কুণালের মানভঞ্জনে উদ্যোগ তৃণমূলের
৪ মে ২০২৪তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল বরাবরই বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক৷ তিনি দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও কখনোসখনো সরব হন৷ তেমনই একটি পর্ব দেখা গেল গত তিন-চারদিন ধরে৷
কুণালের ক্ষোভ
গত পয়লা মে উত্তর কলকাতায় একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল৷ সেই অনুষ্ঠানে এক মঞ্চে দেখা যায় উত্তর কলকাতার বিজেপি প্রার্থী, সদ্য তৃণমূলত্যাগী তাপস রায় ও কুণাল ঘোষকে৷ মঞ্চ থেকে তাপস সম্পর্কে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেন তৃণমূলের মুখপাত্র৷ এখানেই বিতর্কে সূত্রপাত৷
উত্তর কলকাতা কেন্দ্রে তৃণমূলের লড়াই এবার বেশ কঠিন৷ প্রবীণ বিদায়ী সাংসদ, ঘাসফুলের প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই এক সময়ের সতীর্থ তাপসের বিরুদ্ধে৷ বামেদের সমর্থনে লড়াইয়ে রয়েছেন সাবেক প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য৷ এই পরিস্থিতিতে দলের মুখপাত্রের বিজেপি প্রার্থীর সঙ্গে একই মঞ্চে উপস্থিতি ভালোভাবে নেয়নি তৃণমূল৷
গত বুধবার কুণালকে রাজ্য সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়৷ দলের কেন্দ্রীয় নেতা ডেরেক ও ব্রায়ানের স্বাক্ষরিত প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, কুণালের মতামত তার ব্যক্তিগত৷ এটা দলের বক্তব্য নয়৷ এই বিবৃতি জারি হওয়ার পর দলের নেতাদের সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করেন কুণাল৷
কুণালকে কড়া বার্তা দিতে বৃহস্পতিবার তারকা প্রচারকের তালিকা থেকে তাকে বাদ দেয় তৃণমূল৷ তারকা প্রচারকের চতুর্থ তালিকাতেও সাবেক সংসদ কুণালের নাম ছিল৷ কিন্তু তিনি মুখ খোলার পর পঞ্চম তালিকায় তার নাম বাদ পড়ে৷
দলের এই সিদ্ধান্তে আরো ক্ষোভ জানান কুণাল৷ তিনি বলেন, ‘তারকা প্রচার মধ্যে কেউ বিরোধী দলনেতার শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করতে পারেন না৷ দেব জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন৷ দেব না হলে তিনি কেন দলবিরোধী?'
সমর্থকদের পাশে নিয়ে কুণাল জানান, ‘‘কর্মীদের আবেগকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু চাটুকারদের নিয়ে দল চলছে৷ ভবিষ্যতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এটা বুঝতে পারবেন৷ আমি পদে নয়, পথে আছি৷''
বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন কুণালের অবস্থান তৃণমূলকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়৷ বিরোধী নেতারাও কার্যত কুণালের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন৷ তার সম্পর্কে সহানুভূতি দেখান৷
সাবেক বিচারপতি ও বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মানুষটিকে যত খারাপ বলে প্রচার করা হয়, তিনি তত খারাপ নন৷ সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটা অনুষ্ঠান ছিল, রক্তদান শিবির৷ সেখানে তাপস রায় ও কুণাল ঘোষকে এক মঞ্চে দেখা গিয়েছে বলে, পদ থেকে সরিয়ে দেয়া একেবারে অগণতান্ত্রিক ব্যাপার৷’’
কুণালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিরোধীরা আঙুল তোলেন তৃণমূল নেতৃত্বের দিকে৷ বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘এটা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার একটা বড় উদাহরণ৷ স্থানীয় নেতা হিসেবে কুণাল ঘোষকে রক্তদান শিবিরে ডাকা হয়েছিল৷ সেখানে তিনি বর্ষীয়ান নেতা তাপস রায়ের প্রশংসা করেছেন৷ তৃণমূল প্রার্থী দেব বালুরঘাটে গিয়ে আমার প্রশংসা করেছিলেন৷ তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে নাকি?''
যার সম্পর্কে প্রশংসার জন্য কুণালের বিরুদ্ধে তৃণমূল ব্যবস্থা নেয়, সেই তাপস রায় বলেন, ‘‘এবার কি বিয়ে বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে গেলে তৃণমূলের নেতারা আমন্ত্রিতের তালিকা দেখে যাবেন! কুণাল যখন জেলে ছিল, তখন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকার কথা ও ভোলেনি৷ শুধু সুদীপকে আড়াল করতে গিয়ে উত্তর কলকাতায় তৃণমূল পার্টিটাকে তুলেই দিল৷''
কুণালের পাশে থাকার বার্তা দেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী৷ তিনি বলেন, ‘‘কুণাল ঘোষকে তার দৃঢ় অবস্থানের জন্য ধন্যবাদ জানাই৷ সত্যি কথাটা এতদিন বলেননি, এখন বলতে থাকুন৷ আমাদের দলে আসতে হবে না৷ কিন্তু যদি সত্যি কথা বলেন, তাহলে আমরা মানসিক ও নৈতিকভাবে আপনার পাশে থাকব৷
কুণালের মানভঞ্জন
কুণালকে নিয়ে বিরোধীরা যখন এত উৎসাহী, তখন ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়েন তৃণমূলের শীর্ষ নেতারা৷
বিধায়ক ও মন্ত্রী ব্রাত্য বসু আজ দুপুরে কুণাল ঘোষকে নিয়ে যান ডেরেক ও' ব্রায়ানের ঠিকানায়৷ একসময়ের বিখ্যাত কুইজমাস্টার ডেরেককে একদিন আগেই কুণাল পোস্টমাস্টার বলে কটাক্ষ করেছেন৷ দক্ষিণ কলকাতার বেকবাগানে ডেরেকের আস্তানায় ঘন্টাখানেক বৈঠক করেন তিন তৃণমূল নেতা৷
বৈঠক থেকে বেরিয়ে একটি গান গেয়ে কুণাল বুঝিয়ে দেন, ‘অভিমান ভেঙেছে'! তিনি বলেন, ‘‘আমি দলের অনুগত সৈনিক৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার নেত্রী৷ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার সেনাপতি৷’’
ব্রাত্য বলেন, ‘‘তিন তৃণমূলের নেতা এক জায়গায় হয়েছিলেন ভোটের কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে৷ আমাকে প্রচারের জন্য জেলায় যেতে হবে৷ সে ব্যাপারে নির্দেশ পেয়েছি৷’’
সম্প্রতি এই ধরনের নাটকীয় একটি পর্ব উত্তর কলকাতার রাজনীতি ঘিরেই দেখা গিয়েছিল৷ কেন্দ্রে ছিলেন কুণাল৷ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ এনেছিলেন তিনি৷ যদিও তারপরেই তাকে দেখা যায় সুদীপ ও তার স্ত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে চায়ের আসরে৷ বিস্ফোরক কথাবার্তাও আর শোনা যায়নি৷ এবারও অনেকটা সেই আদলেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা গেল৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কুণাল ঘোষ আগেও দলের বিরুদ্ধে বলেছেন৷ এখন বেফাঁস কিছু বলে ফেললে তৃণমূলের সমস্যা হত৷ এই সময় যখন নির্বাচন চলছে৷ তাই দ্রুত তার ক্ষোভ দূর করতে নেতৃত্ব তৎপর হয়েছেন৷’’