কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধে সরাসরি কুর্দিদের পক্ষ নিলো দামেস্ক৷ সিরিয়া জানিয়ে দিয়েছে আফরিনে সৈন্য পাঠিয়ে কুর্দিদের সাহায্য করা হবে৷ ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো জটিল হলো৷
বিজ্ঞাপন
আবহ প্রস্তুত ছিল৷ যুদ্ধের মঞ্চও তৈরি হয়েই ছিল৷ এবার সরাসরি যুদ্ধের দিকেই এগোচ্ছে সিরিয়া এবং তুরস্ক৷ ঘটনার সূত্রপাত সপ্তাহকয়েক আগে৷ সিরিয়ায় কুর্দি আন্দোলনকারীদের শক্ত ঘাঁটি আফরিনে সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় তুরস্ক৷ তুরস্কের উদ্দেশ্য ছিল, যেনতেনপ্রকারেণ কুর্দি আন্দোলনকারীদের শক্তি ক্ষয় করা৷ সে সময় কুর্দিরা সিরিয়া এবং অ্যামেরিকার কাছে সাহায্য চেয়েছিল৷ তাদের বক্তব্য ছিল, আইএস-এর সঙ্গে লড়াইয়ে কুর্দি আন্দোলনকারীরা সামনে থেকে সাহায্য করেছে আইএসবিরোধী শক্তিকে৷ মার্কিন সেনার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন কুর্দি আন্দোলনকারীরা৷ এখন যখন তাঁদের উপর আক্রমণ নেমে এসেছে, তখন মিত্রশক্তি তাঁদের নিশ্চয়ই সাহায্য করবে৷
সিরিয়ায় তুর্কি-মার্কিন সংঘাতের বিভিন্ন দিক
সিরিয়ার জটিল সংকটে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তি নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে জড়িয়ে পড়েছে৷ বিশেষ করে তুরস্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাত সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ছে৷ রাশিয়া, ইরান ও আসাদ সরকার পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য রাখছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Suna
গৃহযুদ্ধের জটিল সমীকরণ
বহু জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের দেশ সিরিয়ায় গ্রহযুদ্ধ শুধু বাশার আল আসাদ সরকার বনাম বিরোধীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়৷ আইএস-বিরোধী সংগ্রামেও ঐক্যের অভাব রয়েছে৷ প্রতিবেশী, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে৷ তুরস্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাদের মধ্যে অন্যতম৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
তুরস্কের কুর্দি ‘জুজু’
সীমানার মধ্যে সংখ্যালঘু কুর্দি জনগোষ্ঠীকে কমবেশি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও প্রতিবেশী দেশগুলিতে কুর্দিদের তৎপরতা নিয়ে লাগাতার দুশ্চিন্তায় থাকে তুরস্কের সরকার৷ সিরিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়৷ সেখানে আফ্রিন অঞ্চলে আসাদ প্রশাসনের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে কুর্দি ওয়াইপিজি গোষ্ঠী জাঁকিয়ে বসেছে৷ কয়েক বছর ধরে কার্যত স্বাধীন হয়ে উঠেছে সিরিয়ার কুর্দি অঞ্চল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. George
তুর্কি-মার্কিন সংঘাত
তথাকথিত ইসলামিক স্টেট-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ওয়াইপিজি গোষ্ঠীকে সহযোগী হিসেবে দেখে মার্কিন প্রশাসন৷ তাই তাদের আর্থিক ও সামরিক মদত দিয়ে চলেছে ওয়াশিংটন৷ অন্যদিকে তুরস্কের এর্দোয়ান সরকার তাদের সন্ত্রাসবাদী হিসেবে গণ্য করে৷ কুর্দিদের দমন করতে সরাসরি সামরিক অভিযানও চালাচ্ছে তুরস্ক৷ দুই ন্যাটো সদস্য দেশের মধ্যে এমন স্বার্থের সংঘাত নতুন সংকট সৃষ্টি করছে৷
ছবি: picture-alliance/abaca/E. Turkoglu
বিপজ্জনক পরিস্থিতি
ওয়াইপিজি যোদ্ধারা আইএস জঙ্গিদের বিতাড়ন করার পর মার্কিন প্রশাসন সিরিয়ার উত্তরে তাদের নিয়ে ৩০,০০০ সদস্যের এক সীমান্তরক্ষী বাহিনী সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ কুর্দি গোষ্ঠীর এই শক্তিবৃদ্ধি প্রতিরোধ করতেই সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তুরস্ক৷ ফলে কুর্দি এলাকায় সক্রিয় মার্কিন সৈন্যরাও সেই হামলায় জড়িয়ে পড়তে পারে৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Kilic
রাশিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া
সিরিয়ায় নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করতে তুরস্ক রাশিয়া ও ইরানকে তুষ্ট রাখার উদ্যোগ চালিয়ে যাচ্ছে৷ কুর্দিদের দমন করতে সিরিয়ার আকাশে নির্বিঘ্নে বোমারু বিমান চালাতে চায় তুরস্ক৷ ওয়াইপিজি গোষ্ঠীর দাবি, রাশিয়া পরোক্ষভাবে তুরস্কের আকাশ অভিযানে মদত দিচ্ছে৷ রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ আসাদ সরকার হুমকি সত্ত্বেও তুরস্কের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না৷
ছবি: Reuters/Sputnik/Mikhail Klimentyev/Kremlin
সম্ভাব্য পরিণতি
তুরস্কের চাপে ওয়াইপিজি গোষ্ঠী কোণঠাসা হয়ে পড়লে আংকারার মদতপুষ্ট ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ নিয়ন্ত্রিত দুই বিচ্ছিন্ন এলাকা যুক্ত হতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে আসাদবিরোধী এই গোষ্ঠীর শক্তিবৃ্দ্ধি হলেও কুর্দি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের নতুন সমীকরণের প্রয়োজন হবে৷ সেই অবস্থায় আসাদের স্বার্থরক্ষায় রাশিয়া ও ইরান কী করবে, তা-ও স্পষ্ট নয়৷
ছবি: Reuters/K. Ashawi
ওয়াশিংটনের সঙ্গে বোঝাপড়া
যে কোনো মূল্যে ওয়াইপিজি গোষ্ঠীকে কোণঠাসা করতে আংকারা সরকার বদ্ধপরিকর৷ ওয়াশিংটনের সঙ্গে সংঘাত এড়াতে তারা কুর্দি যোদ্ধাদের ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বে চলে যাবার প্রস্তাব দিয়েছে৷ মানবিজ এলাকায় তুর্কি ও মার্কিন সৈন্যদের যৌথভাবে মোতায়েনেরও প্রস্তাব দিয়েছে তুরস্ক৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Anadolu
7 ছবি1 | 7
কার্যত সেই আবেদনেই সাড়া দিলো সিরিয়া৷ দামেস্ক সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তুরস্কের সঙ্গে কুর্দিদের লড়াইয়ে আফরিনে সৈন্য পাঠাবে সিরিয়া৷ সাহায্য করা হবে কুর্দি আন্দোলনকারীদের৷ শোনা যাচ্ছে, কুর্দি এবং সিরিয়া সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতার কাজ করেছে রাশিয়া৷ সিরিয়ার সৈন্য কুর্দিদের সাহায্যে চলে এলে স্বাভাবিকভাবেই লড়াই অন্য মাত্রা পাবে৷ যুদ্ধ আর কেবল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একটি রাষ্ট্রের থাকবে না৷ দু'টি রাষ্ট্রের মধ্যে লড়াই শুরু হবে৷ বিশ্বের শক্তিসাম্যের ক্ষেত্রে যা খুব সুখকর হবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা৷
অ্যামেরিকাও আফরিনে তুরস্কের সৈন্য পাঠানোর বিষয়টি খুব ভালো চোখে দেখেনি৷ প্রকাশ্যেই তুরস্কের সমালোচনা করা হয়েছিল৷ কিন্তু তুরস্ক সরকার কোনো কথাই আমল দেয়নি৷ দীর্ঘদিন ধরেই কুর্দি আন্দোলনকারীরা তাদের টার্গেট৷ শোনা যায়, কুর্দিদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আইএস জঙ্গিদেরও সাহায্য করেছিল তুরস্ক৷ যদিও শেষপর্যন্ত কূটনীতির চাপে আইএসবিরোধী যুদ্ধে শরিক হতে হয়েছিল তাদের৷ কিন্তু সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিরা পরাস্ত হওয়ার পরেই ফের পুরনো শত্রুকে দমনের পথে নেমেছে তারা৷
রাশিয়ার মধ্যস্থতায় সিরিয়া সরকার কুর্দিদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘটতে চলেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে৷ এক, আরব দুনিয়ার আরো কাছাকাছি চলে গেল তুরস্ক৷ কারণ, একমাত্র আরব দুনিয়াই কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধকে মান্যতা দিয়েছে৷ দুই, তুরস্ক প্রশ্নে অ্যামেরিকা আর রাশিয়া আরো কাছাকাছি চলে এলো৷ ভবিষ্যতে এই যুদ্ধ যদি আরো বড় আকার ধারণ করে, তাহলে অ্যামেরিকা এবং রাশিয়া দু দেশই সিরিয়া ও কুর্দ বাহিনীকে সাহায্যের রাস্তা খোলা রেখেছে৷ এবং তিন, কুর্দিদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন আন্তর্জাতিক মান্যতা পেলো৷ এখন দেখার, নতুন করে তৈরি হওয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কারও পক্ষ নেয়, নাকি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা করে৷