1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কুড়িগ্রামে ধর্ষণ-আত্মহত্যা, যা বলছেন স্থানীয়রা

সমীর কুমার দে ঢাকা
২ জুন ২০২৪

কুড়িগ্রামে গৃহবধূকে দীর্ঘদিন ধরে ধর্ষণের অভিযোগ। অভিযোগ, এরপরই বিষপান করে মারা গিয়েছেন নির্যাতিতা। শনিবার দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার হন। স্থানীয় ইউপি সদস্য, সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ওসির সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে।

নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রতীকী ছবি
ঋণের টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় এক গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধেছবি: spukkato/imago images

ঋণ নেয়া ২০ হাজার টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় এক গৃহবধূকে দুই মাস ধরে চার ব্যক্তি দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগউঠেছে। এরপর দ্বারে দ্বারে ঘুরে বিচার না পেয়ে নির্যাতিতা গৃহবধূ ও তার স্বামী দুজনে বিষপান করতে বাধ্য হন। ঘটনার পর স্বামী বেঁচে গেলেও মারা যান স্ত্রী। এই দম্পতির তিন বছরের একটি শিশুসন্তান রয়েছে। বিষয়টি ধামাপাচা দেওয়ার চেষ্টা হলেও মিডিয়ায় খবরটি প্রকাশিত হওয়ার কারণে তৎপর হয়েছে পুলিশ। মামলাটিও রেকর্ড হয়েছে। শনিবার প্রধান অভিযুক্তসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঘটনাটি ঘটেছে কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুর উপজেলার একটি গ্রামে।

গত বুধবার ওই গৃহবধূ মারা যান। বিষয়টি মিডিয়ার কাছে আসার পরশুক্রবার গভীর রাতে গৃহবধূর মামা বাদি হয়ে চার জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। অভিযুক্ত চার জন হলেন, একই উপজেলার জহির মণ্ডলপাড়া গ্রামের জয়নাল আবেদীন (৪৮), কারিগরপাড়ার শুক্কুর আলী (৫০), একই গ্রামের আলম হোসেন (৪০) ও টাঙ্গালিয়াপাড়ার মো. সোলাইমান (২৯)। এরা সবাই পেশায় কসাই। বাজারে তাদের মংসের দোকান আছে। এর মধ্যে জয়নাল ও আলমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। অন্য দু'জন পলাতক।

বিষপানের আগে গত ২২ মে ওই গৃহবধূ (২৩) স্থানীয় একজন সাংবাদিকের কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলেছিলেন। ওই সাংবাদিক তার বক্তব্য অডিও হিসেবে রেকর্ডও করেছিলেন। সেই অডিও ডয়চে ভেলের হাতে এসেছে। সেখানে গৃহবধূ বলছিলেন, ''স্বামী দিনমজুরির কাজের জন্য টাঙ্গাইলে থাকেন। কয়েক মাস আগে জয়নাল আমাদের বাড়িতে এসে বলেন, আমার কাছে তো টাকা থাকে তোমরা প্রয়োজন হলে ধার নিতে পারো। আবার হাতে টাকা এলে ফিরিয়ে দিও। অভাবের কারণে আমরা তার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলাম। এর মধ্যে ২০ হাজার টাকা ফিরিয়ে দিয়েছি। বাকি ২০ হাজার টাকা সময়মতো দিতে পারছিলাম না।''

গৃহবধূ অভিযোগ করেছিলেন, ওই টাকার জন্য জয়নাল চাপ দিয়ে আসছিলেন। টাকা পরিশোধ করতে না পারায় জয়নাল গত রোজার প্রথম দিন শারীরিক সম্পর্কের কুপ্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, তাকে প্রথমে হেনস্থা করা হয়। পরে ঘরে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। নির্যাতিতা অভিযোগ করেছিলেন, ''সে প্রায়ই এসে টাকা চাইত। টাকা দিতে না পারলে শারীরিক অত্যাচার করত। একদিন সে শুক্কুরকে সঙ্গে নিয়ে আসে। নিজে শারীরিক অত্যাচার করার পর শুক্কুরও ধর্ষণ করে। এভাবে আলম ও সোলেমানকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন।''

গৃহবধূর অভিযোগ ছিল সোলেমান নামে এক ব্যক্তি একদিন মোবাইলে জয়নালের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও নেন। তাকে ওই ব্যক্তি শারীরিকভাবে নির্যাতন না করলেও সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়েছিল। এরপর দিনের পর দিন তারা চারজন ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তাদের অত্যাচারে শারীরিকভাবে তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে স্বামী বাড়িতে ফিরলে তাকে নির্যাতনের বিষয়টি জানান।

নির্যাতিতা গৃহবধূর স্বামী (২৭) ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একদিন টাঙ্গাইল থেকে বাড়িতে ফিরে আমি দেখি স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। জিজ্ঞাসা করলে এক পর্যায়ে জানায় জয়নাল, শুক্কুর, আলম ও সোলেমান তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করছে। ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তারা এই কাজ করেছে। বিষয়টি জানার পর আমি গ্রামের মুরুব্বির কাছে গেলাম। তিনি সালিশ করে সমাধান করবেন বলে জানান। গত ২৩ মে আমান মামা অভিযুক্ত ৪ জনকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন। তখন তাদের সঙ্গে রাজীবপুর থানার কনস্টেবল রবিউল ইসলাম ও ড্রাইভার আমেজ উদ্দিনও ছিলেন। যদিও কনস্টেবল ও থানার ড্রাইভার কোনো কথা বলেনি। তারা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। এক পর্যায়ে সেই মুরুব্বি ২০ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে আমাদের সঙ্গে অভিযুক্তদের হাত মিলিয়ে দেন। তখন আমি বলেছি, আমার স্ত্রীর সম্মান গেছে, এর মূল্য কি ২০ হাজার টাকা? আমি সালিশ মানিনি, বলেছি, যথাযথ বিচার চাই।”

গৃহবধূর স্বামী বলছিলেন, "বিচার যখন পেলাম না, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বেঁচে থেকে আর লাভ কী? তাই আমরা দু'জনে মিলে একসঙ্গে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। ২৪ মে বিকেলে আমরা বিষপান করি। এরপর তো আর কিছু মনে নেই। পরে তিনটি হাসপাতাল ঘুরে গত বুধবার আমার স্ত্রী মারাই গেল। ওইদিন স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন আমাদের বাড়িতে আসেন। তখন আমার শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। তিনি আমাকে বলেন, সবাই বলছে, লাশের পোস্টমর্টেমের দরকার নেই। আমরা দাফন করে ফেলি। পরে যদি ঝামেলা হয়, এ কারণে তিনি আমাদের একটা স্ট্যাম্প দেন। সেখানে লেখা হয়েছিল, সবার সম্মতিতে পোস্টমর্টেম ছাড়াই লাশ দাফন হয়েছে। সেই স্ট্যাম্পে আমরা তিন ভাই স্বাক্ষর করেছি। যদিও পরে সাংবাদিকেরা চলে আসায় পুলিশ এসে লাশ পোস্টমর্টেমে নিয়ে যায়। ফলে ওই স্ট্যাম্পের তো এখন আর দাম নেই।”

কেন স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিলেন? জানতে চাইলে স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আগের কোনো ঘটনা তো আমরা কিছুই জানি না। আমরা শুধু জেনেছি, অভাবের কারণে তারা দু'জনে বিষপানের আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, তার মধ্যে গৃহবধূ মারা গেছেন। ফলে শুধু বিষপানের কারণে সবাই মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরে যখন জানলাম, তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তখন তো আমরা আর এর মধ্যে নেই।”

এতকিছু ঘটে গেল, কিছু জানতেন কি? জানতে চাইলে চর রাজীবপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিরন মোহাম্মদ ইলিয়াস ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার কাছে কেউ কিছুই বলেনি। আমি কিছুই জানতাম না। বিষয়গুলো জানতে ইউপি সদস্যকে ফোন করেছিলাম, তিনিও আমার ফোন ধরেননি। পরে আমি ইউএনওকে অবহিত করি।”

গৃহবধূর ও তার স্বামী আপন মামাতো, ফুফাতো ভাই বোন। ফলে তাদের দু'জনের মামা মামলার বাদি। ডয়চে ভেলেকে সেই আত্মীয় বলেন, "ওরা বিষপান করার পর আমি বিষয়টি জানতে পারি। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাদের প্রথমে রাজীবপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে জামালপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকেরা তাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালের খরচের টাকা না থাকায় অসুস্থ অবস্থায় তাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে হয়। এরপর তো বুধবার ভাগ্নি মারা যায়।”

'ঘটনা জানার পরই ব্যবস্থা নিয়েছি'

This browser does not support the audio element.

আপনাকে মামলা করতে কে বলেছে? জবাবে সেই আত্মীয় বলেন, "ভাগ্নের শরীরের অবস্থা ভালো না। পুলিশও একজনকে খুঁজছিল। তখন ভাগ্নে আমাকে বলল মামলার বাদি হওয়ার জন্য। সে কারণে আমি মামলা করেছি।”

ধর্ষণের ঘটনায় কোনো সালিশে কি কনস্টেবল রবিউল ইসলাম থাকতে পারেন? বিষয়টি কী তিনি আপনাকে বলেছেন? জানতে চাইলে চর রাজীবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আশিকুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিষয়টি জানার পর আমি রবিউলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছেন, বাজার করে ফেলার পথে তিনি শুধু উঁকি দিয়ে দেখেছেন যে, সালিশি হচ্ছে। কিন্তু কী বিষয়ে হচ্ছে তা তিনি জানেন না। রবিউল যেহেতু থানার মেসের বাজার করে, এই কারণে কসাই জয়নালের সঙ্গে তার আগেই পরিচয় ছিল। তার অনুরোধেই তিনি বাজার থেকে ফেরার পথে শুধু উঁকি দিয়ে দেখে এসেছেন।”

বিষয়টি জানতে আপনাদের এত দেরি হল কেন? জবাবে তিনি বলেন, "আমরা যখনই জেনেছি, তখনই ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরাই তো তাদের ডেকে মামলা করেছি। আজকে সকালেই অভিযান চালিয়ে দুই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করি। অন্যদের গ্রেপ্তার অভিযান চলছে।

মামলাটির তদন্ত শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ