কূটনীতিকরা যখন নীরব
৩১ অক্টোবর ২০২৩২৮ অক্টোবরের ঘটনা জানাতে গিয়ে কিছু ছবি ও ভিডিও ফুটেজও দেখানো হয়। প্রায় এক ঘণ্টার ব্রিফিং শেষে কূটনীতিকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাদের কোনো প্রশ্ন আছে কিনা, কিন্তু কেউ কোনো প্রশ্ন করেননি। কেন তারা কোনো প্রশ্ন করেননি? তাদের কি জানতে চাওয়ার মতো কিছু নেই, নাকি সরকারের ব্রিফিংয়ে তারা সন্তুষ্ট নন?
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী বা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিছু বলেননি। তারা কূটনীতিকদের কাছেই বিষয়টি জানতে বলেছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূতদের কেউ কেউ বলছেন, সরকারের ব্রিফিংয়ে তারা হয়ত সন্তুষ্ট নন। আবার কেউ কেউ বলছেন, তারা নিজেরাই হয়ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন, ফলে জানতে চাওয়ার কিছু নেই বা এমনও হতে পারে সরকার কী বলবে তারা সেটা জানেন, এ কারণে কিছুই জানতে চাননি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কূটনীতিকদের ডেকে ব্রিফিং করার রেওয়াজ আছে। ফলে সরকার এটা করতেই পারে। সামনে নির্বাচন, এই নির্বাচনকে ঘিরে কূটনীতিকরা যেহেতু অনেক বেশি তৎপর, ফলে তাদের ডেকে ব্রিফিং করে একটা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা তো সরকার করতেই পারে।”
সোমবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত ব্রিফিংয়ে ৮০ জনের মতো কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন। সরকারের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ছাড়াও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও ঢাকার পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। ব্রিফিংয়ের শুরুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের বলেন, "আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার জন্য বিএনপি ২৮ অক্টোবর সারা দেশে নৈরাজ্য চালিয়েছে। ২৮ অক্টোবর যা ঘটেছে, তাতে আমরা মর্মাহত। যদিও অতীতে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার অভিজ্ঞতা থাকায় আমরা অতটা বিস্মিত হইনি। দুঃখের সঙ্গে বলছি, আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম তারা বদলাবে, কিন্তু তারা পাল্টায়নি।” ওই দিনের সহিংতার জন্য বিএনপিকে দায়ি করেন তিনি।
পরে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। সেখানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, "আমরা ২৮ তারিখে যেসব ঘটনা ঘটেছে, ওই দিন তাৎক্ষণিক যেসব ফুটেজ পাওয়া গেছে, সেগুলো বিদেশি মিশনগুলোতে পাঠিয়েছি। আজ আবার তাদের সহিংসতার ভিডিও ফুটেজ, ছবিসহ নানা ডকুমেন্ট দেখানো হয়েছে।” বিদেশি কূটনীতিকদের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, "তাদের অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গেছে, তারা এসব দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছেন।” তারা কেন কোনো প্রশ্ন করেননি জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, "সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন।”
সরকার ব্রিফিং করে কূটনীতিকদের কী বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখন তো প্রযুক্তির যুগ, সরকার তাদের কী ব্রিফিং করলো, তার জন্য তো আর তারা বসে থাকবে না। তারা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তথ্য সংগ্রহ করে নিজের দেশে পাঠিয়েছেন। এই ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে কূটনীতিকদের কোনো অবস্থানও বদল হবে না। যারা সরকারকে সমর্থন করে, তারা বিরোধী দলের দোষ খুঁজবে, আর যারা সরকারকে সমর্থন করেনি বা করছে না, তারাও তাদের অবস্থানে থাকবেন।” কূটনীতিকদের নিশ্চুপ থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, "হয়ত তারা জানেন সরকার কী জবাব দেবে, এই কারণেই হয়ত কোনো প্রশ্ন করেননি। আর প্রশ্ন করা বা না করাতে কিছু এসে যায় না।”
এদিকে সোমবারই ঢাকায় ২৮ অক্টোবরের রাজনৈতিক জমায়েতগুলোতে সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ৭টি দেশের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। দেশগুলো হলো, অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে তারা প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনায় শোক জানিয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকায় ২৮ অক্টোবরের রাজনৈতিক জমায়েতগুলোতে সহিংসতায় তারা গভীর উদ্বিগ্ন। তারা সব পক্ষকে সংযত থেকে সহিংসতা পরিহার এবং অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে কাজ করার আহবান জানান।
এই বিবৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, "সাতটি রাষ্ট্র মিলে যে বক্তব্যটি দিয়েছে, সেটি অতীতে তারা যে বিবৃতি দিয়েছিল, সেটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ধারাবাহিকতার অভাব আছে।” তারা যেন ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন - এ অনুরোধ জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, "এ বিষয়টি তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিতেও তারা কিছু বলেননি। বিবৃতি না দেওয়াটাই প্রথা কূটনীতিতে। কারণ, আমরা মনে করি, এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে কিছু কিছু রাষ্ট্র আগ বাড়িয়ে এটা করছে।”
কূটনীতিকদের ব্রিফিং করে কী সরকার তাদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেছে? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সাত দেশ যে বিবৃতি দিলো, সেটা কী তাদের উচিৎ হয়েছে? এই বিবৃতি না দিলে হয়ত, ব্রিফিংয়ের প্রয়োজন হতো না। গাজায় এত বড় গণহত্যা হচ্ছে, সেটা নিয়ে কি তারা বিবৃতি দিয়েছে? এগুলো খুব বেশি গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো বলে আমার মনে হয়।”
ব্রিফিং শেষে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, "আমরা এখানে বলছি না যে, তাদের নীরবতা মানে তারা সব বিষয়ে একমত হয়েছেন। আমরা এমনও বলছি না যে, নীরবতা মানে তারা আমাদের সঙ্গে একমত না। আমরা যেটি বলছি, উনাদের প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু উনারা কোনো প্রশ্ন করেননি। তার মানে আমরা যতটুকু বুঝতে পারি, আমরা যে ব্যাখ্যা দিয়েছি, সেটি অন্ততপক্ষে পরিষ্কার হয়েছে। উনারা বিষয়টি মেনে নিয়েছেন বা নেননি, সেটি বলার দায়িত্ব আমাদের না। সেটি বলার দায়িত্ব উনাদের।”
কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন করতে বলা সত্ত্বেও কূটনীতিকদের নীরবতা পালন সম্পর্কে সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার মনে হয়, সরকারের ব্রিফিংয়ে তারা বিরক্ত হয়েছে, তারা সরকারের মন্ত্রীদের কথা বিশ্বাস করেননি- এই কারণে কোনো প্রশ্ন করেননি। প্রযুক্তির যুগে এখন রিক্সা চালকের হাতেও স্মার্ট ফোন আছে। ফলে কী ঘটছে সবাই দেখছে। কূটনীতিকরাও দেখছে। ফলে তারা নিজেদের মতো করেই তথ্য সংগ্রহ করেছে। আমার এক মেয়ে থাকে ক্যানাডা, আরেকজন অ্যামেরিকা। আমি একটা টক শো শেষ করে বের হয়ে গাড়িতে উঠে তাদের ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে তারা জানালো আমি কী বলেছি তারা দেখেছে। অর্থাৎ, এখানে কী ঘটছে সেটা সবাই দেখছে। ৭ দেশের পক্ষ থেকে যে বিবৃতিটা দেওয়া হয়েছে, সেখানে কিন্তু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। আমি মনে করি, তারা অংশগ্রহণগ্রহণমূলক বলতে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়াকে বুঝিয়েছে। ফলে ২০১৩-১৪ সালে যেভাবে সম্ভব হয়েছে, এবার সেটা হবে না।”