এমনকি গবেষণা কেন্দ্রগুলোকে পাততাড়ি গুটিয়ে অন্যত্র যেতে হচ্ছে, যদি না তাদের কোনো আইসবার্গের ওপরে চড়ে ভেসে যেতে হয়! ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে কুমেরুর জলবায়ু৷
বিজ্ঞাপন
ভঙ্গুর হয়ে চলেছে কুমেরুর জলবায়ু
04:00
ব্রিটিশ গবেষণা কেন্দ্র হ্যালি সিক্স-কে অন্যত্র সরে যেতে হবে, কেননা, কেন্দ্রটি যে বরফের ওপর, তা ভেঙে যেতে পারে৷ ট্রাক্টর আর বুলডোজার দিয়ে কয়েক টন ওজনের মডিউলটিকে ডাঙার দিকে ২৩ কিলোমিটার টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷
হ্যালি সিক্স একটি ভাসমান বরফের পাতের ওপর দাঁড়িয়ে, পরিভাষায় যার নাম ‘ব্রান্ট শেল্ফ আইস’৷ এই বরফের পাতে অনেক ফাটল দেখা দিয়েছে৷ ফাটল আরো বাড়লে বরফের একটা বড় অংশ ভেঙে হিমশৈল হয়ে সাগরে ভেসে যেতে পারে৷
ভাসন্ত বরফের উপর গবেষণা কেন্দ্র
হেল্মহলৎস সেন্টার ফর পোলার অ্যান্ড মেরিন রিসার্চের আলফ্রেড ভেগেনার ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ব্যার্নহার্ড ডিকমান বলেন, ‘‘এই ফাটলটার উপর স্বভাবতই গবেষণা কেন্দ্রের ভাগ্য নির্ভর করছে৷ কেন্দ্রটির অবস্থান এমন যে, হিমশৈল যখন সাগরে ভেসে যাবে, তখন গবেষণা কেন্দ্রটি ঠিক সেই হিমশৈলের ওপর থাকবে৷’’
জার্মান কুমেরু গবেষণা কেন্দ্র নয়মায়ার-৩ অন্য একটি শেল্ফ আইসের পাতের উপর খাড়া৷ তবে এই গবেষণা কেন্দ্রটি আরো ছোট ও অনেক বেশি স্থিতিশীল৷ এখানে বরফ ভাঙলে গবেষণা কেন্দ্রটি ডাঙার দিকে থাকবে৷
বিশ্বের প্রথম স্থানান্তরযোগ্য গবেষণাগার
অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত ‘হ্যালি সিক্স’ নামের এই গবেষণাগারটি এমনভাবে তৈরি যেন প্রয়োজন হলে খুব সহজেই তাকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া যায়৷ ‘ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভে’-এর গবেষণাগার এটি৷
ছবি: British Antarctic Survey
বিশ্বে প্রথম
২০১৩ সালে অ্যান্টার্কটিকায় যখন ‘হ্যালি সিক্স’-এর উদ্বোধন হয় তখন সেটe বিশ্বের প্রথম ‘রিলোকেটেবল’ বা স্থানান্তরযোগ্য গবেষণাগার হিসেবে স্বীকৃতি পায়৷ প্রায় ২৬ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে নির্মিত গবেষণাগারটি অ্যান্টার্কটিকার যে কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব৷
ছবি: British Antarctic Survey
আছে স্কি লাগানো পা
খেয়াল করে দেখুন গবেষণাগারটিতে আটটি আলাদা অংশ একটি আরেকটির সঙ্গে জোড়া লেগে আছে৷ প্রতিটি অংশের চারটি করে হাইড্রোলিক পা আছে৷ এসব পায়ের নীচে আছে বিশেষ স্কি, যার সাহায্যে প্রতিটি অংশকে সহজে ঠেলে এদিক-সেদিক নেয়া যায়৷
ছবি: British Antarctic Survey
ইতিমধ্যে স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে
যে বিশাল ফাটলটি দেখতে পাচ্ছেন সে কারণে হ্যালি সিক্সকে একবার তার আগের জায়গা থেকে সরিয়ে আনতে হয়েছে৷ ‘ব্রান্ট আইস সেলফ’ নামে অ্যান্টার্কটিকার যে অংশে গবেষণাগারটি আছে সেখানে এই ফাটল দেখা দিয়েছে৷
ছবি: British Antarctic Survey
আরও একটি কারণে প্রথম
হ্যালি সিক্সই প্রথম গবেষণাগার যেটি ওজন স্তরে বিভিন্ন ছিদ্র থাকার খবর দিয়েছে৷ এছাড়া মহাকাশের আবহাওয়া, ওজন ডিপ্লেশন, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন সেখানকার বিশেষজ্ঞরা৷
দুই নম্বর ছবিতে হ্যালি সিক্সের মাঝখানে বড় লাল রঙের যে অংশটি দেখেছেন এই ছবিতে সেটিই আলাদাভাবে দেখতে পাচ্ছেন৷ এখানে গবেষক সহ অন্যরা আড্ডার জন্য জমায়েত হন৷ গ্রীষ্মকালে ৭০ আর শীতের সময় ১৬ জন থাকেন গবেষণাগারে৷
ছবি: British Antarctic Survey
আলোর নাচন
হ্যালি সিক্স এমন জায়গায় অবস্থিত যেখানে বছরের ১০৫ দিন ২৪ ঘণ্টাই আঁধার থাকে৷ চরম আবহাওয়ার কারণে মাঝেমধ্যেই বাকি বিশ্বের সঙ্গে সেখানকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ তবে সেখানে শুধু যে খারাপ সময়ই যায় তা নয়৷ প্রায়ই সেখানকার বাসিন্দারা রাতের বেলায় আকাশে আলোর নাচন ‘অরোরা অস্ট্রালিস’ দেখতে পান৷
ছবি: British Antarctic Survey
6 ছবি1 | 6
কুমেরুর মাঝখান থেকেও বরফের ঢাল চলেছে উপকূলের দিকে৷ কত তাড়াতাড়ি এই বরফ সাগরে পৌঁছাবে, তা নির্ভর করবে উপকূলের শেল্ফ আইসের পাতগুলির ঘনত্ব ও অবস্থার উপর, কেননা, এই শেল্ফ আইস হিমবাহগুলির ব্রেক হিসেবে কাজ করে৷
প্রফেসর ডিকমান জানালেন, ‘‘কিন্তু বেশি বরফ ভেঙে গেলে পাতটা স্থিতিহীন হয়ে পড়বে, ভারসাম্য হারাবে৷ তার ফলে পিছনে হিমবাহের বরফ সোজা সাগরে গিয়ে পড়তে পারে৷ সাগরের পানির উচ্চতার জন্য একটি আইস শেল্ফ ভাঙলে ক্ষতি নেই, কেননা, বরফ জলে ভাসে৷ কাজেই বরফের পাত ভাঙলে সাগরের পানি বাড়বে না৷ কিন্তু মেরুপ্রদেশের ভিতর থেকে যে বরফ আসছে, তার ফলে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়বে বৈকি৷’’
বরফের পাত
কাছের একাধিক বরফের পাত ইতিমধ্যেই ভেঙে গেছে৷ ২০০২ সালের পরিস্থিতি শীঘ্র আবার দেখা দিতে পারে বলে গবেষকদের আশঙ্কা৷ সে বছর মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে লার্সেন-বি নামের শেল্ফ আইসের পাতটি ছোট ছোট আইসবার্গ, অর্থাৎ হিমশৈলে ভেঙে যায়৷ ২,৬০০ বর্গকিলোমিটার বরফ সাগরে মিশে যায়৷
যে কুমেরু উপদ্বীপের উপর এই বরফের পাতগুলো অবস্থিত, সেই এলাকাটি বিশেষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত৷ কিন্তু আরো শীতল এলাকাগুলিতেও বরফ গলছে৷ এর মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তন বলে অনেক গবেষকের ধারণা৷ জলবায়ু পরিবর্তন দু'ভাবে মেরুপ্রদেশের বরফের ক্ষতি করছে৷ কুমেরুর পশ্চিমাঞ্চলে উষ্ণ জলের স্রোত তলা থেকে বরফ গলাচ্ছে৷ শেল্ফ আইসের বরফের পাতগুলোর উপরের বরফ গরম বাতাসে গলে জলের কুণ্ড তৈরি হচ্ছে৷
জলের কুণ্ড
প্রফেসর ডিকমান জানালেন, ‘‘এই জলের কুণ্ডগুলো আবার শীতকালে জমে যায়৷ কিন্তু সেই নতুন বরফের প্রকৃতি হয় হিমবাহের বরফ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা৷ এই বরফ হয় কিছুটা নরম৷ প্রতিবছর গরমে বরফ গলে কুণ্ডি তৈরি হওয়া চলে বছরের পর বছর৷ তার ফলে বরফ ঝুরঝুরে হয়ে পড়ে৷’’
ব্রিটিশ গবেষণা কেন্দ্রটি আগামী মার্চ মাস থেকে আট মাস বন্ধ থাকবে, কেননা, কুমেরুর শীতে কোনো ত্রাণ অভিযান পাঠানো সম্ভব নয়৷ আর এখানকার বরফ আগামীতে কি করবে বা না করবে, তা বলা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়৷
কর্নেলিয়া বর্মান/এসি
হিমবাহের কান্না
বরফে ছাওয়া অ্যান্টার্কটিকা থেকে প্রতি বছর ১৬ হাজার কোটি টন বরফ গলে যাচ্ছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে বরফ গলার হার চার বছর আগের তুলনায় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে, যাতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর বাড়তে পারে আধা মিলিমিটার করে৷
ছবি: AP
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন
বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে মহাসাগরগুলোর উষ্ণ স্রোত এসে পৌঁছাচ্ছে অ্যান্টার্কটিকায়৷ এর সংস্পর্শে এসে গলে যাচ্ছে পশ্চিম, পূর্ব এবং অ্যান্টার্কটিকা উপদ্বীপের গ্লেসিয়ার বা হিমবাহগুলো৷ বরফ গলার এই হার ক্রমশ দ্রুততর হচ্ছে৷
ছবি: ESA/dpa
গলছে বরফ
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশকে ঢেকে রাখা বরফের স্তর কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে – তার ওপর বিজ্ঞানীরা নজর রাখছেন ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের মহাকাশযান ক্রাইয়োস্যাটের মাধ্যমে৷ ক্রাইয়োস্যাটের পাঠানো ছবি পরীক্ষা করে তাঁরা বলছেন, সেখানে বরফ স্তরের উচ্চতা প্রতিবছর গড়ে দুই সেন্টিমিটার করে কমছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/NASA
যাবে না থামানো!
‘জিওগ্রাফিক্যাল রিসার্চ লেটার’ জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যান্টার্কটিকার ছয়টি হিমবাহ যেভাবে গলে যাচ্ছে তা আর থামানো সম্ভব নয়৷ বরফের এই নদীগুলো হয়ত কয়েকশ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিমজ্জন
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা জানিয়েছিলেন, ১৯৫০ থেকে এখন পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকায় যে পরিমাণ বরফ রয়েছে তার সব যদি গলে যায়, তাহলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ১১ ফুট বেড়ে যাবে৷
ছবি: NASA's Goddard Space Flight Center
বিপদ উত্তরেও
উত্তর মেরুর সাগরে বরফের পরিমাণ ২০১২ সালের অক্টোবরের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়লেও ১৯৮০ সালের তুলনায় বরফের পরিমাণ এখন প্রায় অর্ধেক৷ যুক্তরাজ্যের গবেষকরা বলছেন, ১৯৮০ সালের অক্টোবরে উত্তর মেরুর সাগরে বরফের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ঘন কিলোমিটার৷ সেখানে গতবছর বরফ পাওয়া গেছে মাত্র নয় হাজার ঘন কিলোমিটার এলাকায়৷
ছবি: picture alliance/ZB
ইতিহাসের সাক্ষী
অস্ট্রিয়ার আল্পসে পাস্টেয়ার্সে হিমবাহ গলে যাওয়ার হার সাম্প্রতিক সময়ে নাটকীয় হারে বাড়ছে৷ ফলে হিমবাহে বরফের উচ্চতা বছরে প্রায় ৫০ ফুট করে কমছে৷ ১৯৬৮ সালে হিমবাহটি কোন উচ্চতায় বইতো – তা দেখানো হয়েছে ২০০৬ সালে তোলা এই ছবিতে৷
ছবি: picture-alliance/OKAPIA
প্রকৃতির প্রতিশোধ
মানুষ্যসৃষ্ট দূষণেই বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু৷ এর প্রভাব কতটা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে – তা এক প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেখিয়েছেন ব্রাজিলের শিল্পী নেলে আজেভেদো৷ ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের সহযোগিতায় ২০০৯ সালে জার্মানির বার্লিনে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়৷