কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো.আব্দুল হাই সিদ্দিকীকে মারধরের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে আসামি শনাক্ত করা হয়৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কুড়িগ্রাম সদর থানার ওসি খান মো. শাহরিয়ার জানান, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে আসামি নূর মোহাম্মদ সাবিরি লিটনকে শনাক্ত করে পুলিশ৷ পরে বিশেষ অভিযান চালিয়ে কুড়িগ্রাম পুরাতন স্টেশন পাড়া এলাকা থেকে বুধবার রাতে তাকেগ্রেপ্তার করা হয়৷
নূর মোহাম্মদ সাবিরি লিটন কুড়িগ্রাম পৌরসভার ভুয়াতিপাড়া এলাকার আব্দুর সাবের মিয়ার ছেলে৷
কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক মো. আব্দুল হাই সিদ্দিকীকে রোববার বেলা ১২টার দিকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে মারধর করা হয়৷ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনা শুরু হয়৷
এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষক কুড়িগ্রাম সদর থানায় দলবদ্ধ হয়ে সরকারি কাজে বাধাদান, সরকারি কর্মচারীকে আঘাত ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে মামলা করেন৷ মামলায় কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সহছাত্র বিষয়ক সম্পাদক এবং কুড়িগ্রাম জেলা শহরের মোল্লাপাড়ার ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজের ছেলে মো. মাসুদ রানা (৪৮), তার সহযোগী ফরিদুজ্জামান মণ্ডল রুমন মিয়া (৩৫), আমিনুল ইসলাম (৩৯) ও আলতাফুর রহমান বিদ্যুৎ (৪০) এর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আর কয়েকজনকে আসামি করা হয়৷
এছাড়া ওই শিক্ষক জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছেন বলেও জানিয়েছেন কুড়িগ্রাম সদর থানার ওসি মো. শাহরিয়ার৷
মামলার বাকি আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে বলে জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা৷
তিনি আরও জানান, কুড়িগ্রাম বিএনপির সহছাত্র বিষয়ক সম্পাদক এবং জেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মাসুদ রানা কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে তথ্য নিতে এসে এক পর্যায়ে শিক্ষক আব্দুল হাই সিদ্দিকীর উপর চড়াও হয়ে তাকে মারধর করেন৷
ভর্তি বাতিল হওয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক হিসাবে রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়াসমিন আরা হকের কক্ষে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটান৷ এ সময় তার সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন ছিলেন৷
এ ঘটনার ১ মিনিট ১১ সেকেন্ডের ছড়িয়ে পড়া সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, প্রধান শিক্ষক জিয়াসমিন আরা হক তার চেয়ারে বসে আছেন৷ তার উল্টো দিকে মাসুদ রানাসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আব্দুল হাই সিদ্দিকীর ওপর চড়াও হন৷ এক পর্যায়ে তাকে ধাক্কা দিতে থাকলে তিনি সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷
এ সময় একজন নারী শিক্ষক ও আরও কয়েকজন শিক্ষক মাসুদ রানাকে থামানোর চেষ্টা করেন৷ কিন্তু তারপরও তিনি শিক্ষক আব্দুল হাইয়ের ওপর চড়াও হন এবং ধাক্কাতে থাকেন৷
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
শিক্ষা, শিক্ষকতা ও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে শিক্ষাঙ্গন ও বাইরের প্রভাব
শিক্ষক মানেই গুরু৷ শিক্ষার্থী তার কাছে স্নেহাস্পদ৷ কিন্তু ইদানীং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কেও পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট৷ তাতে শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক, সমাজ, রাজনীতি, পাঠক্রমের ভূমিকা কতটুকু? এর উত্তর খুঁজেছে ডয়চে ভেলে৷
ছবি: bdnews24.com
আবদুল্লাহ রানা, সাংস্কৃতিক কর্মী
সামগ্রিক পরিবেশের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক পরিবেশও অনেকটা দায়ী৷ আমার ছেলে যখন ক্লাস থ্রি-তে পড়তো, তখন একদিন সে আমাকে বলল, তার ক্লাসের একটা ছেলে হিন্দু বলে তার সঙ্গে কেউ কথা বলে না৷ আমি তখন হেডমাস্টারের সঙ্গে কথা বলি৷ ওই স্কুলের পরিবেশ কিন্তু এমন না৷ তার মানে, পরিবার থেকেই এটা এসেছে৷ আসলে বাচ্চাদের খেলার মাঠ নেই, এলাকায় লাইব্রেরি নেই৷ কীভাবে আমরা ধর্মান্ধ একটা জাতিতে পরিণত হতে পারি- সে দিকেই যাচ্ছি৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
তৌহিদুল হক, সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য নৈতিকভাবে বলিষ্ঠ জনগোষ্ঠী তৈরি করা৷ নৈতিক শিক্ষা আমরা পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ থেকে পেয়ে থাকি৷ ধর্মীয় বোধও গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নৈতিক শিক্ষার দায়টা পরিবার ও রাষ্ট্র শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর চাপিয়ে থাকে, যা একপেশে ধারণা৷ সমাজের সব স্তরেই যদি নৈতিকতার চর্চা না থাকে, তাহলে শুধুমাত্র শিক্ষকদের বক্তব্য বা বই পড়ে উদ্বুদ্ধ হবে, এমন মনে করা ঠিক নয়৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আরেফিন শরিয়ত, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নৈতিক শিক্ষা বইপত্র পড়ে শেখা যায় না৷ পারিবারিক সংস্কৃতি, শিক্ষকের মানসিকতা- এসবের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে৷ মানসিকতার কারণে ধর্ম ও বিজ্ঞান আলাদা হয়ে যায়৷ দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকদের ভাবনার জায়গা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রসার ঘটছে না, যে কারণে শিক্ষার্থীরা এখন অন্য ধর্মের শিক্ষককে ভিন্ন চোখে দেখছে৷ এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ৷ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা শিক্ষককে কীভাবে দেখছেন তারও প্রতিফলন ঘটছে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
রুকাইয়া জহির, শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
দিন দিন আমরা বাঙালি সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছি৷ গত দুই বছর ধরে কোনো সাংস্কৃতিক চর্চা নেই৷ আমরা যদি বাঙালি সংস্কৃতি আরো বেশি তুলে ধরতে পারি, আরো বেশি চর্চা করতে পারি, তাহলে বিভাজনটা চলে যাবে৷ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই আমরা আবার বিশ্ব বাঙালি এক হতে পারি, আমাদের অন্ধত্ব দূর হতে পারে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সালমান সিদ্দিকী, সভাপতি, ছাত্রফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত৷ এই সম্পর্কের উপর নির্ভর করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এগুবে, না পেছাবে৷ যত দিন যাচ্ছে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে৷ এখন আমরা দেখি, ছাত্রকে অপহরণ করছেন শিক্ষক৷ আবার ছাত্ররা শিক্ষকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে৷ এখন শুধু স্কুল না, পুরো রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্মকে ব্যবহার করা, ধর্মকে ব্যবহার করে অন্যকে ফাঁসানো, একটা উন্মাদনা তৈরি করার প্রবণতা বাড়ছে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সায়মা সিদ্দিকা, উন্নয়নকর্মী
আমাদের মধ্যে ধর্মভিরুতা তৈরি করা হচ্ছে৷ দীর্ঘদিনের যে সমাজ-সংস্কৃতি তা থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে৷ এটা হওয়া উচিত না৷ পরিবার থেকেই বাচ্চাদের আমাদের কৃষ্টি-কালচার শেখাতে হবে৷ যেমন কীভাবে আমরা একে অপরের ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে মিশে যেতাম, এখনও যেতে পারি৷ এতে আমাদের ধর্মের কোনো ক্ষতি হবে না৷ আমি এখনও বিশ্বাস করি, সমাজে এই ধরনের মানুষ এখনও আছে৷ তারাই পরিস্থিতি পালটে দেবে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
অনিক রায়, সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন
আমাদের সময় যেভাবে পাঠ্যবইয়ে ধর্ম পড়ানো হতো, এখন সেভাবে হচ্ছে না৷ এখন ধর্মকে সাম্প্রদায়িকীকরণ ও উগ্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে৷ ওয়াজগুলো কোনো সেন্সর ছাড়াই চলছে৷ সেখানে নারীর বিরুদ্ধে বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়, যেটা বারবার বলার কারণে মানুষের মাথায় গেঁথে যায়৷ শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের যে ঘটনা, সেখানে একটি ছেলে বারবার বলছে, সে ওয়াজে শুনেছে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
উৎপল বিশ্বাস, সাবেক ভিপি, জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে যে সম্পর্কটা আমরা ছোটবেলায় দেখেছি এখন সেটা আর নেই৷ শিক্ষকরা এখন অনেক হীনমন্যতায় ভুগছেন৷ নৈতিক শিক্ষা দিতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হতে হয় কিনা তা তাদের ভাবনায় থাকছে৷ এই সুযোগটা শিক্ষার্থীরা নিচ্ছে৷ কোনো শিক্ষক যদি কিছু বলেনও, শিক্ষার্থীরা সেটিকে ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ এই যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে দূরত্ব, এর জন্য জাতিকে আগামী দিনে চড়া মাশুল দিতে হবে৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সুস্মিতা রায় সুপ্তি, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকার সমন্বয়ক
আমরা যেটা দেখছি, শিশুদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষা এত বেশি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে তারা নৈতিক শিক্ষার কথা ভাবতেই পারছে না৷ শুধু বই পড়ছে৷ এখন বেশি নম্বর পাওয়ার এক ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে৷ স্কুলের প্রশ্ন ফাঁস করছেন শিক্ষক৷ এগুলো তো ভয়াবহ ব্যাপার৷ যে শিক্ষক নৈতিক শিক্ষা দেবেন, তিনি যদি প্রশ্ন ফাঁস করে দেন, তাহলে কোথায় শিখবে৷ আবার অভিভাবকরাও এই প্রশ্ন সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছেন৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
শান্তনু মজুমদার, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা যে খুব একটা গুরুত্ব পায়, তা নয়৷ শিক্ষার ক্ষেত্রে সহনশীলতা এবং বৈচিত্র খুবই প্রয়োজন৷ আমি এখনও বিশ্বাস করি না, বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ধর্মের ভিত্তিতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক রচনা করে৷ সাম্প্রতিক সময়ে আমরা যে প্রবণতা দেখছি, সেটা একটা দুষ্টু প্রবণতা৷ শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ নষ্ট করার রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক চেষ্টা তো আছেই৷ তবে আমি মনে করি না, এখনও সব ধ্বংসের মুখে চলে গেছে৷