কয়েক দশক ধরে জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ ‘মাসুদ রানা’র অধিকাংশ বইয়ের লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন নয়, শেখ আবদুল হাকিম৷ কপিরাইট অফিসের এই ঘোষণার পর দুই পক্ষই আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ শেষ পর্যন্ত কার হবে মাসুদ রানা?
ছবি: Partho Sanjoy
বিজ্ঞাপন
রবিবার কপিরাইট অফিস এক আদেশে বলেছে, মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি এবং কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক স্বত্ব শেখ আবদুল হাকিমের৷ এতদিন পাঠকরা জানতেন, মাসুদ রানা সিরিজের সব বইয়ের লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন আর তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সেবা প্রকাশনী৷ তাই এই খবরে পাঠকরাও ধাক্কা খেয়েছেন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া৷
কিন্তু কাজী আনোয়ার হোসেন কপিরাইট অফিসের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আদেশের মূল কপি হাতে পেলেই আপিল করবো৷ আমি পক্ষপাতের শিকার৷’’
কিন্তু শেখ আবদুল হাকিম এখন তার ওই সব বইয়ের বিপরীতে পাওনা টাকা চান আর তা যদি না দেয়া হয় তাহলে তিনিও আদালতে যাবেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যদি সমঝোতা হয়, তাহলে আর মামলার প্রয়োজন হবে না৷ আমি তো আমার প্রাপ্য টাকার জন্য আইনের আশ্রয় নিতেই পারি৷’’
কপিরাইট অফিসের মূল কথা হলো, লেখকস্বত্ব কখনোই বিক্রয় বা ক্রয়যোগ্য নয়৷ কেউ ব্যবসার স্বত্ব কিনতে পারেন, প্রকাশনাস্বত্ব কিনতে পারেন, কিন্তু লেখকস্বত্ব নয়৷ একজনের লেখা আরেকজনের নামে ছাপা বা প্রকাশ বেআইনি৷ একজনের মেধাস্বত্ব আরেকজনের হতে পারে না৷ ফলে মাসুদ রানা সিরিজ নিয়ে কপিরাইট আইনের ৭১ এবং ৮৯ ধারা লঙ্ঘন হয়েছে৷
আমি পক্ষপাতের শিকার: কাজী আনোয়ার হোসেন
This browser does not support the audio element.
কপিরাইট রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী বলেছেন, ‘‘কপিরাইট আইনে এর সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে৷ কিন্তু কপিরাইট অফিসের কারাদণ্ড দেয়ার ক্ষমতা নেই৷ এই শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রচলিত আদালতে যেতে হবে৷ ক্ষতিপূরণের মামলাও হতে পারে৷ আর শেখ আব্দুল হাকিমকে এই রায়ের ভিত্তিতে প্রতিটি বইয়ের আলাদা করে কপিরাইট নিবন্ধন করতে হবে৷’’
এ পর্যন্ত মাসুদ রানা সিরিজের ৪৬৭টি বই প্রকাশিত হয়েছে৷ কাজী আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি ১৯৬৫ সালে প্রথম মাসুদ রানা লেখা শুরু করেন৷ তিনি নিজে সরাসরি ২০টির মতো বই লিখেছেন৷ তবে পরপর নয়, বিভিন্ন সময়ে৷ বাকি বইগুলো লেখক প্যাানেল দিয়ে লিখিয়েছেন৷ তার কথা, ‘‘মাসুদ রানা চরিত্রটি আমার সৃষ্টি৷ বিদেশি বই বাছাই করেছি আমি৷ এরপর লেখকদের আমার গল্পের পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলেছি৷ তারা লিখে আনার পর আমার পছন্দ হলে কিনে নিয়েছি৷ টাকা দিয়ে দিয়েছি৷ তারপর সেটা আবার সম্পাদনা করে ছাপার উপযোগী করেছি৷ সিরিজের লেখকও আমি৷ আমার সিরিজে তো অন্য কেউ লেখক হতে পারে না৷’’
কিন্তু একজনের লেখা কি আরেকজনের নামে ছাপা যায়? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মাসুদ রানা তো এডাপটেশন৷ এটার মূল লেখা আমার না, আমাদের লেখক প্যানেলেরও না৷ আরেকজন যদি কপি রাইট পায়, তাহলে আমি বাদ যাবো কেন? যারা আমার আদীষ্ট হয়ে লিখেছেন তারা লেখকস্বত্ব কেন পাবেন?’’
কপিরাইট আদালতের আদেশে বলা হয়েছে, মাসুদ রানার ১১টি বইয়ের পরের ২৬০টি বইয়ের লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন নয়, শেখ আবদুল হাকিম৷ শেখ আবদুল হাকিম স্বশিক্ষিত৷ তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বলে তিনি জানান৷ তিনি ১৯৬৬ সাল থেকে লেখা শুরু করেন৷ তখন তার বয়স ছিল ১৮ বছর৷
তিনি বলেন, ‘‘যখন লেখা শুরু করি, তখন আমি কপিরাইট বিষয়টি বুঝতাম না৷ আইন জানতাম না৷ আর আমার টাকার প্রয়োজন ছিল, তাই টাকা পেয়েছি, লিখেছি৷ তিনি যা বুঝিয়েছেন তাই বুঝেছি৷ পরে তিনি রয়্যালিটিও দিয়েছেন৷ কিন্তু যা প্রাপ্য তা দেননি৷ তাই এখন প্রতিকার চেয়েছি৷’’
যখন লেখা শুরু করি, তখন আমি কপিরাইট বিষয়টি বুঝতাম না: শেখ আবদুল হাকিম
This browser does not support the audio element.
তিনি লেখক না ডিকটেশন নিতেন জানতে চাইলে বলেন, ‘‘আমিই লিখেছি৷ তার পক্ষে মাসে কিভাবে ১৮-১৯ টি বই ডিকটেশন দেয়া সম্ভব?’’
লেখক প্যানেলে আরো কয়েকজন ছিলেন৷ আবদুল হাকিম ২০০০ সালের পর সেবা প্রকাশনী ছেড়ে দেন৷ গত বছরের ২৯ জুলাই তিনি কপিরাইট অফিসে অভিযোগ করেন৷ কপিরাইটঅফিসের আদেশের বিরুদ্ধে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে কপিরাইট বোর্ডে আপিল করা যাবে৷ বোর্ডের আদেশের বিরুদ্ধে ৯০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করা যাবে৷ কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘‘আমি শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে যাবো৷ কপিরাইট অফিস আমার যুক্তি শোনেনি৷ উচ্চ আদালতে আমার যুক্তি তুলে ধরবো৷’’
আর শেখ আবদুল হাকিম বলেন, ‘‘আইনি লড়াই বা সমঝোতা দুইটির জন্যই আমি প্রস্তুত আছি৷’’
কপিরাইট অফিস পরবর্তী আপিল বোর্ড বা কোনো আদালতের আদেশের আগ পর্যন্ত বইগুলো প্রকাশ ও বাণিজ্যিক কাজ বন্ধ রাখতে বলেছে৷ আগামী ৩০ দিনের মধ্যে ওই বইগুলোর সংস্করণ, বিক্রিত কপির সংখ্যা এবং আর্থিক বিবরণী দাখিলেরও নির্দেশ দিয়েছে কপিরাইট অফিস৷
গতবছরের ৩১ জানুয়ারির ছবিঘরটি দেখুন...
সেবা প্রকাশনীর জানা-অজানা
মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দার মতো জনপ্রিয় সিরিজের প্রকাশক সেবা প্রকাশনী৷ কম দামে রোমাঞ্চে ভরপুর কাহিনি পড়িয়ে কিশোর-কিশোরীদের পাঠক হিসেবে গড়ে তুলেছেন সেবার প্রতিষ্ঠাতা কাজী আনোয়ার হোসেন৷
ছবি: Partho Sanjoy
৫৫ বছর!
১৯৬৪ সালে ঢাকার তৎকালীন সেগুনবাগানে (বর্তমানে সেগুনবাগিচা) সেবা প্রকাশনীর যাত্রা শুরু৷ বাবা শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা নিয়ে প্রকাশনা ব্যবসায় নেমেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন৷ ‘সেগুন’-এর ‘সে’ আর ‘বাগান’এর ‘বা’ থেকে সেবা নামটি এসেছে৷ এই ৫৫ বছরে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ২,৪৪৭টি বই প্রকাশিত হয়েছে৷
ছবি: Partho Sanjoy
প্রথম বই
১৯৬৪ সালের জুনে ‘কুয়াশা-১’ বইটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে সেবা প্রকাশনী ও থ্রিলার লেখক হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনের যাত্রা শুরু হয়৷ এই বইটিসহ কুয়াশা সিরিজের সত্তরটির বেশি বই বের হয়েছে৷
ছবি: Partho Sanjoy
মাসুদ রানা
১৯৬৬ সালে ‘ধ্বংস পাহাড়’ নামে মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই বের হয়৷ কাপ্তাই বাঁধ রক্ষা নিয়ে বইটির কাহিনি গড়ে উঠেছিল৷ ঐ বাঁধ রক্ষার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট মাসুদ রানা৷ ছবিতে সেবা প্রকাশনীর অফিস দেখতে পাচ্ছেন৷
ছবি: Partho Sanjoy
আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী
ছবিতে মাসুদ রানা সিরিজের সবশেষ প্রকাশিত বইটি দেখতে পাচ্ছেন৷ নাম ‘অন্তর্যামী’৷ এটি এই সিরিজের ৪৫৯তম বই৷ কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে সহযোগী লেখক হিসেবে ছিলেন ইসমাইল আরমান৷ অর্থাৎ, আজও বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী থ্রিলার নায়ক হয়ে আছেন মাসুদ রানা৷
ছবি: Partho Sanjoy
তিন গোয়েন্দা
ছোটবেলায় কিশোর পাশার মতো হতে চাননি এমন ক’জন আছেন? ১৯৮৫ সালে তিন গোয়েন্দা সিরিজের প্রথম বই বের হয়৷ এরপর কিশোর পাঠকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সিরিজের তিন কিশোর গোয়েন্দা– কিশোর পাশা, মুসা আমান ও রবিন মিলফোর্ড৷ শুরুতে বিখ্যাত ইংরেজি গোয়েন্দা সিরিজ ‘দ্যা থ্রি ইনভেস্টিগেটর্স’ অবলম্বনে বইগুলো লেখা হতো৷ লেখক ছিলেন রকিব হাসান৷ ছবিতে সেবা প্রকাশনীর প্রিন্টিং প্রেস দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Partho Sanjoy
অন্যান্য বই
কুয়াশা, মাসুদ রানা এবং তিন গোয়েন্দা ছাড়াও সেবা প্রকাশনী থেকে বিভিন্ন সময়ে বের হওয়া অন্যান্য সিরিজের মধ্যে আছে অয়ন-জিমি সিরিজ, কিশোর হরর সিরিজ, গোয়েন্দা রাজু সিরিজ, রোমহর্ষক সিরিজ, অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ, অনুবাদ সিরিজ, কিশোর ক্লাসিক সিরিজ, রোমান্টিক সিরিজ, ওয়েস্টার্ন সিরিজ ও আত্মউন্নয়ন সিরিজ৷
ছবি: Partho Sanjoy
পাঠকের কথা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে চাকরিতে যোগ দেয়া তানিয়া ইদ্রিস ১৯৯৮ সালে প্রথম তিন গোয়েন্দা পড়েছিলেন৷ রকিব হাসান যতদিন তিন গোয়েন্দা লিখেছেন ততদিন তিনি তাঁর পাঠক ছিলেন৷ এখন ওয়েস্টার্ন আর অনুবাদের পাঁড় ভক্ত তিনি৷ তানিয়া মনে করেন, সেবার অনুবাদ এখনো সেরা৷ অবশ্য তাঁর ছোট ভাই এখন আর সেবা পড়ে না বলে জানান তিনি৷ তাই নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে সেবাকে নতুন সময়ের চাহিদাকে মাথায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তানিয়া৷
ছবি: Partho Sanjoy
জনপ্রিয়তার কারণ
ওয়েস্টার্ন সিরিজের লেখক রওশন জামিল (ছবি) সেবার জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, লেখকরা সবসময় পাঠকের কথা বিবেচনা করেছে৷ ‘‘পুরো বিষয়টাই ছিল পাঠকমুখী৷ আমরা নিজেরাও যেহেতু পাঠক ছিলাম, ঐ বয়সটা পার হয়ে এসেছি, আমরা কী পছন্দ করতাম, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে লিখতাম,’’ বলেন তিনি৷ এছাড়া পাঠকদের পরামর্শও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো বলে জানান রওশন জামিল৷
ছবি: Partho Sanjoy
এখনো জনপ্রিয়?
২৪ বছর ধরে সেবায় কাজ করছেন মমিনুল ইসলাম৷ তিনি বর্তমানে সেবা প্রকাশনীর ম্যানেজার৷ তিনি বলছেন, পাঠকের কাছে সেবার বইয়ের চাহিদা কমেনি৷ ‘‘এখনো প্রতিমাসে ২৫ হাজার কপির মতো রহস্যপত্রিকা বের হয়৷ মাসুদ রানার জনপ্রিয়তাও সমান রয়েছে,’’ বলে জানান তিনি৷ অবশ্য মানসম্মত বই প্রকাশ করতে গিয়ে বইয়ের সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলেও জানান মমিনুল ইসলাম৷
ছবি: Partho Sanjoy
পেছনের কারিগর
বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের পাঠক হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে সেবা প্রকাশনীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে৷ আর সেবা প্রকাশনী মানেই কাজী আনোয়ার হোসেন৷ মাসুদ রানা চরিত্র সৃষ্টি ছাড়াও তিন গোয়েন্দা, অনুবাদ, কিশোর ক্লাসিক ও আত্মউন্নয়ন সিরিজের বইয়ের লেখক তিনি৷ এছাড়া তাঁর সম্পাদনায় এখনো নিয়মিত রহস্যপত্রিকা প্রকাশিত হয়ে আসছে৷ কাজী আনোয়ার হোসেন ছাড়াও বিদ্যুৎ মিত্র ও শামসুদ্দীন নওয়াব নাম ব্যবহার করে থাকেন তিনি৷
ছবি: Sudeepto Salam/Prothom Alo
সমালোচনা
মাসুদ রানা সিরিজের অনেক গল্প বিদেশি লেখকদের বই থেকে নেয়া৷ তাই বইয়ের উপর সাধারণত ‘বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে’ কথাগুলো লেখা থাকে৷ তবে অনেকের অভিযোগ, এভাবে লিখিত হলেও সব বইয়ে এ কথাগুলো লেখা থাকে না৷