভাবে অবমাননাকর৷ সরকারের বিকল্প পদ্ধতির সন্ধান করা উচিত৷
ছবি: CC-BY-SA-3.0 LegalEagle
আর্মিতে ভর্তি হতে গেলে
ইন্দোনেশিয়ায় মহিলারা আর্মিতে ভর্তি হতে চাইলে, তাঁদের এই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়৷ দেশটির আর্মি প্রধান জেনারেল মোয়েলদোকোর কথায়, ‘‘দুই আঙুল পরীক্ষা নারীর আচার-আচরণ, চরিত্র নিরীক্ষণের মূল চাবিকাঠি৷’’ বলা বাহুল্য, দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও মধ্য-পূর্ব এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতেও এটি একটি চালু পরীক্ষা৷