জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা এবং তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ থেকেও কোনো শিক্ষা নেয়নি অ্যামেরিকার পুলিশ। এ বার এক কৃষ্ণাঙ্গকে লক্ষ্য করে সাতবার গুলি চালানো হলো।
বিজ্ঞাপন
মিনেপোলিসের পর এ বার উইসকনসিনের কেনোশা। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছ কৃষ্ণাঙ্গ জেকব ব্লেক তাঁর পার্ক করা গাড়ির দিকে যাচ্ছেন। তাঁর পিছনে রিভলভার হাতে দুই পুলিশ অফিসার। জেকব গাড়ির দরজা খুলে ঢুকতে যেতেই একজন পুলিশ কর্মী তাঁর শার্ট ধরে টানলেন। তারপর গুলি চলতে শুরু করল। মোট সাতটি গুলির আওয়াজ ভিডিওতে শোনা গেছে। তবে একজন না কি দুইজন পুলিশ কর্মী তাঁকে গুলি করেছে তা বোঝা যায়নি।
ব্লেকের তিন বাচ্চা গাড়িতেই ছিলেন। তাঁরাই তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ব্লেকের বাবা এনবিসি টেলিভিশনকে জানিয়েছেন, তাঁর অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে। অবস্থা স্থিতিশীল। এই ঘটনার পর আবার প্রমাণিত হলো, 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার্স' বা 'কালো মানুষেরও জীবনের দাম আছে' বলে যে আন্দোলনে আলোড়িত হয়েছিল অ্যামেরিকা, তার থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি পুলিশ। ফ্লয়েডের মতো ব্লেকও ছিলেন সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। তিনি পুলিশ বা কাউকে আক্রমণ করেননি। নিজের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন। এই অবস্থায় তাঁকে কেন গুলি করা হবে? বর্ণবাদ নিয়ে এত প্রতিবাদ, আন্দোলন, বিক্ষোভের পরেও কি মার্কিন পুলিশের কাছে কালো মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই?
কৃষ্ণাঙ্গদের উপর পুলিশি নির্যাতনের ৮ ঘটনা
পুলিশি নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে৷ ছবিঘরে গত ছয় বছরে কৃষ্ণাঙ্গদের উপর পুলিশি নির্যাতনের আটটি ঘটনার উল্লেখ থাকছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/O. Haj Kadour
২৫ মে, ২০২০, মিনেপোলিস
জাল টাকা ব্যবহারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা ৪৬ বছর বয়সি জর্জ ফ্লয়েডকে রাস্তায় ফেলে তাঁর গলায হাঁটু দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছিলেন মিনেপোলিসের পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিন৷ এতে ফ্লয়েডের মৃত্যু হলে শভিনসহ চার পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়৷ এছাড়া শভেনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/S. Maturen
১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, আর্লিংটন
গাড়িতে নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ট্যাগ থাকার কারণে ও’শে টেরিকে আটক করেছিলেন টেক্সাসের পুলিশ কর্মকর্তারা৷ এরপর একজন অফিসার গাড়িতে মারিজুয়ানার গন্ধ পেয়ে তদন্ত করতে চাইলে গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন টেরি৷ এই সময় পুলিশ কর্মকর্তা বাও ট্রান গাড়িতে গুলি করলে টেরি গুলিবিদ্ধ হন৷ পরে হাসপাতালে মারা যান৷ এই ঘটনায় বাও ট্রানকে বরখাস্ত করা হয়৷
ছবি: Getty Images
১৯ জুন, ২০১৮, পিটসবার্গ
১৭ বছর বয়সি অ্যান্টোন রোজসহ তিনজন একটি গাড়িতে ছিলেন৷ গাড়িটি একটি গোলাগুলির ঘটনা সঙ্গে জড়িত ছিল বলে সন্দেহ করেছিল পুলিশ৷ এই অবস্থায় গাড়ির চালককে হাতকড়া পরানো হয়৷ আর গ্রেপ্তার আটকাতে অ্যান্টোন রোজ পালিয়ে যেতে চাইলে গুলি চালান পুলিশ কর্মকর্তা মাইকেল রসফেল্ড৷ এই ঘটনায় মামলা হলেও রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হন রসফেল্ড৷
ছবি: Reuters/J. Altdorfer
১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ওকলাহোমা
রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা গাড়ির চালক টেরেন্স ক্রুচারকে গুলি করেছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা বেটি শেলবি৷ মামলার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে শেলবি দাবি করেন, ক্রুচার তার গাড়ির কাছে এগিয়ে গেলে ভয় পান তিনি৷ কারণ তার মনে হয়েছিল, বন্দুক নিতে ক্রুচার গাড়ির দিকে এগোচ্ছেন৷ তাই নিজের প্রাণ বাঁচাতে গুলি চালান বলে দাবি করেন শেলবি৷ আদালত তাকে হত্যা মামলা থেকে রেহাই দিয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
৬ জুলাই, ২০১৬ মিনেসোটা
লাইসেন্স ও নিবন্ধন পরীক্ষা করে দেখতে ফিল্যান্ডো ক্যাস্টিলের গাড়ি থামিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা জেরনিমো ইয়ানেস৷ এই সময় ইয়ানেস তার কাছে অস্ত্র থাকার কথা জানিয়ে হাত বাড়ালে গুলি চালান ইয়ানেস৷ এতে ক্যাস্টিল মারা যান৷ তবে তার সঙ্গে থাকা পার্টনার ডায়মন্ড রেনল্ডসের দাবি, ক্যাস্টিল নথি বের করার জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন৷ মামলাটি তিন মিলিয়ন ডলারে মীমাংসা হয়েছিল৷
ছবি: picture alliance/AP Images/S.Takushi
২০ অক্টোবর, ২০১৫, শিকাগো
পুলিশ কর্মকর্তা জেসন ফান ডাইকের গুলিতে প্রাণ হারান লেকান ম্যাকডোনাল্ড৷ তার কাছে একটি তিন ইঞ্চি ছুরি ছিল৷ পুলিশের এক মুখপাত্র জানান, ডাইক ম্যাকডোনাল্ডকে ছুরি ফেলে দিতে বললে তিনি তা করেননি৷ পরে জানা যায়, ম্যাকডোনাল্ডকে ১৬ বার গুলি করা হয়৷ এই ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তা ডাইককে ছয় বছর নয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ এছাড়া ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার সঙ্গে পুলিশ সদস্য়সহ ১৬ জন জড়িত ছিল বলে জানান প্রধান পুলিশ পরিদর্শক৷
ছবি: Reuters/Chicago Tribune/A. Perez
১২ এপ্রিল, ২০১৫, বাল্টিমোর
পকেটে ছুরি থাকায় ২৫ বছরের ফ্রেডি গ্রেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল৷ এইসময় পুলিশ ভ্যানে কোমায় চলে গেলে তাকে একটি ট্রমা ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়৷ সেখানেই তার মৃত্যু হয়৷ মেরুদণ্ডে আঘাতজনিত কারণে তিনি মারা যান৷ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিচার শুরু হলেও কারও শাস্তি হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J.L. Magana
৯ আগস্ট, ২০১৪, মিসৌরি
নিজেদের মধ্যে সংঘাতের এক পর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা ড্যারেন উইলসনের গুলিতে প্রাণ হারান ১৮ বছরের মাইকেল ব্রাউন৷ এই ঘটনায় গ্র্যান্ড জুরি উইলসনকে অভিযুক্ত না করলে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল৷ পরে উইলসন পদত্যাগ করেন৷ এছাড়া ব্রাউনের পরিবারও মীমাংসায় বসেছিল৷
ছবি: DW/C. Bleiker
8 ছবি1 | 8
পুলিশ অবশ্য এর কোনো জবাব দেয়নি। তারা বলেছে, ব্লেককে তাঁরাই হাসপাতালে নিয়ে গেছে। দুই কর্মীকে বাধ্যতামূলকভাবে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো, হত্যার চেষ্টার অভিযোগে কেন তাঁদের গ্রেফতার করা হয়নি?
এই ঘটনার পরেই উত্তাল হয়েছে কেনোশা। মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ দেখিয়েছেন। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট, বোতল-বোমা ছোড়া হয়। কয়েকটি গাড়িতেও আগুন ধরানো হয়। এলাকায় কার্ফু জারি করা হয়েছে। কিন্তু তা অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমেছেন প্রচুর মানুষ। বিক্ষোভ চলছে। ফেডারেল পুলিশকেও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য নামানো হয়েছে। নিউ ইয়র্কেও প্রতিবাদ হয়েছে। সেখানে প্রতিবাদকারী আওয়াল বলেছেন, ''আমি ক্রুদ্ধ, আমি বিচলিত, আমি ক্লান্ত। আমি ২৭ মাইল হেঁটে ক্লান্ত।'' বলতে বলতেই তিনি কেঁদে ফেলেন।
ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান তরজা
ব্লেকের ওপর পুলিশের আক্রমণ নিয়ে শুরু হয়েছে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের কথার লড়াই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসন্ন বলে তার তীব্রতাও বেড়েছে। ডেমোক্র্যাট গভর্নর টনি এভার্স আফ্রিকান-অ্যামেরিকানদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের জন্য ন্যায় চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ''আমাদের কাছে এখনো ঘটনার পুরো বিবরণ আসেনি। তা সত্ত্বেও বলতে পারি, আমাদের রাজ্যে বা দেশে তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নন, যাঁকে পুলিশ নির্দয়ভাবে মারার চেষ্টা করল।''
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের মুখে যেসব স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য
জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর ইউরোপ ও অ্যামেরিকায় বিক্ষোভকারীরা এমন কিছু ভাস্কর্য ও স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙেছে বা নষ্ট করেছে, যেগুলো দাসপ্রথা ও ঔপোনিবেশিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বহন করে আসছিলো৷
ছবি: Reuters/Mohiudin Malik
রবার্ট ই লি
ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে কনফেডারেট জেনারেল রবার্ট ই লি এর স্মৃতিস্তম্ভের সামনে নাচছেন দুই ব্যালেরিনা কেনেডি জর্জ এবং আভা হলওয়ে৷ রাজ্যের গভর্নর রালফ নর্দাম এই স্মৃতিস্তম্ভ অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/J. Rendleman
এডওয়ার্ড ক্লস্টন
সপ্তদশ শতকের ক্রীতদাস বাণিজ্যের সাথে জড়িত এডওয়ার্ড ক্লস্টনের ভাস্কর্যটি ব্রিটিনের ব্রিস্টলে বন্দরের কাছে ফেলে দেয় বিক্ষোভকারীরা৷
ছবি: Reuters/Mohiudin Malik
রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড
বেলজিয়ামে সাবেক বেলজিয়াম রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ডের ক্ষতিগ্রস্ত মূর্তিটি অপসারণের কাজ চলছে৷ বিক্ষোভকারীরা এটিতে রঙ দিয়েছে এবং আগুন ধরিয়ে দিয়েছে৷
ছবি: Reuters/ATV - Antwerp Television
রবার্ট মিলিগান
মিউজিয়াম অফ লন্ডন ডকল্যান্ডস এর বাইরে রবার্ট মিলিগানের ভাস্কর্য কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা৷
ছবি: Reuters/J. Sibley
রবার্ট মিলিগান
লন্ডনের ক্যানারি ওয়ার্ফ এর কাছে মিউজিয়াম অফ লন্ডন ডকল্যান্ডস এর বাইরে রবার্ট মিলিগানের ভাস্কর্য অপসারণ করছে কর্মীরা৷
ছবি: Reuters/J. Sibley
উইস্টন চার্চিল
লন্ডনে পার্লামেন্ট স্কয়ারের সামনে উইস্টন চার্চিলের ভাস্কর্য রয়েছে৷ বিক্ষোভকারীরা এই ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিচ্ছে ‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার’৷ চার্চিলের বেশ কয়েকটি মূর্তির সামনেই এমন বিক্ষোভ হয়েছে৷
ছবি: Reuters/
হেনরি গ্রেডি
জর্জিয়ার আটলান্টায় বিক্ষোভকারীরা হেনরি গ্রেডি’র ভাস্কর্য সরানোর জন্য শ্লোগান দিচ্ছে৷ গ্রেডি একজন সাংবাদিক ছিলেন, যিনি লিখেছিলেন দক্ষিণাঞ্চলে শ্বেতাঙ্গদের যে উচ্চবর্ণের আভিজাত্য রয়েছে, তা সারাজীবন বজায় রাখা উচিত৷
ছবি: Reuters/D. Chambers
7 ছবি1 | 7
কিন্তু ডনাল্ড ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির নেতারা বলেছেন, এত তাড়াতাড়ি কোনো সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়। রিপাবলিকান সেনেটরের বক্তব্য, ''সকলে একটু ধৈর্য ধরুন। আবেগ নয়, যুক্তি ও আইন আগে দেখুন। তারপর পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করুন। প্রকৃত নেতারা উত্তেজনা কমাবার চেষ্টা করেন, বাড়ান না। দায়িত্বজ্ঞানহীন বিবৃতি দেবেন না।''
জর্জ ফ্লয়েড হত্যার সময়ও দেখা গিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পপুলিশকেই আগাগোড়া সমর্থন করে এসেছেন। আর প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন সে সময় ফ্লয়েডের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে জনবিক্ষোভকে তিনি সমর্থন করেছেন। তিনি তাঁর নির্বাচনী জুটি করেছেন কমলা হ্যারিসকে, যাঁর বাবা ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ ও মা ভারতীয়। বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা, আফ্রিকান-অ্যামেরিকান এবং ইন্ডিয়ান-অ্যামেরিকান ভোটের সিংহভাগ বাইডেনের দিকেই যাবে। এই পরিস্থিতিতে ব্লেকের ঘটনা সেই ভোটকে আরো বেশি করে তাঁদের দিকে নিয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।