বাংলাদেশের পত্রিকায় মাঝেমাঝেই এসব খবর দেখা যায়৷ আলুর উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক৷ কিংবা বেগুন বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিচ্ছেন কৃষক৷ এই পরিস্থিতি বদলাতে পারে প্রযুক্তি৷
বিজ্ঞাপন
কৃষিকাজের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ আশা জাগানোর মতো ব্যাপার৷ কৃষি প্রধান বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিতে গেলে এর বিকল্প নেই৷ শুধু শহরমুখী স্রোত কিছুটা হলেও কমতে পারে যদি কৃষিকাজকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলা যায়৷ কৃষককে সহায়তা করা যায় তাঁর কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য পেতে৷
বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে কাজটি বেশ সহজ, কেননা, মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন পৌঁছে যাচ্ছে দ্রুত, ইন্টারনেট সংযোগও বলতে গেলে বাংলাদেশের সর্বত্র সহজলভ্য৷ কোন অঞ্চলে কোন কৃষিপণ্যের ফলন বেশি আর কোথায় তার চাহিদা বেশি সেই তথ্য কৃষকের কাছে স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে পৌঁছানো গেলে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে কাজটা অনেকটা সহজ হয়ে যেতো তাঁর কাছে৷ সেক্ষেত্রে মধ্যসত্ত্বভোগীদের বিপুল মুনাফা অর্জনের পথও কিছুটা কমতো৷
আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য কিছু অ্যাপ ইতোমধ্যে চালু হয়েছে৷ ‘কৃষি প্রযুক্তি ভাণ্ডার' নামে বাংলা ভাষায় একটি অ্যাপ তৈরি করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বারি)৷ এই অ্যাপটি ব্যবহার করে ‘বারি'কতৃক উদ্ভাবিত ফসলের চাষ, রোগবালাই নিরাময় ও সার ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন তথ্য সহজে পাওয়া যাবে৷ এরকম অ্যাপ আরো কয়েকটি রয়েছে৷
প্রকৃতি ও মানুষ বাঁচাতে দেলোয়ার ও তাঁর সঙ্গীদের উদ্যোগ
কুষ্টিয়ার ছেলে দেলোয়ার জাহান ও তাঁর সঙ্গীরা মিলে ‘প্রাকৃতিক কৃষি’ নামে একটি আন্দোলন শুরু করেছেন৷ সার ও কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াই কৃষকদের কৃষিকাজে উৎসাহিত করছেন তাঁরা৷
ছবি: Delowar Jahan
বিষমুক্ত খাবারের অঙ্গীকার
বাংলাদেশে ফসলের ক্ষেতে প্রতি মিনিটে ৭২ কেজি ‘বিষ’ ছিটানো হয় বলে জানান দেলোয়ার জাহান৷ এতে মাটির যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে যে ফসল উৎপাদন করা হচ্ছে তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর৷ এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষিকাজ পদ্ধতিকে উৎসাহিত করছেন দেলোয়ার ও তাঁর সঙ্গীরা৷
ছবি: Delowar Jahan
‘প্রাকৃতিক কৃষি’ আন্দোলন
দেলোয়ার ও তাঁর সঙ্গীরা প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত৷ এর মাধ্যমে তাঁরা আশেপাশের কৃষকদের দেখান যে, এভাবেও ফসল উৎপাদন করে লাভ করা সম্ভব৷ এছাড়া কৃষকদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনায় বসে প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষিকাজের নতুন নতুন পদ্ধতি বের করেন তাঁরা৷ ছবিতে দেলোয়ারকে কৃষকদের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Delowar Jahan
শুরুর কথা
২০১৩ সালে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আমতলি গ্রামে জমি লিজ নিয়ে গ্রীষ্মকালীন সবজি উৎপাদন শুরু করেন দেলোয়ার ও তাঁর সঙ্গীরা৷ বর্তমানে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার হাজীপুর গ্রামে দেড় একর জমিতে প্রায় ৪০ রকমের সবজি উৎপাদিত হয় বলে জানান তিনি৷ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত দেলোয়ার নিজে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে জড়িত ছিলেন৷ আর তাঁর সঙ্গীদের পরিবারও কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত৷
ছবি: Delowar Jahan
লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন দেলোয়ার
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে অনার্সে দ্বিতীয় ও মাস্টার্সে যৌথভাবে প্রথম হয়েছিলেন দেলোয়ার৷ এরপর সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন৷ কিন্তু মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন ভেবে সেখানে যাননি তিনি৷ ‘প্রাকৃতিক কৃষি’র পাশাপাশি ঢাকায় একটি পত্রিকায় কৃষি বিষয়ক সাংবাদিকতা করছেন দেলোয়ার৷
ছবি: Delowar Jahan
সঙ্গীদের কথা
দেলোয়ারের সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন তরুণ-তরুণী৷ তাঁদের প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়ালেখা শেষ করেছেন৷ ছবিতে দুজনকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Delowar Jahan
সাফল্যের কথা
দেলোয়ারদের যেখানে খামার আছে, সেই মানিকগঞ্জ ছাড়াও ঝিনাইদহ, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নওগাঁ জেলার অনেক কৃষক বর্তমানে প্রাকৃতিক উপায়ে ফসল উৎপাদন করছেন৷ ছবিতে দেলোয়ারের সঙ্গীদের ফসল তুলতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Delowar Jahan
পণ্যের বাজার
বিভিন্ন জেলার কৃষকদের প্রাকৃতিক উপায়ে চাষ করা সবজি, ফল ঢাকায় কিনতে পাওয়া যায়৷ এজন্য মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডে ‘প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র’ চালু করা হয়েছে৷ ছবিটি বিপণন কেন্দ্রের সামনে তোলা৷
ছবি: Delowar Jahan
যা পাওয়া যায়
কী চান? শাক-সবজি, ফল, চাল, ডাল, হাতে ভাজা মুড়ি, মসলা, তেল, ঘি, দুধ, ডিম; বলে শেষ করা যাবে না৷ মাঝেমধ্যে বাসায় চাষের কাজে ব্যবহারের জন্য প্রাকৃতিক সারও পাওয়া যায় ঐ কেন্দ্রে৷ হালনাগাদ তথ্য পেতে ‘প্রাকৃতিক কৃষি’র ফেসবুক পাতা দেখা যেতে পারে৷ এজন্য উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Delowar Jahan
নিরাপদ ফসল
ঢাকায় প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের কিষাণীরা তাঁদের উৎপাদিত ফসল নিয়ে এসেছেন৷
ছবি: Delowar Jahan
গ্রামে যাওয়া হয়নি
দেলোয়ার কুষ্টিয়ার ছেলে৷ কিন্তু নিজের গ্রামে না গিয়ে মানিকগঞ্জে কাজ করার কারণ বলতে গিয়ে তিনি জানান, সেটি সম্ভব ছিল না৷ ‘‘যখন পড়ালেখা করতাম তখন গ্রামে গেলে সবাই জানতে চাইতো কতদিন আছি কিংবা কবে যাব? তখনই বুঝতে পারি যে, আসলে গ্রামে ফেরা সম্ভব না,’’ ডয়চে ভেলেকে বলেন দেলোয়ার৷
ছবি: Delowar Jahan
চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষিকাজ
বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে কেউ যদি উচ্চশিক্ষার পর চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষিকাজে জড়িত হয়ে জীবনযাপন করতে চায় তাহলে সেটি সম্ভব বলে মনে করেন দেলোয়ার৷ ‘‘কেউ যদি সমন্বিত খামার করেন, যেখানে মাছ চাষ থাকবে, গরু থাকবে, দুধের জন্য ছাগল থাকবে, হাঁস থাকবে, সবজি থাকবে- তাহলে সম্ভব৷’’
ছবি: Delowar Jahan
তবে...
দেলোয়ার বলেন, সমস্যা হচ্ছে তরুণরা মনে করে, কৃষিকাজ মানে অচ্ছুতের কাজ৷ তাই এটি কেউ করতে চায় না৷ ‘‘কারণ চারপাশে এত রং, এত প্রত্যাশা জীবনে যে, কেউ আসলে কৃষিকাজ করতে চায় না৷ প্রচুর ছেলেমেয়ে আমাদের কাছে (প্রাকৃতিক কৃষির কাজ দেখতে) আসে৷ যে পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে আসে তার দ্বিগুণ পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে চলে যায়’’, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানান দেলোয়ার৷
ছবি: Delowar Jahan
12 ছবি1 | 12
তবে বাংলাদেশের কৃষকদের পণ্য বিক্রির জন্য সুবিধাজনক অ্যাপের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি৷ পশ্চিমা কৃষিকদের কাছে জনপ্রিয় এরকম একটি অ্যাপের নাম ‘এজিমোবাইল৷' এটি কৃষককে তাঁর কৃষিপণ্য ন্যয্যমূল্যে বিক্রির জন্য উপযুক্ত বাজারের সন্ধান দেয়৷ পাশাপাশি আবহাওয়াসহ কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন হালনাগাদ তথ্যও পাওয়া যায় অ্যাপটি থেকে৷ এরকম অ্যাপ বাংলাদেশের কৃষকদেরও সহায়তা করতে পারে৷
কেউ কেউ হয়ত বলবেন, কৃষকরা অ্যাপ ব্যবহারের মতো শিক্ষা কোথা থেকে পাবেন? এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকায় থাকতে হবে তরুণ প্রজন্মকে৷ বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তির ব্যবহার দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে৷ তাদের তাই আলাদা করে মোবাইল ব্যবহার বা অ্যাপ ইন্সটল করা শেখাতে হয়না৷ এ সব যাদের দরকার, তাদের সহায়তা করতে পারে তরুণ প্রজন্ম৷