পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির আবর্তে প্রবাদপ্রতিম শিল্পীও৷ কিশোরকুমারের জন্মদিন ঘিরে তৃণমূল-বিজেপির মধ্যে তরজা শুরু হয়েছে৷ এতে ব্যথিত বাংলার সংস্কৃতি সমাজ৷
বিজ্ঞাপন
বাংলা তথা ভারতের সঙ্গীত জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র কিশোরকুমার৷ তাঁর গান, অভিনয় আজও মাতিয়ে রেখেছে মানুষকে৷ ৪ আগস্ট জন্মদিনে কিশোরকুমারকে স্মরণ করা হয়৷ এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে জুড়ে যান সব ধর্ম-বর্ণ-মতের মানুষ৷ কিন্তু গত বৃহস্পতিবার প্রয়াত শিল্পী-অভিনেতার ৯৩তম জন্মদিনে উঠে এলো বিভাজনের ছবি৷
স্মরণে তরজা
টালিগঞ্জে কিশোরকুমার উদ্যানে প্রতি বছর জন্মদিন পালন করা হয়৷ অনুষ্ঠানে ছিলেন তৃণমূল নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, অভিনেতা সোহম চক্রবর্তী, গায়ক সৈকত মিত্র প্রমুখ৷ রাজ্য বিজেপির অভিযোগ, এই উদ্যানে তাদের মালা দিতে দেওয়া হয়নি৷ পুলিশের অনুমতি যাতে না মেলে সেই ব্যবস্থা করা হয়৷ বিজেপি নেতা ও অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের মন্তব্য, ‘‘কিশোরকুমার কারো একার নন৷ কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পত্তি নন৷'' প্রতিবাদে কাছাকাছি টালিগঞ্জ মেট্রোর সামনে শিল্পীর ছবিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিজেপি নেতারা৷ অরূপ বিশ্বাস অভিযোগ খারিজ করে বলেন, ‘‘সকলেই এই উদ্যানে এসে প্রতি বছর শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানান৷ এখানে না এসে বিজেপি যে অভিযোগ করছে তার দায় আমরা নিতে পারব না৷''
কিশোরজিকে মরণোত্তর ‘ভারতরত্ন' দেওয়া হোক: গৌতম ঘোষ
কিশোরকণ্ঠীর আক্ষেপ
পশ্চিমবঙ্গের জনতা রাজনীতি সচেতন এমনটা বলা হয়ে থাকে৷ কিন্তু তা বলে কিশোরকুমার! এই বিষয়ে প্রশ্ন করতে বিচলিত হয়ে পড়েন গায়ক গৌতম ঘোষ৷ কিশোরকণ্ঠী হিসেবে এক সময় সাড়া জাগানো গৌতম বলেন, ‘‘তিনি আমাদের সকলের৷ তাঁকে নিয়ে ভাগাভাগি করবেন না৷ সবার কাছে এটাই অনুরোধ৷'' গৌতমের কাছে কিশোর শুধু শিল্পী নন, সাক্ষাৎ ঈশ্বর! নিজের বাড়িতে শিল্পীর মূর্তি বসিয়েছেন তিনি৷ প্রয়াত শিল্পীর পাদুকা রয়েছে শোকেসে, প্রণাম করেন রোজ৷ গত আশির দশকে কিশোর কুমারের সঙ্গে আলাপ করতে গৌতম ছুটে গিয়েছিলেন মুম্বই৷ তার প্রশ্ন, ‘‘গানবাজনা নিয়ে রাজনীতি হবে কেন? গানের কোনো রং হয় না, সবাইকে আনন্দ দেয়৷ সেটাই আজীবন করেছেন কিশোর কুমার৷''
রাজনীতিতে শিল্পীরা
ভারতের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শিল্পীদের সঙ্গে রাজনীতির প্রত্যক্ষ যোগ ছিল৷ গণ আন্দোলনের গান তৈরি করে সলিল চৌধুরীর মতো শিল্পীরা জনমত গঠনে সাহায্য করেছেন৷ কিশোরকুমার রাজনীতি থেকে সযত্নে দূরে থাকতে চেয়েছেন৷ সত্তরের দশকে যুব কংগ্রেসের পদযাত্রায় অংশ নেওয়ার ডাক প্রত্যাখ্যান করেন তিনি৷ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের প্রচারমূলক বিজ্ঞাপনে গান গাইতেও অস্বীকার করেন৷ এ জন্য তাকে সরকারি গণমাধ্যমে নির্বাসন দেওয়া হয়৷ এখন বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি মহল অবশ্য অনেকটাই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত৷ ফলে বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূলের আমলে শিল্পীদের মধ্যে শিবির বিভাজন দেখা গিয়েছে৷ তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর টলিউডের একাধিক অভিনেতা-শিল্পী সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন, জনপ্রতিনিধি হয়েছেন৷ এক সময়ের জনপ্রিয় গায়ক ইন্দ্রনীল সেন এখন রাজ্যের মন্ত্রী৷
প্রশ্ন সংস্কৃতি জগতে
সবার প্রিয় শিল্পীর জন্মদিন ঘিরে তরজা কেন হবে? প্রশ্ন তুলছে বাংলার শিল্পী মহল৷ প্রবাদপ্রতিম কণ্ঠশিল্পী, সুরকার শ্যামল মিত্রের পুত্র, গায়ক সৈকত বলেন, ‘‘কারা কেন মালা দিতে পারেননি, সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না৷ কিশোরকুমারকে নিয়ে টানাপোড়েন যারা করছেন, তারাই বলতে পারবেন কেন করছেন৷ তবে সংস্কৃতি জগতের রাজনীতিকরণ না হওয়াই কাম্য৷''
‘‘সংস্কৃতি জগতের রাজনীতিকরণ না হওয়াই কাম্য’’
পঞ্চকবির গানে প্রসিদ্ধ ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগ দিয়ে পরে দলত্যাগ করেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কিশোরকুমার সব মালার ঊর্ধ্বে৷ সারা দেশ তাঁর গান শোনে৷ এখানেই শিল্পীর জয়৷
কিশোরকে কবে ‘ভারতরত্ন'?
কিশোরকুমারকে নিয়ে রাজনীতির টানাপোড়েন চললেও রাজনীতিকরা কি তাঁর কথা মনে রেখেছেন? প্রশ্ন তুলেছেন গৌতম ঘোষ৷ তার বক্তব্য, ‘‘কিশোরজিকে মরণোত্তর ‘ভারতরত্ন' দেওয়া হোক৷কেন তিনি সরকারি স্বীকৃতি পাবেন না? কংগ্রেস দেয়নি, বিজেপি দেয়নি৷ অথচ লক্ষ লক্ষ মানুষ তার গানকে পুঁজি করে বেঁচে আছে৷ তিনি নিজেই একটা ইন্ডাস্ট্রি৷ অথচ কেউ কিশোরকুমারকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবে না৷''
শতবর্ষ থেকে আর মাত্র সাত বছর দূরে দাঁড়িয়ে ভারতীয় সঙ্গীতের রত্ন৷ ভারত সরকার কবে তাঁর নাম বিবেচনা করবেন? এই প্রশ্ন সব সঙ্গীতপ্রেমীরই৷
ভারতের প্রভাবশালী শিল্পীরা
মনের ভাব প্রকাশে শিল্প ও সাহিত্য চিরদিনই সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে৷ ক্লাসিক্যাল মিউজিক, বলিউডের দাপট, সব মিলিয়ে তাই ভারতীয় শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিশ্বজুড়ে গর্বিত পদচারণা৷
ছবি: Manjunath Kiran/AFP/Getty Images
ওস্তাদ রবি শংকর
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে পশ্চিমা বিশ্বে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে যাঁরা জনপ্রিয় করে তুলেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ওস্তাদ রবি শংকর৷ সেতারে তাঁর শাস্ত্রীয় সংগীতের মূর্ছনা অনুপ্রাণিত করেছে বিখ্যাত সব পশ্চিমা শিল্পীকেও৷ বিখ্যাত বেহালাবাদক ইয়েহুদি মেনুহিন থেকে শুরু করে জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটলসের জর্জ হ্যারিসনও তাঁদের একাধিক মিউজিকে ব্যবহার করেছেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত৷
ছবি: AP
লতা মঙ্গেশকর
ভারতের মারাঠায় জন্ম নেয়া কিংবদন্তী গায়িকা লতা মঙ্গেশকর এক হাজারের বেশি ভারতীয় ছবিতে গান করেছেন৷ এছাড়া বাংলাসহ ভারতের ২০টি ভাষায় গান গেয়ে বিশ্ব রেকর্ডও করেছেন তিনি৷ ২০০১ সালে কেবল দ্বিতীয় সংগীতশিল্পী হিসেবে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পেয়েছেন লতা৷
ছবি: AP
ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান
বিয়েতে বধূবিদায়ে সানাইয়ের করুণ সুর একসময় প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল৷ সেই সানাই বাজিয়ে যে কেউ বিশ্বখ্যাত হতে পারে, তা প্রমাণ করে গেছেন ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান৷ ১৯৩৭ সালে কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে সানাই বাজিয়ে এই যন্ত্রে ভারতীয় সংগীতের মূল মঞ্চে নিয়ে আসেন তিনি৷ ২০০৬ সালে মৃত্যুর আগে পেয়েছেন ভারতের চারটি বেসামরিক সম্মান- ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ এবং পদ্মশ্রী৷
ছবি: SAJJAD HUSSAIN/AFP/Getty Images
অমিতাভ বচ্চন
১৯৭০-এর শুরুতে বলিউড চলচ্চিত্র জগতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন অমিতাভ এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী অভিনেতা হিসেবে স্থান করে নেন৷ পাঁচ দশকের বেশি সময়ের অভিনয় জীবনে ১৯০টির অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন৷ ৭৬ বছর বয়সেও সমান তালে তরুণদের সাথে পাল্লা দিয়ে বলিউডে রাজত্ব করে চলেছেন বলিউডের শাহেনশাহ৷
ছবি: picture alliance/dpa/J. Kalaene
জুবিন মেহতা
এই তারকা মায়েস্ত্রো ১৯৩৬ সালে জন্ম নেন ভারতের মুম্বাইয়ে৷ ১৮ বছর বয়সে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় যান পড়াশোনা করতে৷ ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলে সফল ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন মেহতা৷ কিন্তু পশ্চিমা মিউজিকের সাথে সম্মিলন ঘটিয়েছেন ভারতীয় দ্যোতনার৷ পশ্চিমা ক্লাসিক্যাল মিউজিক ভারতে পরিচিত করাতে গড়ে তুলেছেন নিজের ফাউন্ডেশন৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Jordan
যশ চোপড়া
অনেকেই বলে থাকেন, যশ চোপড়াকে ছাড়া বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কখনোই বিশ্বজুড়ে এত প্রভাব বিস্তার করতে পারতো না৷ ভারতীয় চলচ্চিত্রে যশ চোপড়া পরিচিত ‘রোমান্সের রাজা’ হিসেবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Court
শাহ রুখ খান
বলিউডের বাদশাহ শাহ রুখ খানকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই৷ হলিউডের অভিনেতা জনি ডেপ ও টম ক্রুজের একত্রে যত ভক্ত আছেন, বিশ্বজুড়ে ‘এসআরকে’ নামে পরিচিত এই সুপার স্টারের ফ্যান তার চেয়েও অনেক বেশি৷ মেলোড্রামাটিক সিনেমাতে দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজত্ব করে চলেছেন শাহ রুখ৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Verma
সুবোধ গুপ্ত
ইন্স্টলেশন মাস্টার সুবোধ গুপ্ত বিশ্বজুড়ে পরিচয় করিয়েছেন ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ নামের নতুন এক ট্রেন্ড৷ তাঁর কাজ সবচেয়ে বেশি অর্থের বিনিময়ে বিক্রির রেকর্ডও করেছে একাধিকবার৷ প্রায় সব কাজেই নিজের জন্মস্থান বিহারে কাটানো শৈশব এবং বিশ শতকে ভারতের পরিবর্তনের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে তাঁর প্রয়াস দেখা যায়৷
ছবি: Imago/H. Förster
অরুন্ধতী রায়
২০১৪ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও অ্যাক্টিভিস্ট অরুন্ধতী৷ তিনি পরিচিত হয়ে আছেন তাঁর পুরস্কার বিজয়ী উপন্যাস দ্য গড অব স্মল থিংস-এর জন্য৷ ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসটি ১৯৯৮ সালের ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/ANSA/G. Onorati
এ আর রহমান
এ আর রহমান পুরো নাম আল্লাহ রাখা রহমান৷ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সাথে ইলেকট্রনিক মিউজিক এবং পশ্চিমা অর্কেস্ট্রাল মিউজিকের সম্মিলনের জন্যে বিখ্যাত এ আর রহমান৷ চলচ্চিত্রে মিউজিক পরিচালনার জন্য তিনি দুটি অস্কার পেয়েছেন৷ ২০০৪ সালে টাইমস ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে৷