সংযুক্ত আরব আমিরাত বলতে গেলে পুরোটাই মরুভূমি। দেশটিকে তাদের খাদ্যের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। খাদ্যের এ জোগান অব্যাহত রাখতে দেশটি বিদেশের মাটিতে কৃষিখাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে।
কিন্তু মারাত্মক সংক্রামক করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এখন লকডাউনে। ফলে খাদ্য সরবরাহ এবং কৃষি উৎপাদন হুমকির মুখে। বেশিরভাগ দেশে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ।
এ অবস্থায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের খাদ্য আমদানি প্রক্রিয়াও ঝুঁকিতে পড়েছে। দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে স্থানীয় কৃষি খামারগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা করছেন এর সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা।
দুবাইয়ের একটি খামারের প্রধান নির্বাহী ওমর আল-জুনদি বলেন, ‘‘এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। লকডাউনে সীমান্ত ও বিমানবন্দর বন্ধ থাকায় খাদ্য আমদানির উপর তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’’
ওমরের খামার ‘বাদিয়া ফার্মস’-এ প্রতিদিন গড়ে দুইশ থেকে আড়াইশ কেজি শাক উৎপাদিত হয়। তার খামারে ফল এবং সবজি চাষও হয়।
তিনি বলেন, ‘‘আমরা জানি এ মহামারি বিশ্বকে পুরোপুরি পাল্টে দেবে। সরকার নিজের অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে স্থানীয়ভাবে কৃষি উৎপাদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্প স্থাপনের দিকে মনযোগ দেবে। খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত ও নির্বিঘ্ন রাখতে তাদের এটা করতে হবে।’’
সংযুক্ত আরব আমিরাত বেশিরভাগ মানুষের কাছে পরিচিত তেল আর বিশাল বিশাল অট্টালিকা ও ইমারতের জন্য৷ কিন্তু সেখানকার আরো একটা জিনিস বিশ্ববিখ্যাত৷ আর তা হলো উটের দুধ৷
ছবি: DW/M. Marekউটের দুধ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় দুবাইতে৷ শহর থেকে মাত্র আধা ঘণ্টা দূরত্বে এমিরেটস ইন্ডাস্ট্রি ফর ক্যামেল মিল্ক অ্যান্ড প্রডাক্টস-এর সেন্টার, যেখানে ২০০৬ সাল থেকে উৎপাদন শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Marek৪২০০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে দুবাই-এর এই উটের দুধের খামার, যা ২১০ টি ফুটবল মাঠের সমান৷
ছবি: DW/M. Marekএকটি ঘরে একসাথে থাকে ২৫টি উট৷ এরা দলবদ্ধভাবে থাকতে ভালোবাসে৷
ছবি: DW/M. Marekউট যেমন চালাক, তার জেদও তেমনি বেশি৷ আপনি তখনই উটের দুধ দোয়াতে পারবেন যখন সে তার সন্তানকে পেট ভরে দুধ খাওয়ানো শেষ করবে৷
ছবি: DW/M. Marekএক দিনে এক একটি স্ত্রী উট সর্বোচ্চ সাত লিটার দুধ দিতে পারে৷ দিনে দু’বার দুধ দোয়া হয়৷
ছবি: DW/M. Marekখামার থেকে দিনে ৬ হাজার লিটার দুধ প্যাকেটজাত করা হয়৷ গরুর দুধের চেয়ে এই দুধে চর্বির মাত্রা প্রায় অর্ধেক৷ আর ভিটামিন সি তিন থেকে পাঁচগুণ বেশি৷ ক্যালসিয়ামের পরিমাণও বেশি৷
ছবি: DW/M. Marekমোট উৎপাদনের দুই তৃতীয়াংশ তরল আকারে বাজারে ছাড়া হয়, বাকিটা গুড়ো দুধ হিসেবে বাজারজাত করা হয়৷
ছবি: DW/M. Marek২০০৮ সাল থেকে উটের দুধ দিয়ে চকলেট বানানো শুরু হয়েছে৷ প্রতি বছর ১০০ টন চকলেট উৎপাদন হয়৷ কিন্তু এ জন্য উটের দুধ অস্ট্রিয়ায় পাঠানো হয়৷
ছবি: DW/M. Marekঅস্ট্রিয়া থেকে দুধের মণ্ড সংযুক্ত আরব আমিরাতে আসে, এরপর আইভরি কোস্ট থেকে আসে কোকোয়া পাউডার৷ আর ভ্যানিলা আসে মাদাগাস্কার থেকে৷ এরপর দুবাইতে বানানো হয় চকলেট৷
ছবি: DW/M. Marek৭০ গ্রাম চকলেটের প্যাকেট বিক্রি হয় ৬ ইউরোতে৷ চকলেট নির্মাতা কোম্পানির নাম আল নাসমা৷ চকলেটের দামের ৪৯ ভাগ পায় অস্ট্রিয়া৷
ছবি: DW/R. Baumgarten অত্যন্ত গরম আবহাওয়া এবং পানির অভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে স্বাভাবিক কৃষিকাজ সম্ভব নয়। সেখানে ভার্টিক্যাল ফার্মিং অর্থাৎ বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি ঘরের মধ্যে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে কৃষিপণ্য উৎপাদন করা হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অতীতে সরকার এরকম ব্যয়বহুল কিছু প্রকল্প শুরু করলেও পরে সেগুলো বাদ দিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু তেল সমৃদ্ধ দেশটি পেট্রোডলারের জোরে আবারও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৈরী আবহাওয়ায় কম পানি ব্যবহার করে বাণ্যিজকভাবে কৃষি পণ্য উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবু ধাবি ২০১৯ সালে প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি পণ্য উৎপাদন প্রকল্পে ২৭ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেয়।
এ বছর এপ্রিলে আবু ধাবি ইনভেস্টমেন্ট অফিস (এডিআইও) ভার্টিক্যাল কৃষিখামার নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারোফার্মস-সহ চারটি কোম্পানিকে ১০ কোটি মার্কিন ডলার দেয়।
অ্যারোফার্মস-এর প্রধান নির্বাহী ডেভিড রোজেনবার্গ বলেন, ‘‘যেখানে বিশ্বের কোথাও কোথাও বলা হয় আগে প্রমাণ করে তারপর কথা বলতে এসো। সেখানে ইউএই ভাবছে, ‘‘আমি এটা প্রথমে করবো তারপর এটাকে আরো বড় এবং ভালো করবো' তারা এই মানসিকতা নিয়ে এগুচ্ছে।’’
অ্যারোফার্মস আবু ধাবিতে আট হাজার ২০০ বর্গ মিটারের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার স্থাপন করেছে। সেখানে তারা তাজা ফলমূল এবং সবজি উৎপাদন করে ন্যায্য মূল্যে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করবে।
অ্যারোফার্মসের দাবি, তারা কিছু শস্য মাঠের চেয়ে ৯৫ শতাংশ কম পানি খরচ করে উৎপাদন করতে সক্ষম। ফলে খরচ কমে আসবে।
‘‘যুক্তরাষ্ট্রে আমরা আমাদের পণ্যের দাম মাঠে ক্ষেতে উৎপাদিত পণ্যের দামের সমপর্যায়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। আমরা এখানেও এটা করতে চাই। এটাই হবে আমাদের সক্ষমতার পরীক্ষা। আশা করি আমরা জিতবো।’’
লকডাউনের কারণে অনেক দেশেই এখন কৃষি শ্রমিকের অভাব দেখা দিয়েছে। যার অর্থ, এ বছর লাখ লাখ টন শস্য ক্ষেতেই পড়ে থেকে নষ্ট হবে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে আবু ধাবিতে এক লাখ ২২ হাজার ৫৫০ টন সবজি উৎপাদিত হয়েছিল।
এসএনএল/এসিবি (রয়টার্স)
ফসলের যত্নআত্তি করা, খেতখামারের চারপাশে নজর রাখা, ঠিকসময়ে কীটনাশক প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়াসহ নানা কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে ড্রোন৷ খেতখামারে অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতেও বেশ কাজের এই ড্রোন, যা বদলে দিচ্ছে যুক্তরাজ্যের কৃষি৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Z. Xudongযুক্তরাজ্যের কৃষক কলিন রায়নার৷ সাতশো একর জমিতে তাঁর চাষবাস৷ এত বড় এলাকা ঘুরে দেখা তো আর মুখের কথা নয়৷ তাঁর জমিতে কেউ মোটরবাইক চালাচ্ছেন, কেউ বেড়া কেটে দিচ্ছেন--কিন্তু কিছুই করতে পারছিলেন না তিনি৷ তাই কৌশলী হয়ে ব্যবহার করছেন ড্রোন৷ মোটরবাইকারদের ছবি তুলে পুলিশের কাছে পাঠানোর কাজটা এখন আর মোটেও জটিল কিছু নয়৷
ছবি: Privatড্রোনের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো ফসলের ওপর নজর করা৷ বাসায় বসে ড্রোনটি উড়িয়ে দিলেন রায়নার৷ বিস্তীর্ণ মাঠের বিভিন্ন অংশ ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে পাঠায় ড্রোন৷ সেই ছবি দেখে বোঝা যায়, মাঠের কোন অংশে ফসলের কী অবস্থা৷ তাই দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেন রায়নার৷
ছবি: Drone AG/J. Wranghamভালো ফলনের জন্য পরিমিত মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ নানা পোকামাকড় ছাড়াও ব্যাকটেরিয়া কিংবা ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হতে পারে ফসল৷ ড্রোনের সাহায্যে আক্রান্ত এলাকাটা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ পান রায়নার৷ মাঠে না ঘুরেই বুঝে ফেললেন, কোন অংশে কোন ধরনের কীটনাশক দিতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Z. Xudongআকাশ ঘুরে ছবি তোলা আর তথ্য পাঠানোতেই সীমাবদ্ধ নয় ড্রোনগুলো৷ সময়ের সঙ্গে বাড়ছে এগুলোর কর্মদক্ষতা৷ কৃষিকাজের জন্য তৈরি বিশেষ ড্রোনগুলোতে একটি ট্যাংকার দেয়া হয়৷ ওই ট্যাংকে পানি থেকে শুরু করে কীটনাশক রাখা যায়, যা প্রয়োজনে ড্রোন থেকে ফসলের মাঠে ছিটানো সম্ভব৷ জিপিএস প্রযুক্তি থাকায় কাজটিও অনেক সোজা৷ ফলে ফলন বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর ফসল উৎপাদনে কৃষককে কম বেগ পেতে হচ্ছে৷
ছবি: Getty Imagesপ্রযুক্তির সুফলের সঙ্গে কুফলও আছে৷ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে ড্রোন উড়ানোর ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আছে৷ কারণ ড্রোনের অপব্যবহার, শুধু কৃষি নয় মানব সভ্যতার জন্যও বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে৷ তাই আইন আর বিধিনিষেধ মেনেই এটাকে কৃষির উন্নয়নে ব্যবহার করা উত্তম৷
ছবি: Imago/Manngold