সোমবার ইরাকি কুর্দিস্তানে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের ফলে তুরস্ক, ইরান ও সিরিয়াসহ অনেক দেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ বৃহত্তর কুর্দিস্তান আন্দোলনের আশঙ্কায় নতুন করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
ইরাকের উত্তরে কুর্দিস্তান এলাকা সেই সাদ্দাম হুসেনের আমল থেকেই স্বায়ত্তশাসনে অভ্যস্ত৷ এবার পাকাপাকিভাবে স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র ঘোষণা করতে চায় কুর্দি নেতৃত্ব৷ সেই লক্ষ্যে গণভোটে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীন কুর্দিস্তানের পক্ষে রায় দেবেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ তবে এই গণভোট কার্যকর করার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই৷
ইরাকে কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের প্রধান মাসুদ বারজানি এই গণভোটকে হাতিয়ার করে ইরাকের সরকারের সঙ্গে স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করবেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ বারজানি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, গণভোটে ইতিবাচক রায় পেলে বাগদাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই তিনি সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার চেষ্টা করবেন৷
কুর্দি এলাকার এক টেলিভিশন চ্যানেলের সূত্র অনুযায়ী প্রায় ৭৮ শতাংশ ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন৷ কুর্দিস্তানের বাইরে ইরাকের উত্তরে কিছু অংশেও এই গণভোট আয়োজন করা হয়েছে৷ আইএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের কারণে সেসব এলাকা আপাতত কুর্দি বাহিনীর দখলে৷ কুর্দিদের একটা বড় অংশ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিলেও আরব ও তুর্কমেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এমন পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে৷ স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেবার জন্য তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে৷ সোমবার ভোট গ্রহণের সম্ভবত ৭২ ঘণ্টা পর ফলাফল জানা যাবে৷
এই গণভোটকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক স্তরেও বিপুল তৎপরতা দেখা যাচ্ছে৷ কারণ, ইরাকি কুর্দিস্তান সত্যি স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলে ইরান, তুরস্ক ও সিরিয়াসহ প্রতিবেশী দেশগুলিতে ছড়িয়ে থাকা কুর্দি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিও একে একে সেই রাষ্ট্রে যোগ দিতে পারে৷ তাই তুরস্কসহ একাধিক দেশ এই গণভোটের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে৷ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান কুর্দিস্তান থেকে বহির্জগতে পেট্রোলিয়াম সরবরাহের পাইপলাইন বন্ধ করে দেবার হুমকি দিয়েছেন৷ এমনকি ইরাকি কুর্দিস্তানে সামরিক হামলার হুমকিও দিয়েছেন তিনি৷
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-আবাদি কুর্দিস্তান অঞ্চলের গণভোটকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছাড়াই এই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ তাই ইরাকি সরকার ও আন্তর্জাতিক সমাজসহ কেউই তার ফলাফল মেনে নেবে না৷ এদিকে ইরাকি সেনাবাহিনী তুরস্কের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সীমান্তে বড় আকারের মহড়া শুরু করেছে৷
ইরান ও সিরিয়াও এই গণভোটের তুমুল সমালোচনা করেছে৷ ইরান ইরাকি কুর্দিস্তানের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে৷ যৌথ সীমান্তও বন্ধ করে দিয়েছে সে দেশের কর্তৃপক্ষ৷ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ার প্রশাসনও এই গণভোটের ফলাফল মেনে নেবে না বলে জানিয়েছে৷
মার্কিন প্রশাসনও ইরাকি কুর্দিস্তানে গণভোটের বিরোধিতা করেছে৷ ইরাকের ঐক্য ও অখণ্ডতা বজায় রেখে আইএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামকেই বেশি গুরুত্ব দিতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন৷
যুদ্ধে নারী, নারী যোদ্ধা
২০১৪ সালের গ্রীষ্মে ইসলামিক স্টেট উত্তর ইরাকের ইয়াজিদি এলাকাগুলি দখল করে৷ হাজার হাজার ইয়াজিদি মহিলা ও কিশোরীকে ধরে নিয়ে গিয়ে দাসী হিসেবে রাখা হয় ও ধর্ষণ করা হয়৷ আজ সেই ইয়াজিদি নারীরাই সন্ত্রাসবাদিদের বিরুদ্ধে লড়ছেন৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
শত্রুর খোঁজ
শত্রু বাইরে কোথাও - কুর্দি নারী যোদ্ধা হাসেবা নৌজাদ ইরাকের মোসুল শহরের কাছে চোখে দুরবিন লাগিয়ে ‘ফ্রন্ট লাইন’ পরখ করে দেখছেন৷ কুর্দ এলাকা ও আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্যে সীমারেখা হলো এই ফ্রন্ট৷ কুর্দিরা ইরাকি সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় ক্রমেই আরো এগিয়ে যাচ্ছে, পিছু হটছে ইসলামিক স্টেট৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
গুপ্তপ্রতিরোধের ভ্যানগার্ড
শত্রু নজরে পড়েছে, এবার তাদের দিকে গুলি চালানো হবে৷ হাসেবা নৌজাদ দেখাচ্ছেন কোনদিকে; আসেমা দাহির (ডান দিক থেকে তৃতীয়) ও অন্যান্য ইয়াজিদি নারী যোদ্ধারা নিশানা ঠিক করছেন৷ শুধুমাত্র বিমান থেকে আইএস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে লাভ নেই৷ তাই ইয়াজিদি আর কুর্দ মহিলাদের নিয়ে রণক্ষেত্রে এই ভ্যানগার্ড তৈরি করা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
সুন্দর দেখানোর জন্য নয়
বন্দুক নিয়ে ঠিকমতো নিশানা করার জন্য মাথার চুল কপালে বা চোখে পড়লে চলবে না৷ তাই চুল টান টান করে বেঁধে নেন হাসেবা নৌজাদ, ‘মিলিটারি লুক’ ফ্যাশনের জন্য নয়৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
লাকি চার্ম
যুদ্ধের ফাঁকে আসেমা দাহির৷ হাতে যে লাল রঙের টেডি বেয়ারটি রয়েছে, সেটা হয়তো অতীতের সেই সুন্দর, শান্তিপূর্ণ দিনগুলির প্রতীক, যখন আইএস ইয়াজিদিদের স্বদেশকে দখল করেনি৷ ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে সেই শান্তি শেষ হয়ে যায়, শুরু হয় আইএস-এর সন্ত্রাস৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
পালানো ছাড়া পথ ছিল না
শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, আইএস কাউকে ক্ষমা করেনি৷ ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে লক্ষ লক্ষ ইয়াজিদি বাস্তু ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেন, তাদের পিছনে আইএস৷ এক বৃদ্ধ ও দুই তরুণীর এই ছবিটি যেন বিশ্বের সামনে ইয়াজিদিদের যন্ত্রণাকে তুলে ধরে৷
ছবি: Reuters
বিভীষিকা
এই ইয়াজিদি কিশোরী ক্যামেরার সামনে তার মুখ দেখাতে চায় না৷ ২০১৪ সালে এই ১৫ বছর বয়সের মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে একজন আইএস যোদ্ধার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ তার দু’মাস পরে মেয়েটি পালাতে সমর্থ হয়৷ আজ সে আবার নিজের পরিবারের সঙ্গেই বাস করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Bennett
ধ্বংসস্তূপ
উত্তর সিরিয়ার কোবানি শহরটি তুর্কি সীমান্তের অদূরে৷ আইএস যোদ্ধারা মাসের পর মাস শহরটি অবরুদ্ধ করে রেখেছিল৷ কুর্দিরা সব কিছুর পরও প্রতিরোধ চালিয়ে যায় ও শেষমেশ মার্কিন বিমানবাহিনীর সাহায্যে সন্ত্রাসবাদীদের পরাজিত করতে সমর্থ হয়৷ পড়ে থাকে একটি শহর নয়, যেন শহরের ধ্বংসস্তূপ৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Akgul
সবে মিলে করি কাজ
যারা আইএস-এর আদর্শে বিশ্বাস করে না, আইএস-এর দৃষ্টিতে তারা সবাই শত্রু৷ বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করাই হলো আইএস-এর উদ্দেশ্য৷ সে উদ্দেশ্য সর্বক্ষেত্রে সফল হয় না৷ কুর্দি আর ইয়াজিদি মেয়েদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, এক অর্থে তা আইএস-এর প্রতীকী পরাজয়৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
স্বাধীনতার সড়ক
শুধু অস্ত্র দিয়ে আইএস-কে হারানো যাবে না৷ সিরিয়া আর ইরাকের অনেক এলাকা এখনও আইএস-এর নিয়ন্ত্রণে৷ কুর্দি আর ইয়াজিদি মেয়েরাও তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে৷ তাদের প্রতিরোধের আর একটি শিক্ষা হলো, মেয়েরা পুরুষের দাস নয় - সন্ত্রাসবাদিদের যা কাজে লাগার কথা!