কৃষিজমির উর্বরতা ফেরাতে প্রয়োজন জৈব চাষ
৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭এর ফলে কৃষি জমি হারাচ্ছে জৈবিক গুণাবলী৷ ফসলের উৎপাদন আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে কৃত্রিম সারের ওপর৷ এ সব তথ্যের প্রমাণ মিলল বছর কয়েক আগে যখন পেশাগত কাজে উত্তরাঞ্চলে গেলাম৷
কৃষির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কি পড়েছে তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য মাঠ পর্যায়ের তথ্য দরকার ছিল৷ রংপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা হলো৷ প্রতিবেদনের জন্য তাঁদের দেয়া প্রয়োজনীয় নানা তথ্যের মধ্যে দিন দিন কৃষিজমির উর্বরতা কমে যাওয়ার কথাও জানালেন কৃষকেরা৷
নজির তাঁদেরই একজন৷ ২৫ কি ২৬ বছর বয়সি ছিপছিপে এই তরুণ কৃষক কাজ করছিলেন মাঠে৷ শীতের সবজির বীজ বোনার কিছুদিন পর ক্ষেত নিড়ান দিচ্ছিলেন৷
কথা বলতে গিয়ে জানা গেল, ছোটবেলায় নজিরের বাপ-চাচারা যেভাবে চাষ করতেন এখন সার ব্যবহার ও চাষ পদ্ধতিতে কিছুটা বদলেছে৷
এমনকি ক'বছর আগেও যতটা সার লাগত, এখন তার চেয়ে বেশি লাগছে৷ নতুন নতুন রোগের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে৷ আর ফলনও সন্তোষজনক নয়৷ সব মিলিয়ে তাঁর খরচ বেড়েছে৷
খরচ বাড়ার কথা জানিয়েছেন আরেক কৃষক আবিদ মিয়ারও৷ প্রৌঢ় এই কৃষক তাঁর সবজি ক্ষেতে কীটনাশক ছিটাচ্ছিলেন৷ তিনিও জানালেন, আগের চেয়ে কীটনাশক বেশি দিতে হয়৷ কারণ রোগ বালাই বেড়েছে৷
দু'জনই একটি বিষয়ে একমত যে, ভালো ফলনের জন্য আগে যতটা খরচ আর শ্রম দিতে হত, এখন তার চেয়ে বেশি দিতে হয়৷ অর্থাৎ সমৃদ্ধ ফলনের জন্য জমির প্রাকৃতিক সক্ষমতা কমছে৷ প্রশ্ন হলো, এর কারণ কী?
কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৫২ লাখ হেক্টর৷ আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ সাড়ে ৮৫ লাখ হেক্টর৷
প্রায় দেড় কোটি কৃষি পরিবার এই জমির প্রায় শতকরা ৮৮ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে৷ এদের অধিকাংশই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক৷
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩.৫ শতাংশ থাকা বাঞ্ছনীয় হলেও এ দেশের বেশির ভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১-১ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং কিছু কিছু জমিতে এর পরিমাণ ১ শতাংশের চেয়েও কম৷
এর মধ্যে ৩৭ লাখ হেক্টর জমিতে ফসফরাস, ২৭ দশমিক ২ লাখ হেক্টর জমিতে পটাশিয়াম, ৩৩ দশমিক ১ লাখ হেক্টর জমিতে গন্ধক, ২৭ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর জমিতে দস্তা, ২৪ দশমিক ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরন, ৩৫ দশমিক ৬ লাখ হেক্টর জমিতে অত্যাধিক থেকে অধিক অম্লের অভাব রয়েছে৷ এছাড়া অনেক জমিতে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাব৷
কৃষিবিদদের মতে, বেশি ফলন পাবার আশায় বেশি বেশি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন কৃষকেরা৷ এতে জমির জৈব পদার্থ কমে যায়৷ হারিয়ে যায় উর্বরা শক্তি৷
আরো কারণ আছে৷ বেশি লাভের আশায় একই জমিতে একই ফসল বারবার চাষ করেন অনেকেই৷ কিন্তু জমির উর্বরা শক্তি ঠিক রাখতে প্রয়োজন নানা ধরনের ফসল চাষ৷ উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ফসল চাষও জমির উর্বরতা কমার কারণ৷
এমনিতেই প্রতিদিন কমছে আবাদি জমির পরিমাণ৷ এক হিসেবে দেখা যায়, দিনে দুই হাজার বিঘা জমি কৃষি থেকে অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে৷ তামাক ও চিংড়ি চাষের ফলেও প্রতি বছর ২৪ হাজার বিঘা জমি কৃষিকাজের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে৷
এছাড়া ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাস ও নগরায়নের প্রয়োজনে অবকাঠামো নিশ্চিত করতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে কৃষি জমি৷ হিসেব অনুযায়ী, গত ১১ বছরে ২৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ একর কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়ায় কমে গেছে ধান চাষ৷
এ অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন কৃষিজমির উৎকৃষ্ট ব্যবহার৷ সেক্ষেত্রে জৈব পদ্ধতিতে চাষ সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে৷
এই পদ্ধতির সুবিধা হলো, এতে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয় স্বল্পমাত্রায়৷ গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, জৈব সার প্রয়োগ ও জৈব বালাইনাশক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল ও সবজির উৎপাদন খরচ শতকরা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব৷
জৈব সার রাসায়নিক সারের চেয়ে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ খরচ কমায়৷ তবে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে যেহেতু হরমোন বা কৃত্রিম সার ব্যবহৃত হয় না, তাই আখেরে দাম একটু বেশিই পড়ে৷
এছাড়া ফরমালিন জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার না করায় সংরক্ষণ ব্যয়ও বেশি৷ তবে সব মিলিয়ে বাড়তি এ খরচ ১০ থেকে ২০ ভাগের বেশি নয়৷
সে হিসেবে অজৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত আলু দাম কেজি প্রতি ২০ টাকা হলে, জৈব পদ্ধতিতে ২২ থেকে ২৪ টাকা হবার কথা৷ এসব চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক যে মাত্রার স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে তার তুলনায় বাড়তি এ দাম খুব বেশি কিছু কি?
এ সম্পর্কে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷