1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে কিশোর ‘অপরাধ’

হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা৭ অক্টোবর ২০১৫

বাংলাদেশের আইন ও সাধারণ মানুষের মনোভাব কি শিশুবান্ধব? একদিকে শিশুরা যেমন হত্যা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে নানা ‘অপরাধের' কথা বলে তাদের আটক করা হচ্ছে সাধারণ আইনে৷ তার ওপর সংশোধন কেন্দ্রগুলোও শিশুদের উপযোগী নয়!

Bildergalerie Kinderarmut Bangladesch Armut Weltkindertag
ছবি: Mustafiz Mamun

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইন অনুযায়ী, এখন ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কেউ শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে৷ শুধু তাই নয়, নয় বছরের কম বয়সি শিশুকে কোনো অপরাধের অভিযোগে আটক বা শাস্তি দেয়া যাবে না৷ ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কাউকে আটক করা হলে তাদের হ্যান্ডকাপ পড়ানো যাবে না৷ আর শিশু-কিশোরদের বিচার হতে হবে শিশু-কিশোর আদালতে৷ আদালত তাদের বিচার শেষে ‘অপরাধের' প্রমাণ পেলে শিশু কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হবে অভিযুক্তদের৷ আদালত যতদিন নির্দেশ দেবে, ততদিন তারা সেখানে থাকবে৷ বলা বাহুল্য, এই সব কেন্দ্রে শিশুদের মানসিক, চারিত্রিক, শিক্ষা এবং আত্মিক উন্নয়ন ঘটানোর কথা৷ কিন্তু বাস্তবে কী হয় তা কয়েকটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে৷

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গাজীপুরের টঙ্গীতে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ২০ জন শিশু-কিশোর তাদের নির্যাতন এবং ঠিকমত খাবার না দেয়ার ‘রক্তাক্ত প্রতিবাদ' জানায়৷ তারা ধারালো ব্লেড দিয়ে তাদের হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে প্রতিবাদ জানালে এবং তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে, ব্যাপক আলোচনায় আসে৷ কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, পরে সমাজসেবা অধিদপ্তর তদন্ত করে ঐ শিশু-কিশোরদেরই দায়ী করে৷ এমনকি তাদের ‘বেয়াড়া' বলে তদন্ত প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়৷

এরপরে যশোরে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রেও প্রতিবাদের ঘটনা ঘটে৷ একই বছরের মে মাসে মারপিট, নিম্নমানের খাবার সরবরাহসহ সাতটি অভিযোগকে নিয়ে কিশোররা ‘বিদ্রোহ' করলে পুলিশ তাদের নিবৃত্ত করতে গুলি ছোঁড়ে৷ পুলিশি ধাওয়া ও গুলিতে আহত হয় ১৩ কিশোর৷ পরে নির্যাতনের মুখে ১৬ জন শিশু-কিশোর পালিয়ে যায়৷ এ সব কেন্দ্রে নয় বছরের কম বয়সি শিশুদের রাখা হয় বলে ঘটনার পর তদন্তে বেরিয়ে আসে, যা বেআইনি৷

আরেকটি উদাহরণ দিলে শিশুদের ব্যাপারে আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে৷ চলতি মাসেই হবিগঞ্জে এক স্কুলছাত্রীকে মারধরের ঘটনায় আটক চঞ্চল রহমানের (১৪, ছদ্মনাম) সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় পুলিশ৷ তাকে হ্যান্ডকাফ পড়ানো হয়৷ এমনকি তার ছবি সংবাদমাধ্যমেও দেয়া হয়৷ আদালত অবশ্য তাকে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়৷

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর কমপক্ষে দুই হাজার শিশুকে নানা ‘অপরাধে' আটক করা হচ্ছে৷ দুঃখের বিষয়, তাদের সঙ্গে পুলিশ প্রাপ্তবয়স্ক আসামির মতোই আচরণ করে৷ শিশু অধিকার ফোরাম নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৭৬ জন শিশুকে আটকের কথা বলা হয়েছে৷ তাদের অস্ত্র ও মাদক বহনসহ নানা অভিযোগে আটক করা হয়৷ এই হিসাব সংবাদমাধ্যম থেকে নিয়েছে সংস্থাটি৷ তাই যা সংবাদমাধ্যমে আসেনি তার হিসাব তারা দেয়নি৷

তবে তাদের হিসাবে শিশুদের রাজনৈতিক দল এবং অপরাধী চক্রের বিশেষ করে অবৈধ মাদক এবং অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষণীয়৷ বর্তমান আইনে শিশুদের যারা ব্যবহার করে, তাদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে শিশুদের অবৈধকাজে ব্যবহারকারীরা শাস্তির আওয়তায় আনা যায় না৷ শিশুদেরই শাস্তি পেতে হয়৷ আটক শিশুদের বড় একটি অংশকে শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয় না৷ পুলিশ বয়স বাড়িয়ে দিয়ে (১৮ বছরের বেশি দেখায়) তাদের সাধারণ আইনেই বিচারে সোপর্দ করে৷ এরপর তাদের পাঠানো হয় কারাগারে৷ কিন্তু আইনে আছে শিশু-কিশোরদের কোনোভাবেই সাধারণ আইনের আওতায় আনা যাবে না৷ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শিশু আইনে শিশু-কিশোর আদালতে নিষ্পত্তি করতে হবে৷ আর প্রত্যেক জেলা এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় শিশু আদালত গঠনের কথা বলা আছে আইনে৷

বাংলাদেশের গাজীপুরে দু'টি এবং যশোরে একটি শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে৷ এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য৷ সব মিলিয়ে এই তিনটির ধারণ ক্ষমতা ৬০০ জনের৷ তাহলে বোঝা যায় আটক শিশুদের বড় একটি অংশ কারাগারেই থাকে, উন্নয়ন কেন্দ্রে জায়গা হয় না৷ উন্নয়ন কেন্দ্রে পুলিশ, সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং অভিভাবকরা শিশুদের পাঠায়৷

গত বছর গাজীপুর ও যশোরের শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ‘বিদ্রোহের' পর তার প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান৷ তিনি দু'টি কেন্দ্রই পরিদর্শন করেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, ‘‘এই উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর আগে নাম ছিল সংশোধন কেন্দ্র৷ নামের পরিবর্তন হলেও পরিবেশ বা ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নয়ন ঘটেনি৷ শিশু-কিশোরদের পর্যাপ্ত খাবার, প্রয়োজনীয় পোশাক এবং শিক্ষা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয় না৷ ফলে তাদের উন্নয়ন বা সংশোধন না হয়ে তারা বরং ‘অপরাধী' হয়ে উঠতে পারে৷''

তিনি বলেন, ‘‘দেশে বর্তমান শিশু আইনটি যথেষ্ট ভালো হলেও এর প্রয়োগ তেমন নেই৷ অনেক শিশুকেই বড়দের সাথে কারাগারে রাখা হয়৷ আবার নয় বছরের নীচের শিশুকেও আটক করা হয়৷''

তিনি তাঁর গবেষণার আলোকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে শিশুরা প্রধানত অপরাধে জড়িয়ে পড়ে অপরাধী চক্রের কারণে৷ তারা শিশুদের ব্যবহার করে৷ এছাড়া পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থার কারণেও তারা অপরাধে জড়ায় না জেনে৷ বাংলাদেশের শিশুদের একটি অংশ শেকড়হীন, পথ শিশু, তারাই অপরাধী চক্রের প্রধান টার্গেট৷''

শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘শিশুদের জন্য নতুন করে ভাবতে হবে৷ উন্নয়ন কেন্দ্র বা জেলখানা নয়, তাদের সত্যিকার অর্থেই পারিবারিক পরিবেশে সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে৷''

শিশুদের অপরাধের নামে আটকের পাশাপাশি তারা নানাভাবে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিশুরা৷ শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২,৮০১ জন শিশু হত্যাসহ নানা ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ ২০১৪ সালে এই সংখ্যা চার হাজারের বেশি৷ তবে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হবে, কারণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ না হলে সে তথ্য তারা পায় না৷

মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘শিশুরা নানা দিক থেকে নির্যাতন এবং বেআইনি ব্যবস্থার শিকার হচ্ছে৷ তাদের যারা বিপথগামী করে তারা আইনের আওতায় আসে না৷ বরং বেআইনিভাবে তাদের শাস্তি দেয়া হয়৷'' এ নিয়ে তিনি একাধিকবার হাইকোর্টে রিট করার কথা জানান৷

তিনি জানান, ‘‘অনেক সময়ই পুলিশ শিশুদের বয়স বাড়িয়ে ‘প্রাপ্তবয়স্ক' দেখায়৷ সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘প্রবেশন কর্মকর্তারা' তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন না৷ ফলে শিশু হয়ে যায় প্রাপ্তবয়স্ক৷ এমনকি শিশুদের থানা হাজতে রাখারও নজির আছে৷''

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের সার্বিক সামাজিক এবং আইনি ব্যবস্থা শিশুবান্ধব নয়৷ তারা সবচেয়ে ‘ভালনারেবল গ্রুপ' হওয়ায় তারা সামজিকভাবে যেমন নিগৃহীত হয়, তেমনি আইনের নামেও তাদের সঙ্গে বেআইনি আচরণ করা হয়৷''

এছাড়া বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করছে না বলে জানান তিনি৷ তাঁর কথায়, ‘‘আইনে বিপর্যস্ত বা আটক শিশুদের পরিচয় এবং ছবি প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, তা মানছে না সংবাদমাধ্যম৷ ফলে কোনো ‘অপরাধে' আটক শিশুর ছবি প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যম তাকে ‘অপরাধী' হিসবে সমাজের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার সংশোধন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে৷''

আপনিও কি কিছু বলতে চান? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ