রোবট বা যন্ত্রের দখলে চলে যাওয়া ভবিষ্যৎ কাল্পনিক পৃথিবী নিয়ে বহু বছর ধরেই গল্প ফেঁদে আসছেন হলিউডের চিত্রনাট্যকাররা৷ এবার তারাই যন্ত্রের কাছে নিজেদের চাকরি হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন৷ শুরু করেছেন ধর্মঘটও৷
বিজ্ঞাপন
টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহারে রাশ টেনে ধরার দাবি তুলেছে দ্য রাইটার্স গিল্ড অব অ্যামেরিকা-ডাব্লিউজিএ৷ তবে স্টিমিং সেবায় মুনাফার কাটতি আর পড়তি বিজ্ঞাপনী আয়ে ধুঁকতে থাকা হলিউড স্টুডিওগুলো সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে৷
স্টুডিওগুলোর পক্ষে চুক্তির মধ্যস্থতাকারী অ্যালায়েন্স অব মোশন পিকচার্স অ্যান্ড টেলিভিশন প্রোডিউসার্সের মুখপাত্রের সঙ্গে এই বিষয়ে রয়টার্সের তরফে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি৷
গত কয়েক বছর ধরেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে হলিউড পাড়ায় বিতর্ক চলছে৷ শেষমেস সোমবার থেকে ধর্মঘটে নেমেছেন মার্কিন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের চিত্রনাট্যকাররা৷
ডাব্লিউজিএর সমঝোতা কমিটির সদস্য চিত্রনাট্যকার জন অগাস্ট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তাদের উদ্বেগের মূল দুইটি কারণ উল্লেখ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা চাই না আমাদের উপকরণ দিয়ে তাদের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার) খাওয়ার যোগান দিতে৷ সেই সঙ্গে আমরাও তাদের অপেশাদার খসড়া লেখা ঠিক করার ভূমিকায় থাকতে চাই না৷''
কৃত্রিম বু্দ্ধিমত্তা: আদি থেকে বর্তমান
বর্তমানে প্রযুক্তি জগতের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় চ্যাটজিপিটি৷ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বু্দ্ধিমত্তা দিয়ে এটি তৈরি৷ এআই প্রযুক্তির শুরু থেকে এই পর্যায়ে আসার পেছনে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনার কথা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Torsten Sukrow/SULUPRESS.DE/picture alliance
দৈনন্দিন জীবনে এআই
স্মার্টফোন খুলতে ফেস আইডির ব্যবহার, ফেসবুকে পছন্দের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, জীবনযাপনে সিরি-আলেক্সার ব্যবহার - এসবের পেছনে আছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ৷ কিন্তু একদিনে এই প্রযুক্তি এত দূর আসেনি৷
ছবি: Reuters/T. Peter
এএনএন কম্পিউটিং সিস্টেম
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রকে কিছু ‘শেখানোর’ মাধ্যম হচ্ছে ‘আর্টিফিসিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্কস’ বা এএনএন কম্পিউটিং সিস্টেম৷ ১৯৪৩ সালে মার্কিন নিউরোফিজিওলজিস্ট ও সাইবারনেটিশিয়ান ওয়ারেন ম্যাককালেক এবং কম্পিউটেশনাল নিউরোসায়েন্টিস্ট ওয়াল্টার পিটসের গবেষণাপত্রে প্রথম এএনএন ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায়৷
ছবি: Axel Bueckert/Zoonar/picture-alliance
প্রথম স্বয়ংক্রিয় রোবট
মার্কিন বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নিউরোফিজিওলজিল্ট ও সাইবারনেটিসিয়ান উইলিয়াম গ্রে ওয়াল্টার ১৯৮৪ সালে এলমার ও এলসি নামে দুটি রোবট তৈরি করেছিলেন৷ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারা প্রথম রোবট এগুলো৷ আলো ও স্পর্শ ব্যবহার করে তারা বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারতো৷
ছবি: United Archives/IMAGO
পড়াশোনার বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি
মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থি (ছবি) ১৯৫৫ সালে প্রথম ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ টার্মটি ব্যবহার করেন৷ এরপর ১৯৫৬ সালে তিনি ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন যেখানে পড়াশোনার বিষয় হিসেবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স স্বীকৃতি পায়৷
ছবি: AP/picture alliance
প্রথম চ্যাটবট
সিরি, আলেক্সার কথা আমরা সবাই জানি৷ তবে ১৯৬৬ সালে ‘এলিজা’ নামে একটি প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়েছিল, যাকে প্রথম এআই চ্যাটবট বলা হয়৷ এলিজা মানুষের কথা বুঝতে পারত, কথাও বলতে পারত৷ যদিও তার নির্মাতা জার্মান-অ্যামেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী ইওসেফ ভাইৎসেনবাউম (ছবি) প্রায়ই বলতেন, এলিজা বুদ্ধিমান নয়৷
স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা এসআরআই-এর ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেন্টার’ ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ‘শেকি’ নামে একটি রোবট তৈরি করেছিল, যেটি নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো৷ শেকির আগে তৈরি সব রোবটকে প্রতিটি ধাপে নির্দেশ দিতে হত৷ কিন্তু শেকির তা প্রয়োজন ছিল না৷ এসআরআই-এর ওয়েবসাইট বলছে শেকি ছিল প্রথম মোবাইল রোবট যার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝার ক্ষমতা ছিল৷
ছবি: SRI International
দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারানো
এআই গবেষণার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে খেলা৷ একটি এআই চেস প্রোগ্রাম ১৯৮০র দশকে চেস মাস্টার ডেভিড লেভিকে খেলায় হারিয়ে দিয়েছিল৷ আর ১৯৯৬ সালে আইবিএম এর ‘ডিপ ব্লু’ কম্পিউটার তখনকার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল৷
ছবি: Stan Honda/AFP/Getty Images
প্রথম রোবটিক খেলনা
একটি মার্কিন কোম্পানি ১৯৯৮ সালে রোবোটিক খেলনা ‘ফার্বি’ বাজারে এনেছিল৷ প্রথমে এটি ‘ফার্বিশ’ বলতো৷ কিন্তু তাকে এমনভাবে প্রোগ্রাম করা ছিল যে, তাকে ইংরেজি ভাষা ও শব্দ শেখানো শুরু করলে সে একসময় তা বলতে পারতো৷ ফার্বির মাধ্যমেই সাধারণ মানুষ প্রথম বুঝতে পারে যে, চাইলে যন্ত্রকে কিছু শেখানো যায়৷
ছবি: PA Fearn/dpa/picture alliance
জিওপার্ডি! কুইজ শো জয়
২০১০ ও ২০১১ সালে আইবিএম-এর ওয়াটসন কম্পিউটার সিস্টেম মার্কিন টেলিভিশন কুইজ শো ‘জিওপার্ডি!’তে অংশ নিয়ে দুজন চ্যাম্পিয়নকে হারাতে সক্ষম হয়৷
ছবি: IBM/dpa/picture alliance
ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্ট সিরির আগমন
২০১১ সালে অ্যাপল ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্ট ‘সিরি’ নিয়ে আসে৷ এটি মানুষের কথা বুঝতে পেরে সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারে৷ এআই জগতে সেই সময় এটি একটি অন্যতম সাফল্যের ঘটনা ছিল৷ সিরির পর এসেছে আলেক্সা, গুগল- যা এখন প্রায় সবাই ব্যবহার করে থাকে৷
ছবি: Jakub Porzycki/NurPhoto/picture alliance
গার্ডিয়ানের প্রবন্ধ লিখেছিল রোবট
২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট জিপিটি-৩৷ এটি মার্কিন এআই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই-এর ল্যাঙ্গুয়েজ-জেনারেটর৷ প্রবন্ধটি পড়তে এই লিংকে (shorturl.at/cjnzT) ক্লিক করুন৷
ছবি: Getty Images
রোবোকাপ
রোবোটিকস ও এআই গবেষণা এগিয়ে নিতে ১৯৯৬ সালে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক রোবোকাপ টুর্নামেন্ট শুরু করেছিলেন৷ এটি প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে৷ ‘রোবট সকার ওয়ার্ল্ড কাপের’ সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে রোবোকাপ৷
ছবি: JACK TAYLOR/AFP/Getty Images
বিশ্বকাপের বলে এআই প্রযুক্তি
কাতার বিশ্বকাপে অফসাইড ধরতে এআই প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েছিল ফিফা৷ এর সাহায্যে বলের মধ্যে থাকা সেন্সর ও ছাদে থাকা ১২টি ক্যামেরার মাধ্যমে ফুটবলার ও বলের অবস্থান আরও ভালোভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছিল৷
ছবি: DW
চ্যাটজিপিটি
মার্কিন ওপেনএআই কোম্পানির তৈরি চ্যাটজিপিটি একটি শক্তিশালী মেশিন লার্নিং মডেল৷ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের মতো লেখা বা টেক্সট তৈরি করার ক্ষমতা৷ এর মানে হলো, কোনো একটি বিষয়ে একজন মানুষ যেমন প্রত্যুত্তর দিতে পারে, চ্যাটজিপিটিও সেরকমই জবাব লিখে জানাতে পারে৷ এটি চ্যাটবটের মতো অ্যাপগুলোর জন্য বিশেষভাবে উপযোগী৷
ছবি: Jakub Porzycki/NurPhoto/picture alliance
14 ছবি1 | 14
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হলিউডডের চলচ্চিত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বেড়েই চলেছে৷ এআই বয়স্ক শিল্পীদের মুখের বলিরেখা মুছে দিতে সহায়তা করছে, অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রকে বাস্তবের মতো করে তুলে ধরছে, এমনকি চিত্রনাট্য তৈরিতেও এআই-এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার চলছে৷
এমন অবস্থায় চলচ্চিত্র জগতের সৃজনশীল এই পেশাটি কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দখলে চলে যাবে? সিডনি ইউনিভার্সিটির মোটুস ল্যাবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মাইক সেমুর বলেন, একটা সময় ভাবা হয়েছিল যে যন্ত্র সৃজনশীল কাজ অন্তত মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না৷ সেই বিশ্বাসে চিড় ধরলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিত্রনাট্যকারদের সহায়তা করতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷ অন্তত কোন কিছুর শুরুর শূন্যতা কাটাতে প্রযুক্তি ভূমিকা রাখতে পারে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি দাবি করছি না এআই অতি বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে এবং ‘সিটিজেন কেইন' তৈরি করে ফেলবে৷ কেননা এটা যথার্থও হবে না৷''
তারপরও চলচ্চিত্রের কাহিনি রচয়িতাদের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷ যেমন, চিত্রনাট্যকার ওয়ারেন লেইট মনে করেন এর ফলে সামনের দিনে প্রযোজনা সংস্থা চিত্রনাট্যকারদের প্রথম খসড়ার বদলে দ্বিতীয় খসড়া তৈরির জন্য ভাড়া করবে৷ যার কারণে তাদেরকে কম টাকা দেয়া হবে৷
চিত্রনাট্যকারদের ইউনিয়নের প্রস্তাব চ্যাটজিপিটির মতো কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি করে দেয়া রচনাকে ‘সাহিত্য উপকরণ' বা মূল উপকরণ' হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করা যাবে না৷ অর্থাৎ, এই ধরনের লেখা যদি চিত্রনাট্যকারকে দেয়া হয় এজন্য তার মজুরি কমানো যাবে না৷ সেই সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দক্ষ করে তোলার কাজে মানুষের রচিত বিদ্যমান চিত্রনাট্য ব্যবহার না করারও দাবি তুলেছেন তারা৷ কারণ এর ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে মেধাস্বত্ত্ব চুরির দুয়ার খুলে যেতে পারে৷
ডাব্লিউজিএ-এর প্রধান সমঝোতাকারী অ্যালেন স্টুটজম্যান বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে তাদের সদস্যরা ‘নকল করার যন্ত্র' হিসেবে অভিহিত করেন৷ ‘‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের লেখকদের জায়গায় প্রতিস্থাপন করা উচিত হবে না৷ এই চেষ্টা না করার পেছনে আমাদের যৌক্তিক প্রস্তাব রয়েছে,'' বলেন তিনি৷