বাংলাদেশের আইন ও সাধারণ মানুষের মনোভাব কি শিশুবান্ধব? একদিকে শিশুরা যেমন হত্যা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে নানা ‘অপরাধের' কথা বলে তাদের আটক করা হচ্ছে সাধারণ আইনে৷ তার ওপর সংশোধন কেন্দ্রগুলোও শিশুদের উপযোগী নয়!
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইন অনুযায়ী, এখন ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কেউ শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে৷ শুধু তাই নয়, নয় বছরের কম বয়সি শিশুকে কোনো অপরাধের অভিযোগে আটক বা শাস্তি দেয়া যাবে না৷ ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কাউকে আটক করা হলে তাদের হ্যান্ডকাপ পড়ানো যাবে না৷ আর শিশু-কিশোরদের বিচার হতে হবে শিশু-কিশোর আদালতে৷ আদালত তাদের বিচার শেষে ‘অপরাধের' প্রমাণ পেলে শিশু কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হবে অভিযুক্তদের৷ আদালত যতদিন নির্দেশ দেবে, ততদিন তারা সেখানে থাকবে৷ বলা বাহুল্য, এই সব কেন্দ্রে শিশুদের মানসিক, চারিত্রিক, শিক্ষা এবং আত্মিক উন্নয়ন ঘটানোর কথা৷ কিন্তু বাস্তবে কী হয় তা কয়েকটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে৷
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গাজীপুরের টঙ্গীতে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ২০ জন শিশু-কিশোর তাদের নির্যাতন এবং ঠিকমত খাবার না দেয়ার ‘রক্তাক্ত প্রতিবাদ' জানায়৷ তারা ধারালো ব্লেড দিয়ে তাদের হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে প্রতিবাদ জানালে এবং তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে, ব্যাপক আলোচনায় আসে৷ কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, পরে সমাজসেবা অধিদপ্তর তদন্ত করে ঐ শিশু-কিশোরদেরই দায়ী করে৷ এমনকি তাদের ‘বেয়াড়া' বলে তদন্ত প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়৷
ক্যামেরার চোখে বাংলাদেশে শিশু শ্রম
বাংলাদেশে ৪৫ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ তাদের মধ্যে ১৭ লাখের বেশি আবার কাজ করে রাজধানী ঢাকায়৷ আমাদের আলোকচিত্রী মুস্তাফিজ মামুন শিশুশ্রমের কিছু চিত্র তুলে এনেছেন আপনাদের জন্য৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বেলুন কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের একটি বেলুন তৈরির কারখানায় কাজ করছে দশ বছরের এক শিশু৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, যার প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক খোদ রাজধানীতেই৷
ছবি: Mustafiz Mamun
নেই কোনো নজরদারি
কামরাঙ্গীর চরের এই বেলুন কারখানায় খোলামেলাভাবে নানা ধরনের রাসায়নিকের মাঝে কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সিংহভাগই শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে কমপক্ষে দশটি বেলুন তৈরির কারখানা আছে, যেগুলোর সিংহভাগেই শিশু শ্রমিক কাজ করে৷ সড়ক থেকে একটু আড়ালে ভেতরের দিকেই কাজ করানো হয় শিশুদের৷ সপ্তাহে সাত দিনই সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয় তাদের৷ তবে শুক্রবারে আধাবেলা ছুটি মেলে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
ঢাকার কেরাণীগঞ্জে সিলভারের তৈজসপত্র তৈরির কারখানায় কাজ করে শিশু শ্রমিক আলী হোসেন৷ মারাত্মক উচ্চ শব্দের মধ্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় তাকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ট্যানারি কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার হাজারীবাগের একটি ট্যানারি কারখানায় বাইরে কাজ করে নোয়াখালীর আসিফ৷ বয়স মাত্র বারো৷ রাসায়নিক মিশ্রিত চামড়া শুকানোর কাজ করে সে৷ দিনে ১২ ঘণ্টারও বেশি কাজ করে সামান্য যে মজুরি পায় তা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সাহায্য করে আসিফ৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মায়ের সঙ্গে রাব্বি
কামরাঙ্গীর চরের একটি প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে মায়ের সঙ্গে কাজ করে চাঁদপুরের রাব্বি৷ এই কেন্দ্রের মালিক নাকি শিশু শ্রমিক নিয়োগের বিরোধী৷ মায়ের অনুরোধে রাব্বিকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁর৷ কারণ রাব্বির মা সারাদিন খেটে যে মজুরি পান তাতে সংসার চলে না৷ সংসার চালাতে তাই কাজ করতে হচ্ছে রাব্বিকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
হিউম্যান হলারে শিশু হেল্পার
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী হিউম্যান হলারগুলোতে শিশু শ্রমিক চোখে পড়ার মতো৷ বাহনগুলো দরজায় ঝুলে ঝুলে কাজ করতে হয় এ সব শিশুদের৷ চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকারও হয় এসব শিশুরা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্রিক ফিল্ডে শিশুরা
ঢাকার আমিন বাজারের বিভিন্ন ব্রিক ফিল্ডেও কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ প্রতি হাজার ইট বহন করে পারিশ্রমিক পায় ১০০-১২০ টাকা৷ একটি কাঁচা ইটের ওজন কমপক্ষে তিন কেজি৷ একেকটি শিশু ৬ থেকে ১৬টি ইট এক-একবারে মাথায় নিয়ে পৌঁছে দেয় কমপক্ষে ৫০০ গজ দূরে, ইট ভাটায়৷ তাদের কোনো কর্মঘণ্টাও ঠিক করা নেই৷ একটু বেশি উপার্জনের আশায় রাত পর্যন্ত কাজ করে তারা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেদ কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা
পুরনো ঢাকার লালবাগের একটি লেদ কারখানায় কাজ করে ১১ বছরের শিশু রহিম৷ সারাদিন লোহা কাটা, ভারি যন্ত্রপাতি মেরামত, হাতুরি পেটানোসহ নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে সে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
9 ছবি1 | 9
এরপরে যশোরে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রেও প্রতিবাদের ঘটনা ঘটে৷ একই বছরের মে মাসে মারপিট, নিম্নমানের খাবার সরবরাহসহ সাতটি অভিযোগকে নিয়ে কিশোররা ‘বিদ্রোহ' করলে পুলিশ তাদের নিবৃত্ত করতে গুলি ছোঁড়ে৷ পুলিশি ধাওয়া ও গুলিতে আহত হয় ১৩ কিশোর৷ পরে নির্যাতনের মুখে ১৬ জন শিশু-কিশোর পালিয়ে যায়৷ এ সব কেন্দ্রে নয় বছরের কম বয়সি শিশুদের রাখা হয় বলে ঘটনার পর তদন্তে বেরিয়ে আসে, যা বেআইনি৷
আরেকটি উদাহরণ দিলে শিশুদের ব্যাপারে আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে৷ চলতি মাসেই হবিগঞ্জে এক স্কুলছাত্রীকে মারধরের ঘটনায় আটক চঞ্চল রহমানের (১৪, ছদ্মনাম) সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় পুলিশ৷ তাকে হ্যান্ডকাফ পড়ানো হয়৷ এমনকি তার ছবি সংবাদমাধ্যমেও দেয়া হয়৷ আদালত অবশ্য তাকে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়৷
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর কমপক্ষে দুই হাজার শিশুকে নানা ‘অপরাধে' আটক করা হচ্ছে৷ দুঃখের বিষয়, তাদের সঙ্গে পুলিশ প্রাপ্তবয়স্ক আসামির মতোই আচরণ করে৷ শিশু অধিকার ফোরাম নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৭৬ জন শিশুকে আটকের কথা বলা হয়েছে৷ তাদের অস্ত্র ও মাদক বহনসহ নানা অভিযোগে আটক করা হয়৷ এই হিসাব সংবাদমাধ্যম থেকে নিয়েছে সংস্থাটি৷ তাই যা সংবাদমাধ্যমে আসেনি তার হিসাব তারা দেয়নি৷
তবে তাদের হিসাবে শিশুদের রাজনৈতিক দল এবং অপরাধী চক্রের বিশেষ করে অবৈধ মাদক এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষণীয়৷ বর্তমান আইনে শিশুদের যারা ব্যবহার করে, তাদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে শিশুদের অবৈধকাজে ব্যবহারকারীরা শাস্তির আওয়তায় আনা যায় না৷ শিশুদেরই শাস্তি পেতে হয়৷ আটক শিশুদের বড় একটি অংশকে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয় না৷ পুলিশ বয়স বাড়িয়ে দিয়ে (১৮ বছরের বেশি দেখায়) তাদের সাধারণ আইনেই বিচারে সোপর্দ করে৷ এরপর তাদের পাঠানো হয় কারাগারে৷ কিন্তু আইনে আছে শিশু-কিশোরদের কোনোভাবেই সাধারণ আইনের আওতায় আনা যাবে না৷ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শিশু আইনে শিশু-কিশোর আদালতে নিষ্পত্তি করতে হবে৷ আর প্রত্যেক জেলা এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় শিশু আদালত গঠনের কথা বলা আছে আইনে৷
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের যে ছবি আলোড়ন তুলেছে
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ এখনো এক বড় সমস্যা৷ দেশটিতে ৬৫ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে আঠারো বছর বয়স পার হওয়ার আগেই৷ বার্তা সংস্থা গ্যাটি ইমেজেস-এর এক ফটোগ্রাফার তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করছেন এমনই একটি বাল্যবিবাহের কিছু ছবি৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
নওশিনের বিয়ে
নওশিন আক্তারের বয়স ১৫ বছর৷ বাবার বাড়ি বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে৷ বিয়ের দিনও সে ছুটে বেড়াচ্ছিল পড়শিদের বাড়ি বাড়ি৷ সেখান থেকেই ধরে এনে বিয়ের পিড়িতে বসানো হয় তাকে৷ তার বিয়ের, আইনি দৃষ্টিতে যা অবৈধ, কিছু ছবি থাকলো এই ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বিয়ে বাড়িতে উৎসব
আগস্টের ২০ তারিখে বিয়ে হয় নওশিনের৷ নিজে বিয়ের অর্থ সে তেমন না বুঝলেও, পাড়াপড়শির এই বিয়ে নিয়ে আগ্রহের কমতি ছিল না৷ বিয়ের দিন উৎসবের এই ছবি জানান দিচ্ছে একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরের বয়স নিয়ে তাঁদের কোনো ভাবনা নেই৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
নওশিনের গোসল
বিয়ের দিন প্রকাশ্যেই গোসল করানো হয় নওশিন আক্তারকে৷ বাল্যবিবাহের জন্য তাকে প্রস্তুত করার অংশ এই গোসল৷ অনেকের সঙ্গে এএফপি-র আলোকচিত্রিও দেখেছেন সেই আচার৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বিউটি পার্লারে নওশিন
বিয়ের জন্য সাজাতে নওশিনকে নেয়া হয়েছে বিউটি পার্লারে৷ বাংলাদেশের আনাচেকানাচে এ রকম পার্লারের সংখ্যা অনেক৷ ছবিতে কাপড় পরার সময় অপর এক নারীকে দেখছে নওশিন৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
কনের মেকআপ
বিয়ের সাজে সাজানো হচ্ছে নওশিনকে৷ বাংলাদেশে কনেকে বেশ রংচংয়ে মেকআপে সাজানো হয়৷ অনেক সময় চেহারার রং ফর্সা করার চেষ্টা করা হয় জোর করে, যা অনেকসময় দেখতে কিছুটা দৃষ্টিকটু হলেও ঐতিহাসিকভাবে চলে আসছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
গহনা ছাড়া কি বিয়ে হয়?
কনে নওশিনকে গহনা পড়িয়ে দিচ্ছেন তার আত্মীয়রা৷ বাংলাদেশে বিয়েতে সোনার গহনা এক অপরিহার্য উপাদান৷ কনের পরিবারের আর্থিক অবস্থা যেমনই হোক, সোনাদানা ছাড়া বিয়ে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে একরকম ভাবাই যায় না৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
জোর করে বিছানায় নেয়া হচ্ছে নওশিনকে
নওশিনকে তার এক আত্মীয় জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন একটি বিছানায়, যেখানে তার ছবি তোলা হবে৷ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে ২৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের বয়স ১৫ পার হওয়ার আগে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
ভিডিও-র জন্য ‘পোজ’
ভিডিও-র জন্য পোজ দিচ্ছে নওশিন আক্তার৷ তার বিয়ের মুহূর্তগুলো এভাবেই ক্যামেরাবন্দি করেছেন ভাড়া করা আলোকচিত্রিরা৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
৩২ বছর বয়সি বর
নওশিনের বরের নাম মোহাম্মদ হাসামুর রহমান, বয়স ৩২ বছর৷ বিয়ের সন্ধ্যায় অপ্রাপ্তবয়স্ক কনের সঙ্গে ছবির জন্য পোজ দিয়েছেন রহমান৷ এএফপি-র একজন বিদেশি আলোকচিত্রি সেই বিয়েতে উপস্থিত হতে পারলেও বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পারেনি গিয়ে বিয়েটি বন্ধ করতে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে নওশিন
বিয়ে শেষে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে ১৫ বছর বয়সি নওশিন৷ পরিবারের সদস্যরা তাকে গাড়িতে তুলে দিচ্ছেন৷ বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের এ সব ছবি গোটা বিশ্বের আলোড়ন তুলেছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
10 ছবি1 | 10
বাংলাদেশের গাজীপুরে দু'টি এবং যশোরে একটি শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে৷ এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য৷ সব মিলিয়ে এই তিনটির ধারণ ক্ষমতা ৬০০ জনের৷ তাহলে বোঝা যায় আটক শিশুদের বড় একটি অংশ কারাগারেই থাকে, উন্নয়ন কেন্দ্রে জায়গা হয় না৷ উন্নয়ন কেন্দ্রে পুলিশ, সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং অভিভাবকরা শিশুদের পাঠায়৷
গত বছর গাজীপুর ও যশোরের শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ‘বিদ্রোহের' পর তার প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান৷ তিনি দু'টি কেন্দ্রই পরিদর্শন করেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, ‘‘এই উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর আগে নাম ছিল সংশোধন কেন্দ্র৷ নামের পরিবর্তন হলেও পরিবেশ বা ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নয়ন ঘটেনি৷ শিশু-কিশোরদের পর্যাপ্ত খাবার, প্রয়োজনীয় পোশাক এবং শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয় না৷ ফলে তাদের উন্নয়ন বা সংশোধন না হয়ে তারা বরং ‘অপরাধী' হয়ে উঠতে পারে৷''
তিনি বলেন, ‘‘দেশে বর্তমান শিশু আইনটি যথেষ্ট ভালো হলেও এর প্রয়োগ তেমন নেই৷ অনেক শিশুকেই বড়দের সাথে কারাগারে রাখা হয়৷ আবার নয় বছরের নীচের শিশুকেও আটক করা হয়৷''
তিনি তাঁর গবেষণার আলোকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে শিশুরা প্রধানত অপরাধে জড়িয়ে পড়ে অপরাধী চক্রের কারণে৷ তারা শিশুদের ব্যবহার করে৷ এছাড়া পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থার কারণেও তারা অপরাধে জড়ায় না জেনে৷ বাংলাদেশের শিশুদের একটি অংশ শেকড়হীন, পথ শিশু, তারাই অপরাধী চক্রের প্রধান টার্গেট৷''
শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘শিশুদের জন্য নতুন করে ভাবতে হবে৷ উন্নয়ন কেন্দ্র বা জেলখানা নয়, তাদের সত্যিকার অর্থেই পারিবারিক পরিবেশে সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে৷''
শিশুদের নিয়ে মন খারাপ করা কিছু খবর
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকলকে শিশু বলে গণ্য করা হয়৷ শিশুদের নিয়ে ছবিঘরে থাকছে এমন কিছু তথ্য, যা পড়ে আপনার মন খারাপ হতে বাধ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সাত মাসে ৬১ গণধর্ষণ
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ২৬৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ এর হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৬১টি শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য জানায় ফোরামটি৷ একই সময়ে ধর্ষণ, উত্ত্যক্তসহ যৌন সহিংসতার শিকার হয় ৩৪৭টি শিশু৷ এর মধ্যে চারটি ছেলেশিশুও রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বয়স ১৫ হওয়ার আগেই বিয়ে
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে ২৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের বয়স ১৫ পার হওয়ার আগে৷ আর ৬৫ শতাংশের বিয়ে হয় বয়স ১৮ পার হওয়ার আগে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশুর বাস খোদ ঢাকা শহরে৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
কিশোর অপরাধী
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর কমপক্ষে দুই হাজার শিশুকে নানা অপরাধে আটক করা হয়৷ শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৭৬ জন শিশুকে অস্ত্র ও মাদক বহনসহ নানা অভিযোগে আটক করা হয়৷
ছবি: bilderbox
মাত্র তিনটি
আইন অনুযায়ী শিশু-কিশোর অপরাধীদের বিচার করা হয় কিশোর আদালতে৷ এরপর বিচার শেষে শাস্তি ভোগের জন্য তাদের শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর কথা৷ কিন্তু বাংলাদেশে এমন কেন্দ্র আছে মাত্র তিনটি৷ গাজীপুরে দু’টি এবং যশোরে একটি৷ এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য৷ সব মিলিয়ে এই তিনটির ধারণ ক্ষমতা ৬০০৷ অর্থাৎ আটক শিশুদের বড় একটি অংশের জায়গা উন্নয়ন কেন্দ্রে হয় না৷ ফলে তাদের কারাগারে থাকতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
5 ছবি1 | 5
শিশুদের অপরাধের নামে আটকের পাশাপাশি তারা নানাভাবে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিশুরা৷ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২,৮০১ জন শিশু হত্যাসহ নানা ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ ২০১৪ সালে এই সংখ্যা চার হাজারের বেশি৷ তবে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হবে, কারণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ না হলে সে তথ্য তারা পায় না৷
মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘শিশুরা নানা দিক থেকে নির্যাতন এবং বেআইনি ব্যবস্থার শিকার হচ্ছে৷ তাদের যারা বিপথগামী করে তারা আইনের আওতায় আসে না৷ বরং বেআইনিভাবে তাদের শাস্তি দেয়া হয়৷'' এ নিয়ে তিনি একাধিকবার হাইকোর্টে রিট করার কথা জানান৷
তিনি জানান, ‘‘অনেক সময়ই পুলিশ শিশুদের বয়স বাড়িয়ে ‘প্রাপ্তবয়স্ক' দেখায়৷ সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘প্রবেশন কর্মকর্তারা' তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন না৷ ফলে শিশু হয়ে যায় প্রাপ্তবয়স্ক৷ এমনকি শিশুদের থানা হাজতে রাখারও নজির আছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের সার্বিক সামাজিক এবং আইনি ব্যবস্থা শিশুবান্ধব নয়৷ তারা সবচেয়ে ‘ভালনারেবল গ্রুপ' হওয়ায় তারা সামজিকভাবে যেমন নিগৃহীত হয়, তেমনি আইনের নামেও তাদের সঙ্গে বেআইনি আচরণ করা হয়৷''
এছাড়া বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করছে না বলে জানান তিনি৷ তাঁর কথায়, ‘‘আইনে বিপর্যস্ত বা আটক শিশুদের পরিচয় এবং ছবি প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, তা মানছে না সংবাদমাধ্যম৷ ফলে কোনো ‘অপরাধে' আটক শিশুর ছবি প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যম তাকে ‘অপরাধী' হিসবে সমাজের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার সংশোধন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে৷''
আপনিও কি কিছু বলতে চান? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷