বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্রাজিলের প্রতিভাধর ফুটবলাররা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। আর ব্রাজিলে ফটবল আকর্ষণ হারাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
প্যারিসে ২০২৪-এর অলিম্পিকে ব্রাজিলের ফুটবল দলকে দেখা যাবে না। কারণ, পুরুষদের জাতীয় ফুটবল দল অলিম্পিকে যাওয়ার জন্য কোয়ালিফাই করতে পারেনি। দক্ষিণ অ্যামেরিকার কোয়ালিফাইং গ্রুপের তালিকায় তাদের স্থান ছিল ছয় নম্বরে। যে দেশ পাঁচবার ফুটবল বিশ্বকাপ জিতেছে, তাদের এই শোচনীয় অবস্থার কথা ভাবলে কষ্ট হতেই পারে।
শনিবার ডরিভাল জুনিয়র কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন। দুই বছরের মধ্যে তিনি হলেন পঞ্চম কোচ। তার প্রশিক্ষণে ইংল্যান্ডে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে গিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচ খেলবে ব্রাজিল।
ব্রাজিলের সাবেক স্ট্রাইকার গ্রাফিটের নেতৃত্বে উলফসবার্গ ২০০৯ সালে তাদের একমাত্র বুন্দেসলিগা খেতাব জিতেছিল। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেছেন,''ব্রাজিলের সেই অপূর্ব খেলা, যার জন্য পেলের মতো প্লেয়াররা মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন, তা এখন আর চেনা যায় না। ফুটবলে ব্রাজিলিয়ান ঘরানা আজ আর নেই।'' গ্রাফিট চাইছেন ও চেষ্টা করছেন, ব্রাজিলে সেই ফুটবল যাতে আবার ফিরে আসে।
ছবিতে ফুটবল হৃদয়সম্রাট পেলে
এডসন আরান্তেস ডো নাসিমেন্তো বা পেলেকে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার বলা হয়। তার জীবনের কিছু দিক নিয়ে এই ছবিঘর।
ছবি: picture-alliance/AP Photo
প্রথম ক্লাব
পেলের প্রথম ক্লাব ছিল সান্তোস। এখানেই তিনি সবচেয়ে বেশি বছর খেলেছেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে পেশাদার ফুটবলার হিসাবে এই ক্লাবে খেলা শুরু করেন তিনি। ক্লাবের হয়ে ইউরোপ ও অ্য়ামেরিকা সফরে গেছেন। ছবিতে ১৯৭০ সালে ক্লাবের হয়ে ওয়াশিংটন ডার্টসের হয়ে একটি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে দেখা যাচ্ছে।
ছবি: picture alliance/AP Images/J. Duricka
বিশ্বকাপে প্রথম খেলা
১৯৫৮ সালে সুইডেন বিশ্বকাপে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে দলের তৃতীয় ম্যাচ খেলেন পেলে। এই মহান ফুটবলারের বিশ্বকাপ অভিযানের সেই শুরু। তখন তার বয়স ১৭ বছর। বিশ্বের তরুণতম ফুটবলার হিসাবে বিশ্বকাপ খেললেন পেলে। সেমিফাইনালে হ্য়াটট্রিক করলেন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। ফাইনালে সুইডেনকে দুই গোল দিলেন। সবমিলিয়ে ওই বিশ্বকাপে ছয় গোল দেন পেলে।
ছবি: picture-alliance/dpa
অসাধারণ দক্ষতা
পেলে বলতেন, ফুটবল হলো সুন্দর খেলা। তিনিও সেভাবেই খেলার চেষ্টা করতেন। আর মাঠে ছড়িয়ে পড়ত তার পায়ের শিল্পসুষমা। তিনি খেলতেন মূলত স্ট্রাইকার পজিশনে। তার গতি, সৃষ্টিশীলতা ও অনন্য দক্ষতার সাহায্যে প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ছারখার করে দিতেন। তার ড্রিবলে ছিটকে পড়তেন প্রতিপক্ষের ফুটবলাররা। তার বাইসাইকেল কিক ছিল দৃষ্টিনন্দন। এই কিকটি তিনি ১৯৬৮-তে মেরেছিলেন।
ছবি: AP
১৯৬৬ সালে যা হলো
পরপর দুইবার বিশ্বকাপ জেতার পর ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডে অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিল ব্রাজিল। বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ফ্রিকিক থেকে গোল করেন তিনি। পরপর তিনটি বিশ্বকাপে গোল করলেন এই মহান ফুটবলার। কিন্তু বুলগেরিয়া ও পর্তুগালের ডিফেন্ডাররা পেলের বিরুদ্ধে সমানে ভয়ংকর ফাউল করতে থাকলেন। প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিল ব্রাজিল।
ছবি: picture-alliance/dpa
তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়
১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ছিল পেলের ফুটবল জীবনের শেষ বিশ্বকাপ। ফাইনালে ইটালিকে ৪-১ গোলে হারালো ব্রাজিল। সতীর্থদের কাঁধে চেপে মাঠ ছাড়লেন পেলে। তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জেতার অর্থ হলো, জুলে রিমে ট্রফি বরাবরের মতো ব্রাজিলের কাছে থেকে গেল। চারটে গোল দিয়েছিলেন পেলে। সেরা ফুটবলার হিসাবে গোল্ডেন বুটও পেলেন।
ছবি: picture-alliance/AP Photo
দেশের হয়ে শেষ খেলা
১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই। ব্রাজিলের হয়ে তার ৯৭তম ও শেষ ম্য়াচটি খেললেন পেলে। যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে। রিও ডি জেনেইরোর মারকানা স্টেডিয়ামে এক লাখেরও বেশি সমর্থকদের সামনে। তখন পেলের বয়স ৩০। তারপরেও অনেকদিন ক্লাব ফুটবলে খেলেছেন। কিন্তু সেরা ফর্মে থাকতে থাকতে তিনি তিনি দেশের হয়ে খেলা থেকে অবসর নিয়েছিলেন।
ছবি: picture-alliance/dpa/MTI Laszlo Almasi
নিউ ইয়র্ক কসমস
১৯৭৪ সালে পেলে ক্লাব ফুটবল থেকেও অবসরের কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু এক বছর পর তিনি অবসর ভেঙে নিউ ইয়র্ক কসমসে খেলার কথা জানান। পেলের মিশন ছিল বেসবলে আসক্ত একটি দেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়ানো। তিনি ১৯৭৭ সালে নর্থ অ্যামেরিকা সকার লিগ জিততে কসমসকে প্রভূত সাহায্য করেন।
ছবি: picture-alliance/ASA/P. Robinson
বিদায় ফুটবল
১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর। তার পুরনো ক্লাব সান্তোসের বিরুদ্ধে কসমসের ম্যাচ খেলে অবসর নিলেন পেলে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে তার ক্লাবের টিমমেট বেকেনবাওয়ার এবং দেশের হয়ে খেলা সতীর্থ ফুটবলার কার্লোস অ্যালবের্টোকে। আছেন বক্সার মহম্মদ আলিও।
ছবি: picture-alliance/dpa/Mehmet Biber
ফিল্ম স্টার
১৯৮১ সালে পেলে অভিনয় করলেন এসকেপ টু ভিক্টরি ছবিতে। নাৎসি টিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধবন্দি অ্যালায়েড ফোর্সের ফুটবলারদের নিয়ে ম্যাচকে ঘিরে ছবি। হলিউড অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করলেন পেলেও।
ছবি: picture alliance/Mary Evans Picture Library
ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রী
ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পরেও নানা ধরনের কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন পেলে। ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো তাকে গুডউইল অ্যাম্বাসেডর করে। একবছর পর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট তাকে এক্সট্রাঅর্ডিনারি মিনিস্টার অফ স্পোর্টস করেন। পেলে তখন ব্রাজিলে খেলার আসর থেকে দুর্নীতি দূর করতে একটি আইন প্রস্তাব করেন। এই আইনের নাম পেলে ল।
ছবি: picture-alliance/dpa
ফুটবলার ছেলে
পেলে তিনবার বিয়ে করেন। অনেকগুলি সন্তানের জলক তিনি। এর মধ্যে তার ছেলে এডিনহো পেশাদার ফুটবল খেলতেন। তিনি গোলকিপার ছিলেন। স্যান্টোসেও খেলেছেন। কিন্তু মাদক ও অর্থ পাচারের অভিযোগে তাকে দীর্ঘ কারাদণ্ড দণ্ডিত করে আদালত।
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Setton
স্বাস্থ্য খারাপ হলো
পরের দিকে তার শরীর খারাপ হয়। ২০১২-তে তার কোমরে অস্ত্রোপচার হয়। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় বিশ্বকাপে তাকে হুইলচেয়ারে দেখা যায়। ছবিতে আরেক মহান ফুটবলার ম্যারাডোনা এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিনের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে পেলেকে। এর একমাস পরেই কিডনি থেকে পাথর বের করার জন্য তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি।
ছবি: picture-alliance/dpa/Sputnik/A. Nikolskyi
12 ছবি1 | 12
প্রতিবছর কয়েকশ ফুটবলার বিদেশে যাচ্ছেন
এমন নয় যে গ্রাফিটই প্রথম বিশেষজ্ঞ, যিনি এই কথা বললেন। ২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হেরেছিল ব্রাজিল। তারপর বিখ্যাত ফুটবলার ও কোচ জাগালো বলেছিলেন, ব্রাজিলের সব ফুটবল প্রতিভা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ঘরের মাঠে খেতে আগ্রহী নয়। ফলে ফুটবলে ব্রাজিলের আইডেনটিটি বা পরিচয় আর বজায় থাকছে না।
প্রায় ২০ বছর হলো ইউরোপে নিয়ম বদলেছে। ফলে বাইরের দেশের ফুটবলারদের সেখানে খেলা অনেক সহজ হয়েছে। এর ফলে ঝাঁকে ঝাঁকে প্লেয়ার সেখানে যাচ্ছেন। প্রতিবছর ব্রাজিল থেকে কয়েকশ ফুটবলার সেখানে খেলতে যান।
ঐতিহাসিক ডেভিড গোমস ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এর ফলে ব্রাজিলের ফুটবল তার পরিচয় হারিয়েছে।''
গোমস বহু বছর ধরে ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসের উপর গবেষণা করছেন। তিনি বলেছেন, ''যে প্রতিভাবান ফুটবলাররা নিজের দেশে থেকে তাদের প্রতিভাকে বিকশিত করতে পারতেন, দেশের ফুটবলকে তুলে ধরতে পারতেন, তারা অকালে চলে যাচ্ছেন ইউরোপে। তাদের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ হচ্ছে না।'' তিনি বলেছেন, ''ব্রাজিলের ফুটবলের বিশেষত্ব ছিল, অসাধারণ ড্রিবলিং, যা দেখে দর্শকরা আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়তো।''
২০১৮ সালে ভিনিসিয়াস জুনিয়রের মতো অত্যন্ত প্রতিভাবান ফুটবলার চলে যান। গতবছর গরমে এন্ডরিক চলে যান রিয়েল মাদ্রিদে।
ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা: কিছু তথ্য
ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যে ফুটবল ম্যাচকে অনেকে ‘দক্ষিণ অ্যামেরিকার মানুষদের মধ্যে যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন৷
ছবি: Reuters/L. Gonzalez
শুরুর কথা
আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের মধ্যে প্রথম ফুটবল ম্যাচটি হয় ১৯১৪ সালে৷ বুয়েনস আইরেসে অনুষ্ঠিত ঐ প্রদর্শনী ম্যাচে ৩-০ গোলে জিতেছিল আর্জেন্টিনা৷
ছবি: Reuters/L. Gonzalez
বেশি জয় ব্রাজিলের
এখন পর্যন্ত দুই দলের মধ্যে ১১১টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ এর মধ্যে ব্রাজিল জিতেছে ৪৬টি ম্যাচ৷ আর্জেন্টিনা জিতেছে ৩৯টিতে৷ ড্র হয়েছে ২৫টি ম্যাচ৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
নিয়মিত প্রতিযোগিতা
আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট খুলিও আর্হেন্তিনো রোকার উদ্যোগে দুই দেশের মধ্যে একটি নিয়মিত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল৷ এর নাম দেয়া হয়েছিল কোপা রোকা৷ ১৯১৪ সালে প্রথম ম্যাচটি আয়োজিত হয়েছিল৷ শেষ ম্যাচটি হয় ১৯৭৬ সালে৷
ছবি: DW/M. Mamun
আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় জয়
১৯৪০ সালে বুয়েনস আইরেসে কোপা রোকার এক ম্যাচে ৬-১ গোলে জিতেছিল লা আলবিসেলেস্তেরা৷ আর ১৯৩৯ সালে রিও-র মাঠে গিয়ে সেলেসাওদের ৫-১ গোলে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনা৷
ছবি: DW/M. Mamun
ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় জয়
ঘরের মাঠে ১৯৪৫ সালে ৬-২ গোলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছিল সেলেসাওরা৷ আর আলবিসেলেস্তেদের মাঠে গিয়ে সেলেসাওরা সবচেয়ে বড় জয়টি পেয়েছিল ১৯৬০ সালে (৪-১)৷
ছবি: DW/H. Ur R. Swapan
ব্রাজিলের গুরুত্বপূর্ণ দুটি জয়
২০০৪ সালের কোপা অ্যামেরিকার ফাইনালে পেনাল্টিতে ৪-২ গোলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছিল ব্রাজিল৷ এরপর ২০০৭ সালে একই টুর্নামেন্টের ফাইনালে আলবিসেলেস্তেদের ৩-০ গোলে হারিয়েছিল সেলেসাওরা৷
ছবি: Getty Images/AFP
আর্জেন্টিনার গুরুত্বপূর্ণ দুটি জয়
১৯৩৭ সালের কোপা অ্যামেরিকার ফাইনালে ২-০ গোলের জয়৷ ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ০-০ গোলে ড্র আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে উঠতে ও প্রথম বিশ্বকাপ জিততে সহায়তা করেছিল৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Pimentel
7 ছবি1 | 7
মান পড়ছে
তবে ঘটনা হলো, ব্রাজিলের ফুটবল লিগ শুধু যে এই তারকা ফুটবলারদের হারাচ্ছে তাই নয়, তদাদের মান সমানে পড়ছে। প্রচুর ফুটবলার চলে যাচ্ছেন। তাদের হয়ত কেউ তেমনভাবে নজর করে না।
এভাবেই ফুটবল প্রতিভাদের নিয়ে যাচ্ছে ইউরোপের ক্লাবগুলি।
গ্রাফিট বলেছেন, ব্রাজিলের ফুটবলাররা ইউরোপীয় ঘরানার ফুটবলের সঙ্গে খুব সহজে মানিয়ে নেয়। আর হারিয়ে যায় ব্রাজিলের ঘরানা।
এবার ব্রাজিলের জাতীয় দলের হয়ে যখন ফুটবলাররা খেলতে আসেন, তখন ব্রাজিলের ঘরানার সঙ্গে ইউরোপের ঘরানার সংঘাত শুরু হয়।
২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে ব্রাজিল বিদায় নিয়েছিল।