ঘটনার পর চায়না বেগম কুষ্টিয়া সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন৷ তাতে বটতৈল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য এনামুল হক, মাতব্বর মোশারফ হোসেন, আনার মণ্ডল ও সাইদুল হাজির নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪৫-৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে৷
মৃত্যুর আগে চায়না বেগমের স্বামী গাজীর উদ্দিন ফকির তাকে বলেছিলেন, ‘‘কোথাও জায়গা না হলে তুমি আমার কবরের পাশেই থাকবা৷ প্রতি বছর বাতাসার সিন্নি হলেও করবা''৷ লালন সাঁইয়ের অনুসারী চায়না বেগমও চেয়েছিলেন জীবনের শেষ দিনগুলো স্বামীর কবরে মাথা ঠেকিয়ে কাটিয়ে দেবেন৷ ভিটেমাটিতে প্রতিদিন জ্বালাবেন সন্ধ্যা প্রদীপ৷ তার সেই চাওয়া পূরণ হলো না৷''
লিখিত অভিযোগে চায়না উল্লেখ করেছেন, গত বুধবার (২৬ জুন) সকাল ৬টার দিকে অভিযুক্তরা তার ঘর ভাঙচুর করেন৷ এতে তার লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে৷ এছাড়া, তারা চায়নাকে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন৷
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে এনামুল হক বলেন, ‘‘ওই বৃদ্ধা বাড়ি করেছেন একটি মাঠের মধ্যে ফাঁকা জায়গায়৷ সেখানে যাওয়ার পথ নেই, তাকে দেখারও কেউ নেই৷ এছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের আস্তানা হওয়ার আশঙ্কায় তার ঘরটি এলাকাবাসী ভেঙে দিয়েছে৷ ওই বৃদ্ধা চাইলে আমরা রাস্তার পাশে বাড়ি করে দিতে পারি৷ কিন্তু উনি সেখানেই থাকতে চান৷''
অভিযোগের তদন্তভার পেয়েছেন কুষ্টিয়া মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খায়রুজ্জামান৷ তিনি বলেন, ‘‘উভয়পক্ষকে থানায় ডাকা হয়েছে৷ সেখানে একটি সুষ্ঠু সমাধানের চেষ্টা করা হবে, নাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেবো৷''
এপিবি/এসিবি (ডেইলি স্টার বাংলা)
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেউড়িয়া গ্রামে বাউল সম্রাট লালন শাহের কবরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আখড়া বা মাজার৷ ১৮৯০ সালে লালনের মৃত্যুর পর তার ভক্তরা সেখানে ভিড় করতে থাকেন৷ লালন শাহ প্রায় ৩০০ গান রচনা করেন বলে গবেষণায় জানা যায়৷
ছবি: Mortuza Rashedমানবতাবাদী সাধক ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী লালন শাহ ১৭৭৪ সালের ১৭ অক্টোবর ঝিনাইদহ, মতান্তরে যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন৷ পারিবারিকসূত্রে মুসলিম হলেও তিনি নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম পালন করতেন না৷ গানের প্রতি লালন শাহ এতই অনুরাগী ছিলেন যে মৃত্যুর দিন ভোর পর্যন্ত তিনি গান-বাজনায় মগ্ন ছিলেন৷
ছবি: Mortuza Rashed১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালনের মৃত্যুর পর তার কবরে ভক্তদের ভিড় বাড়তে থাকে৷ ১৯৬৩ সালে বর্তমান মাজারটি নির্মাণের পর উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান৷ তারপর থেকে প্রতি বছর ১৭ অক্টোবর লালনের জন্ম ও তিরোধান উপলক্ষে মাজারে বিপুল লোকসমাগম হয়ে থাকে৷
ছবি: Mortuza Rashedমাজারের মূল ফটকের সামনে একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে৷ সেখানে রয়েছে বাঁশি, খোল, তবলা, লালনের কাঠের মূর্তি, দেশি পণ্য, একতারা, দোতারা, পেঞ্জুরি, হাতবায়া ইত্যাদি পণ্যের সমাহার৷ ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, লালন মেলা এবং সরকারি ছুটির দিনগুলোতে বিক্রি বেশি হয়৷
ছবি: Mortuza Rashedআখড়ায় সারাদিনই দর্শনার্থী ও ভক্তদের আনাগোনা চলে৷ মাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লালন মেলার সময় দেশি-বিদেশি পর্যটক ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখর থাকে মাজার এলাকা৷
ছবি: Mortuza Rashedকুষ্টিয়ার রাজবাড়ী থেকে স্ত্রী, বোন এবং সন্তানদের নিয়ে লালনের মাজারে ঘুরতে গিয়েছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোঃ রাসেল শেখ জানান, ‘‘এর আগে এখানে বন্ধুবান্ধবসহ ঘুরতে এলেও পরিবারসহ এবারই প্রথম এলাম৷ করোনার কারণে বিনোদনের জায়গাগুলো বন্ধ থাকার কারণে বাচ্চারা হাঁপিয়ে উঠেছিল৷ এখানে এসে তারা অনেক খুশি৷’’
ছবি: Mortuza Rashedলালন শাহের মাজার দেখাশোনার জন্য একাধিক খাদেম থাকলেও প্রধান খাদেম ৮০ বছর বয়সি ফকির মোঃ আলী শাহ৷ প্রায় ১২ বছর ধরে তিনি এ আখড়ায় আছেন বলে জানান৷ শেষ বয়সে কেন এখানে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এখানে নিজের ইচ্ছায় আসছি৷ দেশ-বিদেশের মানুষ আমাকে চিনে৷ এখানে যে সম্মান পেয়েছি, তা অন্য কিছুতে পেতাম না৷’’
ছবি: Mortuza Rashedবাংলাদেশসহ সমগ্র ভারতবর্ষে লালন সংগীত বা লালনগীতি বেশ জনপ্রিয়৷ শ্রোতার পছন্দ অনুসারে বিবিসি বাংলার করা সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ গানটির স্থান ১৪তম৷ আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদতত্ত্ব, প্রেম-ভক্তিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, আল্লাহ্-নবীতত্ত্ব, কৃষ্ণ-গৌরতত্ত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে লালনের গান রয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashedলালনের আখড়ায় প্রতিবছর দুইবার লালন মেলা হয়ে থাকে৷ একবার দোল পূর্ণিমা উৎসবের সময়, আরেকবার কার্তিক মাসের ১ তারিখে লালনের জন্ম-তিরোধান দিবস উপলক্ষে৷ এ মেলাকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশের শিষ্য, ভক্ত ও দর্শনার্থীদের বিপুল সমাগম ঘটে৷ রাতভর চলে বাউল গানের উৎসব৷
ছবি: Mortuza Rashedলালন শাহের আখড়ায় গিয়ে দেখা গেল অডিটোরিয়াম ভবনের নিচে একটি দল গান বাজনা করছেন৷ কথা বলে জানা গেল, এখানে তারা প্রতিদিনই গানের আসর বসান৷ রুটি রুজির ব্যবস্থা কীভাবে হয় জানতে চাইলে দলের সদস্য দিপু বাউল বলেন, ‘‘অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন এখানে এসে আমাদের গান শুনে৷ তারা খুশি হয়ে যা বখশিশ দেয়, তাতেই কোনোমতে চলে যায়৷’’
ছবি: Mortuza Rashedমাজারের মূল আকর্ষণ লালনের কবর৷ মাজারের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই সাদা রংয়ের এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি ঘর চোখে পড়ে৷ সেখানেই রয়েছে লালনের কবর৷ ভক্ত ও শিষ্যরা কবরে ফুল দিয়ে ও মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে৷ অন্য ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি ইসলাম ধর্মের অনেক অনুসারীও সেখানে সিজদাহ, দোয়া ও মানত করে৷ এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা আছে৷
ছবি: Mortuza Rashedমাজারের মূল কক্ষের বাইরে লালন শাহের অন্যতম ভক্ত কামিনী ফকিরানী, ফকির মহিন শাহ, কুসুম ফকিরানী, ফকির আফিজ উদ্দিন শাহ, লতিফ শাহ ফকির, মওলানা মলম শাহ, শান্তি ফকিরানী, ফকির মোঃ ইয়াসিন শাহসহ ১৩ ভক্তের কবর রয়েছে৷ প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসব কবরে মোমবাতি ও আগরবাতি জ্বালানো হয়৷
ছবি: Mortuza Rashedকুষ্টিয়া সদর থেকে প্রতিদিন ফকির লালন শাহের মাজারে আসেন ভক্ত ইসমাইল হোসেন বাবলু৷ কেন প্রতিদিন এখানে আসেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘গুরুর কাছে আসলে মনে শান্তি লাগে৷ মনের বাসনা পূরণ হয়৷ তাছাড়া প্রতিদিন কত ভুল করি, গুরুর কাছে সেসবের জন্য মাফ চাই৷’’
ছবি: Mortuza Rashedলালনের আখড়ার মূল ভবনের পাশাপাশি নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক অডিটোরিয়াম এবং লালনের স্মৃতিসম্বলিত একটি জাদুঘর৷ এখানে রয়েছে লালনের ব্যবহৃত জলচৌকি, একতারা, কল্কি, চাবি, ঘটি, খড়ম, ঘরের দরজা ইত্যাদি৷ জাদুঘরটিতে প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা৷
ছবি: Mortuza Rashed