কুটির শিল্পের সংজ্ঞা কী? এই প্রশ্ন নিয়ে কথা হচ্ছিল সহকর্মীদের সঙ্গে৷ উত্তর নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে খানিকটা বেগ পেতে হয়েছে৷ তবে কুটির শিল্পের আধুনিক রূপ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই৷
বিজ্ঞাপন
ছোটবেলায় মাকে দেখলাম একবার ব্যাপক উৎসাহে নাইলন সুতা দিয়ে হাতে বোনা ব্যাগ তৈরি করতে৷ তিনি এবং তাঁর কয়েক বান্ধবী মিলে কিছুদিন ব্যাগ বানালেন৷ দোকানে তা বিক্রিও হয়েছে বালো দামে৷
মা অবশ্য শখের ব্যাগ বানানোয় ইতি দিয়েছেন অল্পতেই৷ তবে কুটির শিল্প সম্পর্কে আমি কিছুটা ধারণা পেয়েছিলেন তখন৷ ঘরে বসে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে কয়েকজন মিলে কিছু তৈরি করাকে কুটির শিল্প বলা যেতে পারে৷ ঢাকা এবং মফঃস্বলে বাড়ির বাড়তি ঘরে গড়ে ওঠা ছোট ছোট হাতে বোনা কাপড়ের দোকান কিংবা ছোট রেস্তোরাঁ যেখানে নির্দিষ্ট কিছু খাবার মেলে – সবই তো কুটিরশিল্পের মধ্যেই পড়ে৷
কুটিরশিল্পের বিস্তৃতি অনেক৷ ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোর হিসেবে কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আট লাখের বেশি৷ কয়েকদিন আগে জেনেছিলাম, যশোরের নারীদের তৈরি পাখির বাসা বিক্রি হয় ইউরোপের বিভিন্ন দোকানে৷ আর সেটা চলছে গত কয়েকদশক ধরে৷ আশা জাগানিয়া খবর৷ এরকম রপ্তানি যত বাড়বে দেশের জন্য ততই উপকার৷ বিশেষ করে জার্মানিতে দেখেছি, মানুষ হাতে তৈরি বিভিন্ন ঘর সাজানোর জিনিস চড়া দামে কেনে৷ ছোট ছোট নকশা করা ফুলদানি, মোমদানি বা ছবির ফ্রেম এখানে বিক্রি হয় যা অনায়াসেই বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা যেতে পারে৷
কুটিরশিল্পের আরো একটি রূপ এখন দেখি ইন্টারনেটের কল্যাণে৷ আমার ছোট ভাই ভাষান্তরের কাজ করে অবসর সময়ে৷ সে এবং তার আরো কয়েকবন্ধুকে সেই কাজ এনে দেন এক ‘বড় ভাই'৷ উদ্যোগের পরিধি ছোট, কিন্তু সেকাজে দিব্যি পকেট খরচ উঠে যায়৷ আউটসোর্সিংয়ের এমন উদাহরণ অনেক৷ বাংলাদেশে কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেল এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যেগুলোর পেছনে থাকে ছোট ছোট দল৷ বিনিয়োগও কম৷ অথচ অনেক মানুষ তা দেখছে, আর দেখা যত বেশি হয় আয়ও সেহারে বাড়ে৷ আর ঘরে বসে গ্রাফিক ডিজাইন, ওয়েবসাইট তৈরি কিংবা প্রোগ্রামিংয়ের মতো কাজ তরুণ প্রজন্ম করছে বহুদিন ধরেই৷ এগুলো কি কুটিরশিল্পের আধুনিক সংস্করণ নয়?
আমার সহকর্মীরা কুটিরশিল্পের যে সংজ্ঞায় একমত হয়েছেন, তাতে এগুলো অবশ্যই কুটিরশিল্প৷ আর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত সেই সংজ্ঞাটি হচ্ছে: ‘‘পাঁচ লাখ টাকার কম বিনিয়োগ হবে এবং পারিবারিক সদস্যের সমন্বয়ে সদস্যসংখ্যা অনধিক ১০ জন হবে, এমন প্রতিষ্ঠানই কুটিরশিল্প হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবে৷''
নোয়াপাড়ার জামদানি শিল্প
ঢাকা থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জ৷ আর সেখানে রূপগঞ্জের নোয়াপাড়া এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী তীরে ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি তৈরি হচ্ছে বহুকাল ধরে৷
ছবি: DW/M. Mamun
যেভাবে এলো জামদানি
জনশ্রুতি আছে অতীতে সোনারগাঁও সংলগ্ন এ এলাকার মানুষরা বিশ্বখ্যাত মসলিনের কারিগর ছিলেন৷ ইংরেজরা এ শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়ার পর, এ সব এলাকার মানুষেরা ফিরে যান কৃষি পেশায়৷ ইংরেজদের শাসনের অবসানের পর মসলিন শিল্পীদের বংশধররা আবারও শুরু করেন মসলিন তৈরি৷ কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হন৷ মসলিনের আদলেই তাঁরা তৈরি করেন নতুন এক কাপড়, যা পরিচিত পায় জামদানি হিসেবে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঘরে ঘরে জামদানি
নারায়ণগঞ্জে মূল জামদানিপল্লি আসলে বিসিক শিল্প এলাকায়৷ তবে এর বাইরেও নোয়াপাড়ার বাড়িতে বাড়িতে আছে বেশ কিছু জামদানির কারখানা৷ সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি এ সব কারখানায় চলে জামদানি তৈরির কাজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
জামদানি শিল্পী
একেকটি জামদানি কারখানায় চার থেকে ২৪ জন পর্যন্ত শ্রমিক কাজ করেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
যত শাড়ি তত মজুরি
জামদানি কারখানাগুলোর সার্বক্ষণিক দেখভাল করেন মহাজন৷ বেশিরভাগ জামদানি শ্রমিক মজুরি পান শাড়ি প্রতি চুক্তি হিসেবে৷
ছবি: DW/M. Mamun
শিশুশ্রম
সাধারণত একটি শাড়ি তৈরি করতে দু’জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়৷ একজন কারিগর ও অন্যজন তাঁর সাহায্যকারী৷ সাহায্যকারীর ভূমিকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিশুরাদের৷
ছবি: DW/M. Mamun
৮০ হাজার টাকা মজুরি
একটি জামদানি শাড়ি তৈরিতে ন্যূনতম তিন দিন সময় লাগে৷ নকশা আর কারুকাজভেদে কোনো কোনো শাড়িতে তিন মাসও লেগে যায়৷ একটি শাড়ি তৈরি করে দু’জন শ্রমিক দুই হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি পান৷
ছবি: DW/M. Mamun
নারীদের দক্ষতা
জামদানি তৈরিতে নারিরাও বেশ দক্ষ৷ বেশিরভাগ কারখানাতেই নারী শ্রমিকের উপস্থিতি দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
পরিবারের সবাই মিলে..
বিভিন্ন মহাজনী কারখানা ছাড়াও বিসিক শিল্প নগরী ও এর আশপাশের এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে দু-একটি করে তাঁত আছে৷ পরিবারের সবাই মিলে এ সব তাঁতে জামদানি তৈরি করেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
তাঁত চালু থাকে সারাক্ষণ
জামদানি পল্লীর তাঁতগুলো সপ্তাহের সাত দিনই সকাল থেকে রাত অবধি চালু থাকে৷ তবে শুক্রবার বাজারের দিন এ পল্লীতে কাজ কম হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
প্রাচীন জামদানি হাট
সারা সপ্তাহের বোনা জামদানি নিয়ে মহাজন ও কারিগররা জড়ো হন শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরের প্রাচীন জামদানি হাটে৷ প্রতি শুক্রবার সকাল সাতটা থেকে নয়টার মধ্যেই হাটের কেনাবেচা শেষ হয়ে যায়৷ এ হাটে সাধারণত সারা দেশের পাইকাররাই আসেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
শিল্পনগরীতেও হাট
জামদানি শিল্পীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন বিসিক জামদানি শিল্পনগরীতেও একটি হাট স্থাপন করে দিয়েছে৷ এ হাটটিও প্রতি শুক্রবার একই সময়ে বসে, তবে দুই ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিক্রয়কেন্দ্র
জামদানি হাট ছাড়াও নোয়াপাড়ার বিসিক জামদানি শিল্পনগরীতে আছে বেশ কিছু ছোট বড় বিক্রয় কেন্দ্র৷ এ সব দোকান থেকেও পাইকারি ও খুচরা মূল্যে জামদানি বিক্রি হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
ইউনেস্কোর স্বীকৃতি
বয়নের অতুলনীয় পদ্ধতি আর শিল্পমানের কারণে জামদানি ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেইজ’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
হরেক রূপে জামদানি
জামদানি বলতে সবাই সাধারণত শাড়ি বুঝলেও বর্তমান সময়ে জামদানি দিয়ে পাঞ্জাবি, সালোয়ার কামিজ এমন কি সোফার কভার, কুশন কভার, ঘরের পর্দা ইত্যাদিও তৈরি হচ্ছে৷