কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ – প্রবাদবাক্যের মতো এ কথাটি এখন আজ এতটা উচ্চারিত হয় না৷ বাংলাদেশ আর এখন মূলত কৃষি নির্ভর নয়৷ কৃষিতে উত্পাদন বেড়েছে, বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার৷ তারপরও বাংলাদেশ এখন রয়েছে শিল্পের ‘টেক অফ স্টেজে’৷
বিজ্ঞাপন
সোনালি আঁশের সেই দিন আর নেই৷ বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান খাতে পরিণত হয়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি৷ অর্থাৎ শিল্প খাত, এবং তার সঙ্গে সেবা খাত এগিয়ে গেছে অনেক৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ এখনো গ্রামে বসবাস করে৷ গ্রামে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগ লোকের এখনো কৃষি খামার বা চাষাবাদ রয়েছে৷ অন্যদিকে শহরেও শতকার প্রায় ১১ ভাগ মানুষ সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত৷
মোট দেশজ উত্পাদনের হিসাবে জিডিপিতে এখন কৃষিখাতের অবদান শতকরা ১৫.৩৩ ভাগ৷ এছাড়া এই কৃষিখাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে ৪৮.১ ভাগ কর্মজীবী মানুষের৷
অন্নপূর্ণা চলনবিল
বছরের প্রায় ছয়মাস চলনবিল পানিতে ডুবে থাকে৷ তবে শীতকালে শুকানোর পর সেই বিলের জমিতে বোরো আবাদ করেন কৃষকরা৷ কদিন আগে ধান ঘরে তুলেছেন তাঁরা৷ চলনবিলে ধান কাটার উৎসব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Mamun
ব্যস্ত কৃষক
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলনবিলে বোরো ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষক৷ গ্রামে ধান কাটায় এখনো আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার খুব একটা দেখা যায় না৷ ছবিটি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বিল নাদুয়া থেকে তোলা৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাঠেই সকালের খাবার
চলনবিলে ফসল কাটার মাঝে সকালের খাবার খাচ্ছেন কৃষকরা৷ সাধারণত সূর্য ওঠার আগে থেকেই এখানে ধান কাটা শুরু হয়৷ তাই কৃষকরা সকাল আর দুপুরের খাবার সঙ্গে নিয়ে আসেন৷ কাজের ফাঁকে মাঠেই সেরে ফেলেন খাবার পর্ব৷
ছবি: DW/M. Mamun
মহিষের গাড়ির কদর বেশি
চলনবিলের রাস্তাঘাট এখনো খুবই অনুন্নত৷ একটু বৃষ্টি হলেই হাঁটু কাদায় ভরে যায় কাঁচা সড়কগুলো৷ এ অঞ্চলে মাঠ থেকে ধান আনার জন্য তাই মহিষের গাড়ির কদর বেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
কাটা ধান নিয়ে বাড়ি ফেরা
চলনবিলের ভেতর থেকে মহিষের গাড়ি বোঝাই কাটা ধান নিয়ে বাড়ি ফিরছেন মজুররা৷ ফসল তোলার সময় এসব মজুররা ধান কাটার জন্য আসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও রাজশাহীর গোদাগাড়ী অঞ্চল থেকে৷ সঙ্গে নিয়ে আসেন নিজেদের মহিষের গাড়িও৷ সাধারণত এক বিঘা জমির ধান কেটে কৃষকের বাড়ি পৌঁছে দিলে এসব মজুররা দেড়মন ধান পেয়ে থাকেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
পরিবেশবান্ধব বাহন
চলনবিলে ধান বহনের জন্য মহিষের গাড়ি ব্যবহারের অন্যতম আরেকটি কারণ হলো এ বাহনটিতে অনেক বেশি মাল বোঝাই করা যায় এবং এতে কোনো জ্বালানি খরচ নাই৷ মোটের উপর পরিবেশবান্ধব এক বাহন এটি৷ অধিকন্তু কাঠের চাকা হওয়ায় যে-কোনো দুর্গম রাস্তাতেই চলতে সক্ষম এ বাহন৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাথায় নিয়েই ফেরা
ধানের মাঠ থেকে যে কৃষকদের বাড়ি অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বে তাঁরা মাথায় করেই নিয়ে আসেন কাটা ধান৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ির আঙিনায় মাড়াই
চলনবিলে ধান কাটার পর মাড়াই পর্বটা সম্পন্ন হয় বাড়ির আঙিনাতেই৷ এ কাজে বাড়ির পুরুষদের পাশাপাশি নারী সদস্যদের ভূমিকাও থাকে অনেক বেশি৷ আগে এ অঞ্চলে গরু কিংবা হাত দিয়েই মাড়াই করা হতো৷ কিন্তু বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি যন্ত্র দিয়ে ফসল মাড়াই করা হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
নারীর ভূমিকা
মাড়াই শেষে ধান থেকে ময়লা সরাচ্ছেন চলনবিলের গৃহিনীরা৷ মাঠ থেকে ধান কেটে আনার পর চাল তৈরি পর্যন্ত সবকটি পর্যায়েই নারী সদস্যদের ভূমিকা থাকে বেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ধান সিদ্ধ
ধান মাড়াই শেষে সিদ্ধ করছেন চলনবিলের গৃহিনীরা৷ এ কাজটিও মূলত বর্তায় গৃহিনীদের উপরই৷ ধান সিদ্ধ করার কাজে ব্যবহৃত জ্বালানিও আসে ধান থেকেই৷ এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ধানের খড় কিংবা তুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
অবশেষে চাল
সবশেষে ধান ভাঙানোর কাজ চলছে চলনবিলের একটি বাড়িতে৷ ফসল কাটার মৌসুমে ধান ভাঙানোর ভ্রাম্যমাণ কল নিয়ে বাড়িতেই হাজির হন অনেকে৷ এক মন ধান ভাঙাতে কৃষকদের গুনতে হয় ২০-২৫ টাকা৷
ছবি: DW/M. Mamun
10 ছবি1 | 10
কৃষি থেকে শিল্প
এরপরেও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ধীর গতিতে কৃষি প্রধান অর্থনীতি থেকে একটি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দেশে পরিণত হচ্ছে৷
২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ২১. ৮ ভাগ৷ ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর – এই সময়ে জিডিপিতে কৃষি খাতের কমতে থাকে৷ ফলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে এসে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান দাড়ায় ১৮.৭ ভাগ৷ সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের জিডিপিতে সেবাখাতের অবদান ৫৩.৩৯ ভাগ, শিল্প খাতের ৩১.২৮ এবং কৃষি খাতের ১৫.৩৩ ভাগ৷ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি বৃহত্ খাতের মধ্যে কৃষির অবদান এখন তৃতীয়৷
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ সালে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪৮.৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ যার ৯০ ভাগ তখন আসে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে৷ আশির দশকে এই ধারার পরিবর্তন শুরু হয়ে, যা এখন আরো দ্রুত হচ্ছে৷ কৃষির জায়গা দখল করে নিচ্ছে শিল্প এবং সেবা খাত৷ বর্তমানে বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি আয় মিলিয়ন নয়, ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷
কৃষি উত্পাদনও বাড়ছে
বাংলাদেশে এখন কৃষিপণ্য ধান, গম, ভুট্টা, চা, পাট, তুলা, আখ, আলু, ডাল, তৈলবীজ, সবজি, ফল, মশলা, ফুল ও রেশমগুটি৷ এর বাইরে মাছ চাষ, সবজি চাষ, গাবাদি পশু ও হাস-মুরগি পালন অন্যতম৷ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির আনুপাতিক অবদান কমলেও মোট কৃষি উত্পাদন বাড়ছে৷ কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার এবং যন্ত্রের ব্যবহার উত্পাদন বাড়ার পেছনে প্রধান কারণ৷ এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ এবং পরিবেশ সহিষ্ণু ভিভিন্ন ফসল৷
ঈশ্বরদীর লিচু
বাংলাদেশে লিচু উৎপাদনের অন্যতম বড় অঞ্চল পাবনা জেলার একটি উপজেলা৷ নাম – ঈশ্বরদী৷ এ বছর সেখানকার প্রায় ২,৪০০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে৷ গতবছর লিচু বিক্রি করে প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি আয় করেছিল সেখানকার স্থানীয় কৃষকরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
জনপ্রিয় হচ্ছে ঈশ্বরদীর লিচু
ঈশ্বরদীর রূপপুরের একটি বাগানে পাকা লিচু৷ স্বাদে ও আকারে এখানকার লিচুর সুনাম দেশজুড়ে৷ একটা সময় দিনাজপুরের লিচুর খ্যাতি থাকলেও গত প্রায় এক যুগ ধরে তাতে ভাগ বসাতে শুরু করেছে ঈশ্বরদীর লিচু৷ ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি দপ্তরের মতে, গত বছর সেখানে প্রায় ২,৩০০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছিল৷ এবার সেটা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৪০০ হেক্টর৷
ছবি: DW/M. Mamun
পরিবারের সবাই ব্যস্ত
ঈশ্বরদীর ছলিমপুরের একটি বাগানে লিচু বাছাই করছেন পরিবারের সদস্যরা৷ লিচু মৌসুমে এ অঞ্চলে শ্রমিকের অভাব থাকে বলে শ্রমের মূল্যও থাকে চড়া৷ পরিবারের সব সদস্যই তাই এ সময়ে কাজে লেগে পড়েন৷
ছবি: DW/M. Mamun
সার্বক্ষণিক তদারকি
ঈশ্বরদীর ছলিমপুরের লিচু চাষি আবুল কালাম৷ প্রতিবছর লিচু চাষের টাকায়ই চলে তাঁর সংসার৷ অনাবৃষ্টি এবং উচ্চ তাপমাত্রা ঈশ্বরদীর অনেক বাগানে লিচু চাষে কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও কালামের সার্বক্ষণিক তদারকি আর যত্নের কারণে তাঁর বাগানে ক্ষতির ছোঁয়া এবার খুব একটা লাগেনি৷ এ বছরও লিচু থেকে আয় ভালো বলে জানান তিনি৷
ছবি: DW/M. Mamun
যত্নের সঙ্গে পাড়া
ঈশ্বরদীর ছলিমপুরে গাছ থেকে লিচু পাড়ছেন একজন কৃষক৷ এ কাজটি তাঁদেরকে করতে হয় অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বৈরি আবহাওয়া
বৈরি আবহাওয়া ঈশ্বরদীর লিচু চাষে অনেক ক্ষতি করলেও ভালো ফলন পেয়েছেন অনেক কৃষক৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাজারে নেয়ার ব্যবস্থা
গাছ থেকে লিচু পাড়ার পর বাগানেই ঝুড়িতে ভরে নিচ্ছেন কৃষকরা৷ চারপাশে গাছের কাচা পাতা দিয়ে ঝুড়ির ভেতরে রাখা হয় লিচু৷ গাছ থেকে পাড়ার পর খুব দ্রুতই এ কাজটি করতে হয় তাদের৷ কারণ খুব বেশি বাতাসের সংস্পর্শ পেলে লিচু দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
দাম চড়া
ঈশ্বরদীতে লিচুর ফলন গতবছরের তুলনায় কিছুটা কম হওয়ায় এবছর ফলটির দাম কিছুটা চড়া৷ গত বছর ভালো মানের প্রতি হাজার লিচু বিক্রি হয়েছিল দুই থেকে তিন হাজার টাকায়৷ কিন্তু এ বছর প্রতি হাজার লিচু বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
কুড়িয়ে পাওয়া লিচু
ঈশ্বরদীর মিরকামারীতে গাছের তলায় কুড়িয়ে পাওয়া লিচু হাতে একটি শিশু৷ এ অঞ্চলের গরিব মানুষ যাঁদের লিচু বাগান নেই, আবার কিনে খাবার সামর্থ্যও নেই, এই কুড়িয়ে পাওয়া লিচুই তাদের চাহিদা মেটায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিক্রির জন্য প্রস্তুতি
বাছাই শেষে ঝুড়ি ভর্তি লিচু৷ পাঠানো হবে শহরে৷ ঈশ্বরদীর ছলিমপুর থেকে তোলা ছবি৷
ছবি: DW/M. Mamun
প্রতিকূল আবহাওয়ার শিকার
খরায় ফেটে যাওয়া ঈশ্বরদীর মিরকামারী এলাকার একটি বাগানের লিচু৷ গাছে ফলন আসার পরে বেশ কিছুদিন বৃষ্টির দেখা মেলেনি এ অঞ্চলে৷ তবে সময়মতো কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় কৃত্রিম বৃষ্টি ও ঔষধ প্রয়োগ করে ক্ষতির হাত থেকে অনেকেই বাঁচতে পেরেছেন৷ যাঁরা সময়মতো পদক্ষেপ নেননি, তাঁদেরই এরকম ক্ষতি হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
10 ছবি1 | 10
বাংলাদেশে এক সময় গমের চাষ ছিল না বললেই চলে৷ কিন্তু এখন গমের আবাদ বাড়ছে৷ প্রচলিত তৈল বীজের পাশাপাশি বেড়েছে সূর্যমুখীর চাষ৷ বণিজ্যিক ভিত্তিতে শাক-সবজি চাষে রীতিমত বৈপ্লবিক অগ্রগতি হয়েছে৷ এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পোল্ট্রি শিল্প এবং গবাদী পশু লালন পালন, ডেইরি ও মত্স চাষ৷
৪৪ বছরে দেশের আলু চাষের জমি সাড়ে ৫ গুণ বেড়েছে৷ ফলন বেড়েছে ১০.৯ গুণ৷ এই সময়ে গমের উত্পাদন বেড়েছে ১২.২৫ গুণ৷ ভুট্টার ফলন বৃদ্ধির হার রীতিমতো বিস্ময়কর৷ এ পর্যন্ত দেশে ভুট্টার উত্পাদন বেড়েছে ৭৫৭ গুণ৷ আর এই ফসলের জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ৷
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, সবজি উত্পাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়৷ স্বাধরিতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে সবজির উত্পাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ৷ এখন প্রায় সারা বছরই ২০ থেকে ২৫ জাতের সবজি উত্পাদন হয়৷ গত এক দশকে বাংলাদেশে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭১ থেকে ২০১৫ সাল এই ৪৪ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন দানাদার খাদ্যশস্যের উত্পাদন বেড়েছে ৩ থেকে ৭৫৭ গুণ৷
বাংলাদেশে পাম চাষ
ভোজ্য তেল হিসেবে পাম ওয়েলের ব্যবহার বাংলাদেশে দিন দিন বাড়ছে৷ এই তেলের বেশির ভাগই আমদানি করা হয়৷ তবে কয়েক বছর ধরে দেশেই পাম চাষ শুরু হয়েছে৷
ছবি: AP
পাম তেল
পাম গাছের ফল প্রক্রিয়াজাত করে যে তেল পাওয়া যায় তাকে পাম তেল বলে৷ পাম ফলের মাংসল অংশ ও বীজ থেকে তেল পাওয়া যায়৷ মাংসল অংশ থেকে যে তেল পাওয়া যায়, তার নাম পাম তেল৷ আর বীজ বা ক্যার্নেল থেকে যে তেল পাওয়া যায়, তার নাম পাম ক্যার্নেল তেল৷
ছবি: CC/Cayambe
বাংলাদেশে প্রথম
জাতীয় ই-তথ্যকোষে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম মালয়েশিয়া থেকে পাম বীজ আনা হয়েছিল৷ তবে জোরেশোরে পাম চাষ শুরু হয় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে৷ সেসময় সরকারি পর্যায় থেকে পাম চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা হয়৷ কয়েকটি সংস্থাও এক্ষেত্রে প্রচারণা শুরু করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সমস্যা
প্রচারণায় উৎসাহী হয়ে অনেক কৃষক ঋণ নিয়ে পাম চাষ শুরু করেছিলেন৷ তবে তিন-চার বছর পর গাছে ফল আসলে, তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন তাঁরা৷ কেননা এই ফল থেকে কীভাবে তেল উৎপাদন করতে হবে সে বিষয়ে ততটা জানা ছিল না কৃষকদের৷
ছবি: CC/a_rabin
আশার কথা
মেহেরপুরের কয়েকজন যুবক নিজেদের উদ্যোগে পাম ফল থেকে তেল উৎপাদনের জন্য একটি মেশিন তৈরি করেছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture alliance/dpa
মেশিন ছাড়া তেল
গাছ থেকে পরিপক্ক ফল নামিয়ে পাত্রের মধ্যে পানিসহ ফুটিয়ে সেগুলোকে নরম করতে হবে৷ এরপর নরম ফলগুলো হাতে চেপে রস বের করতে হবে৷ তারপর পানি মিশ্রিত এ রসকে একটি পাত্রে রেখে চুলায় কিছুক্ষণ তাপ দিলে রসে বিদ্যমান পানি বাষ্পাকারে বের হয়ে যাবে এবং পাত্রের মধ্যে পাম তেল জমা থাকবে৷
ছবি: WWF/J. Morgan
দুটি পাম গাছই যথেষ্ট
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি পরিবারে দুটি পামঅয়েল গাছ চাষ করলে ঐ পরিবারের সারা বছরের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব৷ এছাড়া প্রতিটি পরিবার যদি পাম চাষে এগিয়ে আসে তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো বাংলাদেশকে তেল আমদানি করতে হবে না বলেও মনে করেন তাঁরা৷
ছবি: picture alliance/dpa
অর্থ সাশ্রয়
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল আমদানি খাতে প্রতি বছর ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়৷ যে তেল আমদানি করা হয় তার ৬০ শতাংশই পাম তেল৷ তাই পাম চাষ বাড়ানো গেলে এই অর্থের একটা বড় অংশ সাশ্রয় করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ কারণ বাংলাদেশের জমি পাম চাষের বেশ উপযোগী৷
ছবি: AP
7 ছবি1 | 7
চাল রপ্তানি করে বাংলাদেশ
একসময় বাংলাদেশে বেশির ভাগ ধান ছিল প্রকৃতি নির্ভর, যেমন আমন ও আউশ৷ ১৯৭০-৭১ সালে দেশের মাত্র ২০ শতাংশ ফসল আসত বোরো থেকে৷ আর এখন দেশের ৫৫ শতাংশ চাল আসে বোরো থেকে৷ বোরোর মোট উত্পাদন বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ৷
বিবিএস-এর তথ্য অনুযায়ী, ৪৪ বছরে দেশের ধান চাষের জমি ১৮ শতাংশ কমেছে৷ কিন্তু একই সময়ে চালের উত্পাদন বেড়েছে ৩.১৬ গুণ৷
বাংলাদেশ এখন চাল রপ্তানিকারক দেশ৷ বছরে দুই লাখ টন চাল রপ্তানি করা হয়৷ শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের চাল নিচ্ছে৷ আফ্রিকায় চাল রপ্তানির জন্য বাজার খোঁজা হচ্ছে৷
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, সংস্থার বিজ্ঞানীরা ১৯৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭৪টি উচ্চফলনশীল (উফশী) ও চারটি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন৷ এর মধ্যে ১৪টি জাত লবণাক্ততা, বন্যা ও খরাসহিষ্ণু৷ এছাড়া বাংলাদেশ আণবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)-এর বিজ্ঞানীরা ১৬ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন, যার চারটি লবণাক্ততা ও খরাসহিষ্ণু জাত৷
এখনো কৃষি সম্ভাবনাময়
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর মহাপরিচালক এবং কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কামাল মুজেরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে কৃষি থেকে শিল্পে একটা টেক অফ স্টেজ চলছে৷ কৃষির উত্পাদন বাড়ছে বা উন্নয়ন ঘটছে তবে তা শিল্পের সঙ্গে সমান গতিতে নয়৷ এটা পৃথিবীর যেসব দেশে শিল্প উন্নয়ন হয়েছে সব দেশেই একই চিত্র দেখা গেছে৷ সাধারণভাবে অবশ্য কৃষির প্রবৃদ্ধি শিল্পের মতো দ্রুত গতিতে হয় না৷''
মুজেরী
তবে তিনি মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশে কৃষির প্রচুর সম্ভাবনা রয়ে গেছে৷ সেব সম্ভাবনা ব্যবহার করা প্রয়োজন৷ কৃষিকে আধুনিকায়ন করতে হবে৷ একর প্রতি উত্পাদন আরো বাড়াতে হবে৷ ব্যবহার করতে হবে উন্নত প্রযুক্তি৷''
তিনি বলেন, ‘‘শুধু কৃষি উত্পাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেই চলবে না, কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে৷ কৃষককে ভর্তুকিসহ, উন্নত সার ও বীজের নিশ্চয়তা দিতে হবে৷ এ জন্য প্রয়োজন দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের ওপর জোর দেয়া৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘কোনো কোনো কৃষিপণ্যের উত্পাদন বাড়ছে৷ আবার কোনোটির কমছে৷ এর কারণ হলো কৃষক তাঁর অর্থনৈতিক লাভের দিক বিবচনা করে নতুন কৃষিপণ্যের দিকে ঝুঁকছে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘সোনালী আঁশ পাটের দিন আবারো ফিরে আসছে৷ আমরা সঠিক পরিকল্পনা নিলে সেই সুদিনের সুবিধা নিতে পারব৷ যেটা ভারত পেরেছে৷''
কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ‘উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা' বা উবিনীগ-এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যে কৃষি উত্পাদন বেড়েছে তা ধানের ক্ষেত্রে টেকসই বলে আমি মনে করি৷’’
ফরিদা আখতার
তিনি বলেন, ‘‘অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শাক-সবজি উত্পাদন বাড়াতে যা করা হয়েছে তা ক্ষতিকর৷ নানা জাতের সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে বিষাক্ত শাক-সবজি উত্পাদন করা হচ্ছে৷ এর ফলে মানুষের চিকিত্সা খরচ বেড়ে যাচ্ছে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘এতে বিভিন্ন কৃষি ও কীটনাশক কোম্পানি লাভবান হচ্ছে৷ কৃষক নয়৷ কারণ উত্পাদন বেড়ে গেলে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যায়৷ তাই অনেক কৃষক কৃষি ছেড়ে দিচ্ছে৷ যাঁরা আছেন, তাঁরা বাধ্য হয়ে আছেন৷''
ফরিদা আক্তার বলেন, ‘‘জিএম ফুড এবং উচ্চ ফলনশীল বীজের নামে কৃষককে জিম্মি করা হচ্ছে৷ বীজের অধিকার তাঁদের হাতে থাকছে না৷ অনেক বীজের ‘পেটেন্ট রাইট' নিয়ে যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি৷ সরকারও এ নিয়ে কারুর পরামর্শ শুনছে না, যা খুবই উদ্বেগের৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷