তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যিপ এর্দোয়ান গত সপ্তাহান্তে সে দেশে নিযুক্ত ১০ রাষ্ট্রদূতকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ এরপর সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর তার সুর নরম শোনা গেছে৷
বিজ্ঞাপন
তুরস্কের ব্যবসায়ী ও দাতা ওসমান কাভালাকে দোষী সাব্যস্ত না করে গত চার বছর ধরে জেলে রাখা হয়েছে৷ তাকে মুক্তি দিতে সম্প্রতি জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ১০ দেশের রাষ্ট্রদূত তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল৷ সে কারণে এর্দোয়ান তাদের অবাঞ্ছিত করতে চেয়েছিলেন৷ তবে সোমবার মন্ত্রিসভার এক বৈঠকের পর এর্দোয়ান বলেন, ‘‘দূতাবাসগুলো আমাদের দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর প্রক্রিয়া থেকে সরে এসেছে৷ আমি বিশ্বাস করি ওই রাষ্ট্রদূতেরা তুরস্কের সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিবৃতি দিতে ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকবেন৷’’
এর্দোয়ানের এই বক্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস একটি টুইট করে৷ এতে বলা হয়, কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ ধারায় কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্র এই ধারার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ বলেও টুইটে জানানো হয়৷
অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে নজর সরাতে?
জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুর্কি রাজনীতি বিষয়ের বিশেষজ্ঞ শার্লটে ইয়োপিয়েন মনে করছেন, তুরস্কের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে সাধারণ নাগরিকদের নজর সরানোর চেষ্টা করছেন এর্দোয়ান৷ কারণ গত কয়েকমাস ধরে এর্দোয়ানের জনপ্রিয়তা কমছে৷ স্বাধীন জরিপ সংস্থা আভরাসিয়া বলছে, এর্দোয়ানের একেপি পার্টির সমর্থন এখন ৩০ শতাংশের নীচে৷
এদিকে বিরোধীদের মধ্যে এতদিন বিভাজন দেখা গেলেও বর্তমানে তাদের এক হতে দেখা যাচ্ছে৷ এমন দুটি দল- সিএইচপি ও আইওয়াইআই পার্টির প্রতি সমর্থন এখন ৪০ শতাংশের বেশি দেখা যাচ্ছে৷
এছাড়া এর্দোয়ানবিরোধী আরও কয়েকটি ছোট দলের অস্তিত্ব এবং কুর্দিপন্থি এইচডিপি পার্টির প্রতি সমর্থন প্রায় ১০ শতাংশ হওয়ায় এর্দোয়ান ও তার দল আগামী প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচনে হারের আশঙ্কায় আছে৷
মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি ও তুর্কি মুদ্রা লিরার অবমূল্যায়ন - এসব কারণে এর্দোয়ানের জনপ্রিয়তা কমছে৷
ভোটের স্বার্থে ধর্ম ব্যবহারের অভিযোগ, এর্দোয়ানের জবাব
সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এমন দেশগুলোতে সরকারি অনুষ্ঠানে অন্তত বিশেষ কোনো ধর্ম অগ্রাধিকার পায় না৷ অথচ সেকুলারদের অভিযোগ- ভোট বাড়াতে এর্দোয়ান ইসলামকে ব্যবহার করছেন৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Präsidialamt für Kommunikation/Iletisim Baskanligi
এর্দোয়ানের একে পার্টি এবং ইসলাম ধর্ম
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ানের রাজনৈতিক দলের নাম জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) হলেও দলটির বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগটা পুরোনো৷
ছবি: Adem Altan/AFP/Getty Images
গির্জা থেকে আবার মসজিদ
এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতি উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযোগ বড় হয়ে ওঠে ২০০০ সালে৷ এক সময়ের গির্জা আয়া সোফিয়াকে ১৪৫৩ সালে দখল করে অটোমান সাম্রাজ্য৷ পরবর্তীতে তা মসজিদ এবং তারপর জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়৷ তুরস্কে মুসলমান-খ্রিষ্টান ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠা স্থাপনাটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদাও পেয়েছিল৷ কিন্তু আদালতের রায়ে তা আবার মসজিদ হলে জুম্মার নামাজ পড়ে তার উদ্বোধন করেন এর্দোয়ান৷
সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের বাইরেও এর্দোয়ানের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে মূলত ধর্মীয় নেতা আলী এরবাসকে৷ আয়া সোফিয়ায় ৯০ বছর পর যেদিন প্রথম নামাজ হলো, সেদিন খুতবা পড়িয়েছিলেন তিনি৷ সেই থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সরকারি ভবন উদ্বোধন করা হলেই দেখা যায় তাকে৷
ছবি: Murad Sezer/REUTERS
আদালতের উদ্বোধনে আলী এরবাস
চলতি মাসে আঙ্কারায় একটি নতুন আদালত ভবনের উদ্বোধন করেন এর্দোয়ান৷ আলী এরবাসকে দিয়ে ইসলাম ধর্ম মোতাবেক বিশেষ দোয়া পাঠ করানোর কারণে আবার শুরু হয় সমালোচনা৷ তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদরা বলছেন, এর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের চরম অমর্যাদা হয়েছে৷ তারা মনে করেন, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যায় বেশি হলেও রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় শুধু সেই ধর্মের অস্তিত্ব তুলে ধরা উচিত নয়৷
ছবি: Murat Cetinmuhurdar/Presidential Press Office/REUTERS
যুক্তরাষ্ট্রেও আলী এরবাস
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে সুউচ্চ এক ভবনের উদ্বোধন করেন এর্দোয়ান৷ নিউইয়র্কে বসবাসরত তুর্কি কূটনীতিকদের জন্য নির্মাণ করা ভবনটির উদ্বোধনেও নতুন কিছু দেখা যায়নি৷ সেখানেও হাজির ছিলেন আলী এরবাস৷ সেখানেও তার নেতৃত্বে ইসলাম ধর্মমতে দোয়া-দরুদ পড়েই শুভ উদ্বোধন হয় ভবনটির৷
ছবি: Murat Cetinmuhurdar/Presidential Press Office/REUTERS
ভোটের আগে ধর্মের রাজনীতি?
বিরোধীদের অভিযোগ- ২০২৩ সালের নির্বাচনে ভোট বাড়াতেই ইসলাম ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন এর্দোয়ান৷ সম্প্রতি ধর্ম বিষয়ক জাতীয় পরিষদ দিয়ানেটকে ঘিরেও এমন অভিযোগ উঠেছে৷ দিয়ানেটের নিজস্ব টেলিভিশন চ্যানেলে ৩০ জন কর্মীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, দিয়ানেটের বাজেট তুরস্কের অনেক মন্ত্রণালয়ের চেয়েও বেশি৷ তারপরও আগামী বছর প্রতিষ্ঠানটির বাজেট বাড়িয়ে ১.৮৬ বিলিয়ন করার ঘোষণা দিয়েছেন এর্দোয়ান৷
ছবি: Präsidialamt für Kommunikation/Iletisim Baskanligi
বাড়ছে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ
তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদরা সাম্প্রতিক সমীক্ষার তথ্য উল্লেখ করে বলছেন, এর্দোয়ান বিশেষ করে সুন্নি মুসলমানদের ভোট টানতে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইমাম হাতিপ’ স্কুল ও মসজিদের সংখ্যাও বাড়াচ্ছেন৷ গত এক দশকে তুরস্কে মসজিদের সংখ্যা শতকরা দশভাগ বেড়েছে৷
ছবি: Muhammed Enes Yildirim/AA/Getty Images
১০০ বছর আগের ছবিতে এর্দোয়ানের জবাব
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহারের অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেননি রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান৷ বরং তার কার্যালয় থেকে ১০০ বছর আগের একটি ছবি শেয়ার করা হয়েছে৷ সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নতুন পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নামাজ পড়ছেন ‘আধুনিক তুরস্কের জনক’ মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক৷ ওপরের ছবিতে এর্দোয়ান ও তার স্ত্রী এমিনে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Unal
8 ছবি1 | 8
আগেও এমন করেছেন এর্দোয়ান
ঘরের সমস্যা থেকে নজর সরাতে এর আগেও এর্দোয়ান কূটনৈতিক সংকটকে কাজে লাগিয়েছেন৷ জার্মান সাংবাদিক ডেনিস ইউজেলকে জেলে প্রেরণ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান তুর্কদের হাতে অসংখ্য আর্মেনীয়কে হত্যার বিষয়টি গণহত্যার শামিল কিনা, তা নিয়ে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের দ্বন্দ্বের সময়ও এর্দোয়ানকে এমন কৌশল নিতে দেখা গেছে৷ ঐসব দেশ তুরস্ককে নীচে নামানোর চেষ্টা করছে বলে জনগণের সামনে তুলে ধরেন এর্দোয়ান৷ কারণ তিনি জানেন বিদেশি শক্তির সঙ্গে লড়াই জাতীয়তাবাদী অনেক তুর্কিকে নাড়া দেবে৷