গত কিছুদিন ধরে ফেসবুক খুললেই একটা চ্যাটবটের কথা দেখি৷ চ্যাটজিপিটি৷ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এই অ্যাপ নাকি অনেক কিছু বলে দিচ্ছে, অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে অনায়াসে৷
বিজ্ঞাপন
চ্যাটজিপিটির নানা ব্যবহারও ফেসবুকে তুলে ধরছিলেন অনেকে৷ একজন প্রবাসী লেখকের জীবনে শেয়ার করতে দেখলাম এক ফেসবুক বন্ধুকে৷ সেখানে নানা মিষ্টি মিষ্টি কথা লেখা এবং প্রবাসী সেই লেখক কত ভালো, কত পদক পেয়েছেন সেসব বেশ সুগঠিত ইংরেজি বাক্যে বর্ণনা করা হয়েছে৷
লেখাটি পড়ে আমি মুগ্ধ৷ মনে হচ্ছিল, কারো জীবনী লিখতে এই চ্যাটবট একেবারে আদর্শ৷ কিন্তু আমার এই শুভচিন্তায় বিঘ্ন ঘটালো পোস্টের নীচের এক মন্তব্য৷ যাকে নিয়ে লিখেছে চ্যাটজিপিটি, তিনিই জানালেন যে লেখায় থাকা অনেক তথ্যই ভুল৷ ইন্টারেটে নানা জায়গা থেকে তথ্য নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে সেগুলো বসিয়ে দিয়েছে চ্যাটজিপিটি৷ আর সেসব তথ্য আবার একই নামের একাধিক ব্যক্তির হওয়ায় পুরো লেখাটা পড়তে ভালো লাগলেও আসলে ভুল তথ্যে ভরা৷
চ্যাটজিপিটির লেখা নানাজনের জীবন পড়ে বুঝলাম আসলেই একই কাঠামোতে শুধু কিছু তথ্য বদলে লেখা হয়েছে সবগুলো৷ এবং তাতে যে নানা বিশেষণে একেকজনকে ভূষিত করা হচ্ছে, সেটাও সবার জন্য একই৷ এরকম এক অ্যাপের পক্ষে কোনো পরীক্ষা পাস করাই কঠিন নয়, যদি সেই বিষয় সম্পর্কে অনলাইনে কোথাও সুনির্দিষ্ট তথ্য দেয়া থাকে৷
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ ধরনের ব্যবহার নিয়ে আমি তাই খুব বেশি আশাবাদী নই৷ নিজের জ্ঞান, বিবেচনাবোধ আর সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে লেখালেখি করা মানুষগুলোর বিকল্প হয়ে উঠবে চ্যাটজিপিটি -- এমনটা অদূর ভবিষ্যতে ঘটার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না৷
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার অন্যান্য ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রয়োজন৷ জার্মানিতে এর ব্যবহার নিয়ে গত কয়েকবছর ধরে বেশ আলোচনা হচ্ছে৷ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি ব্যবহার হতে পারে মহামারি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে৷ বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ, জমা করা, যাচাই এবং সেসবের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন ব্যবস্থা গড়তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে৷ একইভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মজবুতেও এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে৷
ইউরোপের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ জার্মানি ইতোমধ্যে কর্মীসংকটে ভুগতে শুরু করেছে৷ ভবিষ্যতে এই সংকট বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ এই পরিস্থিতি বদলাতে যেসব ক্ষেত্রে সম্ভব, সেসব ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহারের চাহিদা তৈরি হয়েছে দেশটিতে৷ বিশেষ করে শিল্প খাতে স্বয়ংচলন বাড়ানোর কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে৷
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়াতে গবেষণায় বাড়তি বিনিয়োগও করছে জার্মানি৷ সমস্যা হচ্ছে, এমন গবেষণা করতে প্রয়োজনীয় চাকুরির অর্ধেক খালি পড়ে আছে৷ অর্থাৎ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করবে এমন গবেষকের সংকটেও ভুগছে জার্মানি৷ অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন এক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে অনেক দূর৷
কৃত্রিম বু্দ্ধিমত্তা: আদি থেকে বর্তমান
বর্তমানে প্রযুক্তি জগতের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় চ্যাটজিপিটি৷ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বু্দ্ধিমত্তা দিয়ে এটি তৈরি৷ এআই প্রযুক্তির শুরু থেকে এই পর্যায়ে আসার পেছনে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনার কথা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Torsten Sukrow/SULUPRESS.DE/picture alliance
দৈনন্দিন জীবনে এআই
স্মার্টফোন খুলতে ফেস আইডির ব্যবহার, ফেসবুকে পছন্দের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, জীবনযাপনে সিরি-আলেক্সার ব্যবহার - এসবের পেছনে আছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ৷ কিন্তু একদিনে এই প্রযুক্তি এত দূর আসেনি৷
ছবি: Reuters/T. Peter
এএনএন কম্পিউটিং সিস্টেম
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রকে কিছু ‘শেখানোর’ মাধ্যম হচ্ছে ‘আর্টিফিসিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্কস’ বা এএনএন কম্পিউটিং সিস্টেম৷ ১৯৪৩ সালে মার্কিন নিউরোফিজিওলজিস্ট ও সাইবারনেটিশিয়ান ওয়ারেন ম্যাককালেক এবং কম্পিউটেশনাল নিউরোসায়েন্টিস্ট ওয়াল্টার পিটসের গবেষণাপত্রে প্রথম এএনএন ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায়৷
ছবি: Axel Bueckert/Zoonar/picture-alliance
প্রথম স্বয়ংক্রিয় রোবট
মার্কিন বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নিউরোফিজিওলজিল্ট ও সাইবারনেটিসিয়ান উইলিয়াম গ্রে ওয়াল্টার ১৯৮৪ সালে এলমার ও এলসি নামে দুটি রোবট তৈরি করেছিলেন৷ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারা প্রথম রোবট এগুলো৷ আলো ও স্পর্শ ব্যবহার করে তারা বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারতো৷
ছবি: United Archives/IMAGO
পড়াশোনার বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি
মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থি (ছবি) ১৯৫৫ সালে প্রথম ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ টার্মটি ব্যবহার করেন৷ এরপর ১৯৫৬ সালে তিনি ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন যেখানে পড়াশোনার বিষয় হিসেবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স স্বীকৃতি পায়৷
ছবি: AP/picture alliance
প্রথম চ্যাটবট
সিরি, আলেক্সার কথা আমরা সবাই জানি৷ তবে ১৯৬৬ সালে ‘এলিজা’ নামে একটি প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়েছিল, যাকে প্রথম এআই চ্যাটবট বলা হয়৷ এলিজা মানুষের কথা বুঝতে পারত, কথাও বলতে পারত৷ যদিও তার নির্মাতা জার্মান-অ্যামেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী ইওসেফ ভাইৎসেনবাউম (ছবি) প্রায়ই বলতেন, এলিজা বুদ্ধিমান নয়৷
স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা এসআরআই-এর ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেন্টার’ ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ‘শেকি’ নামে একটি রোবট তৈরি করেছিল, যেটি নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো৷ শেকির আগে তৈরি সব রোবটকে প্রতিটি ধাপে নির্দেশ দিতে হত৷ কিন্তু শেকির তা প্রয়োজন ছিল না৷ এসআরআই-এর ওয়েবসাইট বলছে শেকি ছিল প্রথম মোবাইল রোবট যার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝার ক্ষমতা ছিল৷
ছবি: SRI International
দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারানো
এআই গবেষণার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে খেলা৷ একটি এআই চেস প্রোগ্রাম ১৯৮০র দশকে চেস মাস্টার ডেভিড লেভিকে খেলায় হারিয়ে দিয়েছিল৷ আর ১৯৯৬ সালে আইবিএম এর ‘ডিপ ব্লু’ কম্পিউটার তখনকার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল৷
ছবি: Stan Honda/AFP/Getty Images
প্রথম রোবটিক খেলনা
একটি মার্কিন কোম্পানি ১৯৯৮ সালে রোবোটিক খেলনা ‘ফার্বি’ বাজারে এনেছিল৷ প্রথমে এটি ‘ফার্বিশ’ বলতো৷ কিন্তু তাকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা ছিল যে, তাকে ইংরেজি ভাষা ও শব্দ শেখানো শুরু করলে সে একসময় তা বলতে পারতো৷ ফার্বির মাধ্যমেই সাধারণ মানুষ প্রথম বুঝতে পারে যে, চাইলে যন্ত্রকে কিছু শেখানো যায়৷
ছবি: PA Fearn/dpa/picture alliance
জিওপার্ডি! কুইজ শো জয়
২০১০ ও ২০১১ সালে আইবিএম-এর ওয়াটসন কম্পিউটার সিস্টেম মার্কিন টেলিভিশন কুইজ শো ‘জিওপার্ডি!’তে অংশ নিয়ে দুজন চ্যাম্পিয়নকে হারাতে সক্ষম হয়৷
ছবি: IBM/dpa/picture alliance
ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্ট সিরির আগমন
২০১১ সালে অ্যাপল ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্ট ‘সিরি’ নিয়ে আসে৷ এটি মানুষের কথা বুঝতে পেরে সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারে৷ এআই জগতে সেই সময় এটি একটি অন্যতম সাফল্যের ঘটনা ছিল৷ সিরির পর এসেছে আলেক্সা, গুগল- যা এখন প্রায় সবাই ব্যবহার করে থাকে৷
ছবি: Jakub Porzycki/NurPhoto/picture alliance
গার্ডিয়ানের প্রবন্ধ লিখেছিল রোবট
২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট জিপিটি-৩৷ এটি মার্কিন এআই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই-এর ল্যাঙ্গুয়েজ-জেনারেটর৷ প্রবন্ধটি পড়তে এই লিংকে (shorturl.at/cjnzT) ক্লিক করুন৷
ছবি: Getty Images
রোবোকাপ
রোবোটিকস ও এআই গবেষণা এগিয়ে নিতে ১৯৯৬ সালে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক রোবোকাপ টুর্নামেন্ট শুরু করেছিলেন৷ এটি প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে৷ ‘রোবট সকার ওয়ার্ল্ড কাপের’ সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে রোবোকাপ৷
ছবি: JACK TAYLOR/AFP/Getty Images
বিশ্বকাপের বলে এআই প্রযুক্তি
কাতার বিশ্বকাপে অফসাইড ধরতে এআই প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েছিল ফিফা৷ এর সাহায্যে বলের মধ্যে থাকা সেন্সর ও ছাদে থাকা ১২টি ক্যামেরার মাধ্যমে ফুটবলার ও বলের অবস্থান আরও ভালোভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছিল৷
ছবি: DW
চ্যাটজিপিটি
মার্কিন ওপেনএআই কোম্পানির তৈরি চ্যাটজিপিটি একটি শক্তিশালী মেশিন লার্নিং মডেল৷ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের মতো লেখা বা টেক্সট তৈরি করার ক্ষমতা৷ এর মানে হলো, কোনো একটি বিষয়ে একজন মানুষ যেমন প্রত্যুত্তর দিতে পারে, চ্যাটজিপিটিও সেরকমই জবাব লিখে জানাতে পারে৷ এটি চ্যাটবটের মতো অ্যাপগুলোর জন্য বিশেষভাবে উপযোগী৷