অনেক তর্ক-বিতর্কের পর জার্মানি ইরাকের উত্তরে কুর্দি পেশমারগা বাহিনীর জন্য অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভবিষ্যতে স্বাধীন কুর্দিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না৷
বিজ্ঞাপন
চরমপন্থি ইসলামি আইসিস (ইসলামিক স্টেট বা আইএস) জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কুর্দিদের সাহায্য করতে জার্মানি শেষ পর্যন্ত সামরিক সাহায্যের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ সাহায্যের তালিকায় রয়েছে ট্যাংক বিধ্বংসী ‘মিলান' রকেট, মেশিন গান, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি৷ জঙ্গিরা ইরাকি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে যে সব ট্যাংক দখল করেছে, তাদের মোকাবিলা করতেই এমন রকেট প্রয়োজন৷ প্রায় ৪,০০০ কুর্দি যোদ্ধার জন্য প্রায় ৭ কোটি ইউরো মূল্যের এই অস্ত্র পাঠানো হবে৷
সম্ভবত দুই সপ্তাহের মধ্যেই প্রথম কিস্তির অস্ত্রশস্ত্র বাগদাদের মাধ্যমে এরবিল শহরে পাঠানো হবে৷ বাকিটা নির্ভর করবে পরিস্থিতির উপর৷ সেইসঙ্গে থাকবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও৷ বিশেষ করে ক্ষেপণাস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিতে কিছু কুর্দি প্রশিক্ষককে জার্মানিতে এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে৷ সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই সামরিক সহায়তার জন্য জার্মান সংসদের নিম্নকক্ষ বুন্ডেসটাগ-এর সম্মতির প্রয়োজন পড়বে না৷ মহাজোট সরকারের দুই শরিক অবশ্য সহজেই সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যেত৷ সংসদের দুই বিরোধী দল সরকারের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে৷ তবে সংখ্যায় তারা নগণ্য৷
জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী উর্সুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন বলেন, আইসিস জঙ্গিরা নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে তাদের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে৷ মানবিক দিক থেকে তো বটেই, জার্মানির নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে সহায়তা করতে হচ্ছে৷ জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাংক ভাল্টার স্টাইনমায়ার বলেন, জার্মান সরকারের জন্য এই সিদ্ধান্ত মোটেই সহজ ছিল না৷ কিন্তু আইসিস জঙ্গিদের তৎপরতা শুধু অভাবনীয় মাত্রার মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে না, ইরাকের উত্তরাঞ্চলের অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে উঠছে৷ সে দেশের দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের কারণে ঐক্য ও অখণ্ডতাও হুমকির মুখে পড়েছে৷ স্টাইনমায়ার এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেন, জার্মানি গত কয়েক সপ্তাহে ইরাকের উত্তরে ১৭০ টন ত্রাণসাহায্যও পাঠিয়েছে৷
ইরাকে জিহাদিবিরোধী যুদ্ধ
চরমপন্থি ইসলামি সংগঠন আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে ইরাকে৷ সন্ত্রাসবাদী এ সংগঠনটির সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও তৎপরতা রয়েছে৷ দেখুন ইরাকে আইএস-বিরোধী যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কিছু ছবি৷
ছবি: Reuters
টিকরিট পুনরুদ্ধারের চেষ্টা
সুন্নিদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইসিস) উত্তর ও দক্ষিণ ইরাকের কিছু অংশ দখল করে নিয়েছে৷ বাগদাদ থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরের শহর টিকরিটও এখন তাদের দখলে৷ সে এলাকায় ইরাক সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য আইসিস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে সেনাবাহিনী৷
ছবি: Reuters
মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব চায় আইসিস
আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে আইসিস-এর একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ ২০০৬ থেকে ২০০৭-এর দিকে ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তখনই আইসিস-এর জন্ম৷ সংগঠনটির লক্ষ্য সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং জর্ডান মিলিয়ে বেশ বড় একটা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা৷ ইরাকে নুসরা ফ্রন্টসহ বেশ কিছু সংগঠন তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
বিদ্রোহীদের পাশে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ আর ইরাকে নুরি আল মালিকির সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যপন্থি এবং মৌলবাদী সংগঠনের কর্মী রয়েছে৷ সিরিয়ায় ন্যাশনাল কোয়ালিশনের মতো কিছু মধ্যপন্থি সংগঠনকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা বিদ্রোহীদের একাংশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছেন৷
ছবি: Reuters
ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি জানিয়েছেন, কংগ্রেস বিদ্রোহীদের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব অনুমোদন করলে তা সিরিয়া এবং ইরাকে দেয়া হবে৷ এই বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা, ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বড় একটা অংশ যে আইসিস-এর কাছে যাবেনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই৷
ছবি: Reuters
কুর্দিরা চায় স্বাধীন কুর্দিস্তান
যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি সুন্নি এবং কুর্দিদের অংশিদারিত্বের সরকার গঠন করুন৷ ইরাকের কিছু অংশে কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন রয়েছে৷ কুর্দিরা ‘পেশমেরগা’, অর্থাৎ কুর্দিদের স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়ছে৷ কুর্দিদের মূল লক্ষ্য ইরাকে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: Reuters
ইরানের ভূমিকা
ইরাকে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের মধ্যে জড়াতে চায়না ইরান৷ কিন্তু শিয়া প্রধান দেশ ইরানের সরকার ইরাকের মালিকি সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে বলে ধারণা করা হয়৷ নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইসিস-বিরোধী যুদ্ধে মালিকি সরকারকে ড্রোন এবং অন্যান্য সমর উপকরণ দিয়ে সহায়তা করছে ইরান সরকার৷
ছবি: Atta Kanare/AFP/Getty Images
এক হাজারেরও বেশি নিহত
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব৷ ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি মনে করেন, আইসিসকেও মদদ দিচ্ছে সৌদি সরকার৷ ইরাকে চলমান সংঘাতে কমপক্ষে এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ জন্য ইরাক সরকার এবং আইসিস-এর কঠোর সমালোচনা করেছে৷
ছবি: Reuters
বাড়ছে শরণার্থী
আইসিসের হামলা শুরুর পর থেকে ইরাকের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ১২ লাখ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷ সিরিয়া সংকট শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আড়াই লাখ সিরীয় স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে৷ এখন আইসিসের দখল করে নেয়া শহরগুলো থেকে পালিয়ে ইরাকিরাও আসছে৷ ছবিতে খাজাইর চেকপয়েন্ট অতিক্রম করে কুর্দিদের নিয়ন্ত্রিত শহর এরবিলের দিকে যেতে দেখা যাচ্ছে মসুল থেকে আসা ইরাকিদের৷
ছবি: Getty Images
স্বেচ্ছাসেবীরাও নেমেছে যুদ্ধে
প্রধানমন্ত্রী মালিকি জানিয়েছেন, রাশিয়া আর বেলারুশের কাছ থেকে পুরোনো যুদ্ধ বিমান কিনেছে ইরাক৷ আইসিসের বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ বাড়ছে সমরাস্ত্র৷ বাড়ছে যোদ্ধা৷ স্বেচ্ছাসেবীরাও যোগ দিচ্ছেন আইসিস বিরোধী যুদ্ধে৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
আইসিস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জার্মান হাতিয়ার ব্যবহারের এই পরিকল্পনা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই৷ শেষ পর্যন্ত এই অস্ত্র কার হাতে গিয়ে পড়বে, কী ভাবে তার প্রয়োগ করা হবে, সে বিষয়ে অনেকের মনে সন্দেহ রয়েছে৷
শুধু অস্ত্রের অপব্যবহার নয়, কুর্দিরা ইরাকের উত্তরে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করলেও গোটা অঞ্চলের জন্য বিপদের আশঙ্কা করছেন স্টাইনমায়ার৷ এর জের ধরে ইরাকে আরও বিভাজন ঘটতে পারে বলে তিনি মনে করেন৷ তখন সীমানা নিয়ে নতুন করে সংকট ও সংঘাত দেখা দিতে পারে৷ একবার সীমানা নিয়ে এমন প্রশ্ন উঠলে তার আগুন গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে স্টাইনমায়ার আশঙ্কা করছেন৷