1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কুটির শিল্পে অনিয়ন্ত্রিত বিপ্লব!

হারুন উর রশীদ স্বপন  ঢাকা
৯ জানুয়ারি ২০১৭

বাংলাদেশে কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ্য করা গেলেও সমন্বিত প্রয়াসের অভাবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে না৷ অপরিকল্পিত কুটির শিল্পের প্রবৃদ্ধি তাই কার্যকর প্রবৃদ্ধি হিসেবে বিবেচনায় আসছে না৷

ক্ষুদ্র কুটির শিল্প
ক্ষুদ্র কুটির শিল্পছবি: DW/M. Mamun

কুটির শিল্প করছেন এমন অনেকেই জানেন না যে এর নিবন্ধনের প্রয়োজন আছে৷ আবার অনেকে নিবন্ধনের বিষয়টি বুঝলেও কোথা থেকে নিবন্ধন নিতে হয়, তা জানেন না৷ ফলে কেউ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর আর কেউবা স্থানীয়ভাবে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করেন৷ এর ফলে উদ্যোক্তারা যেমন নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) ও তেমনি জানেনা তাদের সর্ম্পকে৷

২০১৪ সালে ‘বিসিক অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ: একটি সমীক্ষা' শিরোনামে বিসিকের একটি প্রকাশনায় তাদের সর্বশেষ অবস্থা জানা যায়৷ সেখানে বলা হয়েছে ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছাড়াও বিসিকের চারটি আঞ্চলিক কার্যালয়, ৬৪টি জেলা কার্যালয়, ৫৯ জেলায় ৭৪টি শিল্প নগরী, ১৫টি নৈপুণ্য বিকাশ কেন্দ্র এবং তিনটি পার্বত্য জেলার ২২টি উপজেলায় ৩২টি উৎপাদন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে৷

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ২০১১ সালের এক জরিপে বলা হয়, সারাদেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা আট লাখ ৩০ হাজার৷ আর বিসিকের নিজস্ব পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প রয়েছে এক লাখ৷ এর মানে হলো, বিদ্যমান কুটির শিল্পের সিংহভাগই বিসিক-এ নিবন্ধিত নয়৷ জরিপ অনুযায়ী, যেসব কুটির শিল্প নিবন্ধন নিয়েছে তার মাত্র ৩.৭ শতাংশ বিসিকে নিবন্ধিত৷ তবে সারাদেশে যে কুটির শিল্প রয়েছে তার ৬৫ ভাগেরই কোনো নিবন্ধন নেই বলে দাবি করছে বিবিএস৷ নানা কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধিত কুটির শিল্প শতকরা ৩৫ ভাগ মাত্র৷

Mirza Nurul Gani Saoan - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

১৯৫৭ সালে প্রথম বিসিক-এর কার্যক্রম শুরু হয়৷ ১৯৬০ সালের দিকে বিসিক ঋণ দেয়ার পাশাপাশি শিল্পনগরী স্থাপনের কাজে হাত দেয়৷ বিসিক দাবি করছে, জিডিপিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের অবদান ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ৫.২৭ ভাগ৷ আর সেবা খাতে ১০ শতাংশের বেশি৷ সরকার এই খাত থেকে ২০১৩-১৪ সালে ২,৪৯৯ কোটি ৭৮ টাকা আয়কর পেয়েছে৷

২০১৪ সাল পর্যন্ত বিসিক শিল্পনগরীতে ১৮,৮৯৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে৷ কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ লাখ ২৫ হাজার ১৪১ জনের৷

তবে বিসিকই বলছে যে, তারা তাদের উদ্দেশ্য বা টার্গেটে পৌঁছাতে পারছে না৷ অনেক ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এখন রুগ্ন হয়ে পড়েছে৷ আর বিসিক শিল্প নগরীতে কোনো কোনো উদ্যোক্তা একাধিক প্লট নিয়ে ভারি শিল্প গড়ে তুলেছেন, যা বিসিকের নীতিমালাবিরোধী৷

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি (নাসিব)-এর সভাপতি মির্জা নুরুল গনি শাওন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আসলে এখন আর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিসিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই৷ আর কুটির শিল্প করলে যে বিসিকের অনুমোদন নিতে হবে তা বাধ্যতামূলক নয়৷ এই অনুমোদনের প্রক্রিয়াও অনেক জটিল৷ তাই অনেক উদ্যোক্তা আগ্রহ দেখান না৷''

তিনি বলেন, ‘‘তবে যাঁরা কুটির শিল্প করছেন তারা আইন কানুন মেনেই করছেন৷ তাঁরা ট্রেড লাইসেন্স এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অনুমোদন নিচ্ছেন৷ ব্যাংক লোন, উৎপাদিত পন্য বাজারজাত ও রপ্তানি করার জন্য বিসিকের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না৷ আর এখন এসএমই ফাউন্ডেশনসহ আরো অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে প্রনোদনা দিচ্ছে৷ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে৷ তাই তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী৷ কুটির শিল্পের সংজ্ঞা নিয়ে জটিলতা আছে৷ তাদের প্রচার নেই৷ বিনিয়োগকারীদের যুক্ত করার কোনো ধারবাহিক প্রক্রিয়াও নেই৷''

সাধারণভাবে ১০ জনের কম শ্রমিক নিয়ে গঠিত শিল্পগুলো কুটিরশিল্পের আওতায় পড়ে৷ আর জমি ও ভবন বাদ দিয়ে এসব শিল্পের পুঁজি সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা৷ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখন আর এভাবে কুটির শিল্প হয় না৷

এখন অনেকে মিলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় দিয়েও কুটির শিল্প গড়ে তুলছেন৷  বগুড়া সদরের শশীবদনী আত্মকর্মসংস্থান ফাউন্ডেশন মোট তিনটি কুটির শিল্প পরিচালনা করে৷ প্যাকেজিং, পোশাক এবং হ্যান্ডিক্র্যাফ্টস৷ এই ফাউন্ডেশনের সদস্য সংখ্যা সাড়ে তিনশ'৷ তাঁরা নিজেরা কাজ করেন আবার নিজেরাই মালিক৷ নিজেদের সঞ্চয় ও ব্যাংক ঋণ দিয়ে তাঁরা এই তিনটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন৷ প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক আশরাফুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা নিজেরাই এই কুটির শিল্প গড়ে তুলেছি৷ ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই কাজ করছি৷ আমরা ঠিক জানিনা বিসিকের অনুমোদন নিতে হবে কিনা৷ তবে কাজ করার জন্য ব্যাংক লোন পেতে ট্রেড লাইসেন্সই যথেষ্ট৷''

Asraful Islam - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

তবে তিনি মনে করেন, ‘‘শিল্পের ক্যাটাগরি অনুযায়ী, কোনো শিল্প কোথায় নিবন্ধন করতে হবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন৷ এতে সবাই লাভবান হবে৷''

তিনি আরো জানান, ‘‘বগুড়াসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচুর কুটির শিল্প আছে৷ সাধারণ মানুষ তাঁদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যবহার করে নানা ধরণের অপ্রচলিত পন্য উৎপাদনের ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠা করছেন৷ তাঁরা হয়তো বিসিকের নামও জানেন না৷'' ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় পড়ে এমন প্রতিষ্ঠানকে বিসিকের অনুমোদন নেয়ার কথা বলা আছে৷ কিন্তু অনুমোদন না নিলে কী হবে, তা বলা নেই৷ বিবিএস-এর জরিপে দেখা গেছে, বিসিকের কাছ থেকে নিবন্ধন নিতে হয় এমন ৯১.৮ শতাংশ উদ্যোক্তাই নিবন্ধন নিয়েছের স্থানীয় সরকারে কাছ থেকে৷ আর এটা হলো পৌরসভা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের দেয়া ট্রেড লাইসেন্স৷

বিসিকের  কুটির শিল্পের মধ্যে রয়েছে খাদ্যপণ্য, পানীয়, বস্ত্র ও ক্ষুদ্র পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, কাঠ ও আসবাব, কাগজ থেকে উৎপাদিত পণ্য, তামাকজাত পণ্য, মুদ্রণ, রাসায়নিক ও রাসায়নিক পণ্য, রাবার ও প্লাস্টিক পণ্য, মৌলিক মেটাল ও নন-মেটালিক মিনারেল পণ্য, ইলেকট্রনিক্স ও চশমা, ইলেকট্রিক্যাল সরঞ্জাম, পরিবহন সরঞ্জাম, হস্তশিল্প, মেরামত কারখানা, মৌমাছি পালন, লবণ শিল্প প্রভৃতি৷ আর এ সব শিল্পের ৫৬.৩ ভাগ পল্লী অঞ্চলে অবস্থিত৷

বিসিক-এর তথ্য মতে, বিসিক শিল্প নগরীতে ৮৬৫টি রপ্তানিমুখী শিল্প ইউনিট আছে৷ আর এসব কারাখানায় উৎপাদিত পণ্যেও  ৫০ ভাগ রপ্তানি হয়৷ ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে বিসিকের রপ্তানি পণ্যের মূল্য ২০ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা৷ এটা জাতীয় রপ্তানি আয়ের ৯.৬৭ শতাংশ৷

বিবিএসের জরিপ বলছে, সবচেয়ে বেশি কুটিরশিল্প ঢাকা বিভাগে- দুই লাখ ৫০ হাজার ১১২টি৷ আর সিলেট বিভাগে কুটিরশিল্পের সংখ্যা সবচেয়ে কম, মাত্র ২৭ হাজার ৭৯১টি৷

Mustak Hasam Muhammad Iftekhar - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

রাজশাহী বিভাগে এক লাখ ৩০ হাজার ১৩৩টি, খুলনা বিভাগে এক লাখ ২২ হাজার ৮৭, চট্টগ্রাম বিভাগে এক লাখ ১৫ হাজার ৯৬৮, রংপুর বিভাগে ৮২ হাজার ৭৪৪ এবং বরিশাল বিভাগে ৫১ হাজার ৪৭০টি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ এ সব প্রতিষ্ঠানে ২৯ লাখ ৬৩ হাজার লোক কাজ করছেন৷

তবে সিলেট বিভাগে কুটিরশিল্প কম হলেও সিলেটে নিবন্ধনের হার বেশি৷ শতকরা ৪৫ ভাগ৷ রংপুরে নিবন্ধিত কুটির শিল্পের সংখ্যা সবচেয়ে কম৷ শতকরা ২০ ভাগ৷

তবে নাসিব সভাপতি বিবিএস-এর এই অনিবন্ধনের তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘সরকারের কোনো না কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব নয়৷ ট্রেড লাইসেন্সও একটা নিবন্ধন৷ আর সেই ট্রেড লাইসেন্স বিবেচনা করলে নিবন্ধনের সংখ্যা অনেক বেশি৷ আর কুটির শিল্প স্থাপনের আগেই তো নিবন্ধন সম্ভব নয়৷ এটা বাস্তব সম্মতও নয়৷ অনেক প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের আগে প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে৷''

বিসিক-এর চেয়ারম্যান মুশতাক হাসান মুহাম্মদ ইফতিখার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা ঠিক যে দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বড় একটি অংশ বিসিকে নিবিন্ধিত নয়৷ আর এই নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়৷ কেউ চাইলে বিসিকের শর্ত পূরণ করে এখানকার ঋণ এবং প্রশিক্ষণের সুবিধা নিতে পারেন৷ তবে আমরা প্রতিবছরই তথ্য ফর্মের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের তথ্য সংগ্রহ করি৷ আমরা সার্চ করে তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনছি৷ আমরা এই তথ্য দিয়ে কুটির শিল্পের সার্বিক চিত্র এবং পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করি৷ কোথায় সহায়তা প্রয়োজন, কোন ধরনের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে তা ঠিক করি৷''

তিনি জানান, ‘‘বিসিকের কাজ ঋণ, প্রশিক্ষণ, প্রণোদনার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটানো৷ আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বাড়ানো৷ তবে এই লক্ষ্য অর্জনে বিসিক এখনো পিছিয়ে আছে৷ বিসিকের শিল্প প্লটের অপব্যবহার আছে৷ আবার অনেক বরাদ্দকৃত প্লট পড়ে আছে৷ আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বিসিকের লোকবলের অভাব৷''

বিসিকের অনুমোদন ছাড়া ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প গড়ে ওঠাকে তিনি নেতিবাচকভাবে না দেখে বরং কোনো না কোনোভাবে তাদের হিসাবের আওতায় আনার পক্ষে৷ তাঁর মতে, বাংলাদেশে প্রচুর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে ওঠার পিছনে বিসিকেরই অবদান বেশি৷

বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুটির শিল্পে বছরে ৩৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার পণ্য উৎপন্ন হয়৷ মূল্য সংযোজিত হয় ৩১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার, যা জিডিপি বা দেশজ উৎপাদনে যোগ হয়৷ আর বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৭ লাখ কর্মক্ষম লোক যোগ হয়৷ বিসিক চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘তাই কুটির শিল্পের একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং বা সমন্বয় প্রয়োজন৷ সেটা সম্ভব হলে এই খাতে উন্নয়ন আরো বেশি হবে৷ আর বড় একটি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর এ খাতে কর্মসংস্থান হতে পারে৷''

আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ