২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার শাহবাগে লক্ষ মানুষ সমবেত হয়ে যখন ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল, তখনই তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ প্রশ্ন ওঠে ‘মৃত্যুদণ্ডের’ কার্যকাররণ নিয়ে৷
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন সময়ে বহু লোক, বিশেষ করে যাঁরা বাংলাদেশি নন, এমন বন্ধুবান্ধব, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের লোকজন একটি জিনিস বোঝার চেষ্টা করেছেন যে কেন বাংলাদেশিরা একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের মতো একটি শাস্তির দাবি করছেন৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি যখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে জনদাবি গড়ে উঠছে – ব্যাপারটি অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়৷
আমরা কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড চাই – এটা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছেই পরিষ্কার, কিন্তু যাঁরা আমাদের জুতায় পা রেখে ইতিহাসের পথ হেঁটে আসেননি, তাঁদের পক্ষে এটা সহজে বোঝা মুশকিলই বটে৷ আজকের লেখাটিতে তাই দেখার চেষ্টা করব, কেন একটি জাতির বেশিরভাগ মানুষই যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কামনা করে৷
প্রথমেই মনে রাখা ভালো, মত্যুদণ্ড নিয়ে যে জনদাবি গড়ে উঠেছে সেটা কোনো নতুন দাবি নয়, কোনো একক ব্যক্তি বা ‘ক্রিমিনালের' জন্যও নয়৷ অর্থাৎ আন্দোলনরত মানুষ নতুন করে মৃত্যুদণ্ড চাইছে না৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যে বর্বরতম গণহত্যা চালানো হয়েছিল, তার শাস্তি হওয়াটা ছিল খুব জরুরি৷ সেই লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘দ্য বাংলাদেশ কোলাবরেটর্স (স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২' বা দালাল আইন আদেশ শিরোনামে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়৷ দ্রুত বিচারের জন্য সরকার সারা দেশে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে৷ ১৯৭৩-এর অক্টোবর পর্যন্ত দুই হাজার ৮৮৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়৷ এ সব মামলায় সাজা দেওয়া হয় ৭৫২ জনকে এবং বাকিদের বিচার কাজ চলছিল৷ প্রাথমিকভাবে এই আইনের আওতায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে সক্রিয় বিরোধিতা করায় মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়৷
এই আইনটি কোনো কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য করা হয়নি৷ এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনৈতিকভাবে অথবা অন্য যে কোনো পরিস্থিতির চাপে যাঁরা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের বিষয়টিও খুব মানবিকভাবে, ক্ষমা এবং ঔদার্যের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে৷ গুরুত্ব বিবেচনায় অপরাধের মাত্রা কম- এমন অপরাধীদেরকে এ সময় ক্ষমা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়৷
১৯৭৩-এর ৩০শে নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়৷ এতে করে ২৫ হাজার ৭১৯ জন আসামি ছাড়া পান৷ এই ক্ষমা ঘোষণার সময় বলা হয়, সুনির্দিষ্টভাবে ‘ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘর-বাড়ি অথবা জলযানে অগ্নিসংযোগের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হবে না৷' অর্থাৎ এ সময় যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – এ রকম গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের জন্য চিহ্নিত অপরাধীদের বিচার অব্যাহত রেখে বাকিদের বাংলাদেশের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য ক্ষমা এবং ঔদার্য প্রকাশ করে একটি যুদ্ধবিধ্বস্থ রাষ্ট্র৷
বাকি আসামীদের বিচার চলতে থাকে এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে তদন্তও চলতে থাকে৷ এই অপরাধীদের মাঝে ৭৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজাও হয়৷ পরে ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল হলে ৩১শে ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান ‘দালাল আইন' বাতিল করেন৷ ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়৷ সে সময় চারটি সুনির্দিষ্ট অপরাধে কারাগারে আটক ১১ হাজার আসামি, এমনকি সাজাপ্রাপ্তরাও জেল থেকে ছাড়া পান৷
আবারো বলি, এই টাইমলাইনটির বিষয়টি আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে৷ আজকে যে বিচার বাংলাদেশে অব্যাহত আছে, সেটা কোনো নতুন বিচার নয়, এটা আসলে পুরোনো একটি বিচার, যা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল, সেই বিচারটিই পুনরুদ্ধার করে অব্যাহত রাখা হয়েছে৷
জেগে আছে প্রজন্ম চত্বর
মূল দাবি একটাই, ‘যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই’৷ এই দাবি নিয়ে পাঁচই ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগ চত্বরে অবস্থান করছে তরুণ প্রজন্ম৷ তাদের সমর্থন জানাচ্ছে সবশ্রেণির মানুষ৷ ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েকদিন৷ কিন্তু এক চুল নড়েনি তারা৷
ছবি: Reuters
লাগাতার আন্দোলন
শাহবাগে অবস্থান নেওয়া তরুণ প্রজন্ম গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি ধরে লাগাতার তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে অনড় তারা৷ ডয়চে ভেলের ওয়েবসাইটে নিয়মিত সেখানকার হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জাতীয় দলের আগমন
রবিবার প্রজন্ম চত্বরে এক টুকরো আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে এসেছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়রা৷ আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল, শাহবাগে অবস্থান নেওয়া ব্লগার, তরুণ সমাজের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে আসছেন তাঁরা৷ রবিবার সেই খবরের সত্যতা প্রকাশ পেলো৷
ছবি: REUTERS
টুইটার লড়াই
হ্যাশট্যাগ #shahbag, কেউ কেউ ব্যবহার করছেন #shahbagh - আসলে শাহবাগের ইংরেজি বানান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে৷ উইকিপিডিয়া শেষের এইচটি বাদ দিলেও ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার সেটি ধরে রেখেছে৷ এই বিভ্রান্তি অবশ্য টুইটার লড়াইকে পেছনে ফেলেনি৷ বরং সমানতালে দু’টি হ্যাশটাগ দিয়েই জানানো হচ্ছে আন্দোলনের অগ্রগতি৷
ছবি: REUTERS
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে ‘শোধরানোর’ চেষ্টা
শাহবাগের প্রতিবাদ কি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে না ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে? বিবিসি ইংরেজি বিভাগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনামে এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল৷ টুইটারে আন্দোলনকারীদের অব্যাহত দাবির পর সেই শিরোনামে বদল এসেছে৷ ইসলামপন্থী বাদ দিয়ে যুদ্ধাপরাধ শব্দটি জোড়া হয়েছে সেখানে৷ এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আমারব্লগ৷
ছবি: amarblog.com
‘শাহবাগ সাইবার যুদ্ধ’
প্রজন্ম চত্বরে অবস্থান করছেন ‘শাহবাগ সাইবার যুদ্ধ’ দলের অনেক সদস্য৷ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইট ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধীদের চরম শাস্তির দাবিকে আরো সোচ্চার করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা৷ পাশাপাশি প্রজন্ম চত্বরের সর্বশেষ পরিস্থিতিও ইন্টারনেটে তুলে ধরা হচ্ছে এদের মাধ্যমে৷
ছবি: REUTERS
‘আপনার সহায়তা প্রয়োজন’
ডয়চে ভেলের টুইটার পাতাতে আন্দোলনকারীদের কিছু বার্তা আমরা পেয়েছি৷ জিন্নাত গোনিম নামক ঢাকার এক বাসিন্দা টুইটারে লিখেছেন, ‘‘আমরা কোন রাজনৈতিক দল, ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নই৷ আমরা বাংলাদেশি৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাচ্ছি, আমার মায়ের হত্যাকারীর, বোনের ধর্ষকের বিচার চাচ্ছি৷ আমাদের আপনার সহায়তা প্রয়োজন৷’’
ছবি: twitter.com
এই প্রজন্মের নারী মুক্তিসেনাদের লড়াই
গত কয়েকদিন ধরেই গণমাধ্যমের শিরোনামে জায়গা করে নিচ্ছেন লাকি আক্তার৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী আন্দোলন শুরুর দিন থেকে রয়েছেন শাহবাগে৷ তাঁর মতো আরো কয়েকজন নারী মুহুর্মুহু শ্লোগানে কাপিয়ে তুলছেন প্রজন্ম চত্বর৷ বিভিন্ন স্কুলকলেজের ছাত্রীরা মাঝেমাঝে হাজির হচ্ছেন আন্দোলনে৷
ছবি: REUTERS
‘ফাঁসির মঞ্চ’ প্রস্তুত
‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’ - এই হচ্ছে প্রজন্ম চত্বরে আন্দোলনরতদের মূল দাবি৷ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করলে তা প্রত্যাখ্যান করে তরুণ প্রজন্ম৷ তারা চায় ফাঁসির আদেশ৷ শাহবাগে প্রতীকী ‘ফাঁসির মঞ্চ’ তৈরি করে যুদ্ধাপরাধীদের চরম শাস্তির অপেক্ষায় আছে ব্লগাররা৷
ছবি: Reuters
সপরিবারের শাহবাগে
শাহবাগে অনেকেই হাজির হচ্ছেন সপরিবারে৷ ক্রিকেটার থেকে শুরু করে সাহিত্যিক, অধ্যাপক অনেকেই এসেছেন সপরিবারে৷ এই ছবিতে এক শিশুকে দেখা যাচ্ছে শাহবাগ চত্বরে, প্রতিবাদী ব্যানার মাথায় জড়িয়ে৷
ছবি: REUTERS
ব্লগার এন্ড অনলাইন অ্যক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক
‘ট্র্যাইবুনালে কাদের মোল্লার প্রহসনের রায়ের বিরুদ্ধে মহাসমাবেশ’ - এই শিরোনামে পাঁচ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল ব্লগার এন্ড অনলাইন অ্যক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক৷ ব্লগারদের আহ্বানে সেদিন শাহবাগে জড়ো হতে শুরু করে সাধারণ মানুষ৷ এখন এই আন্দোলন আমজনতার৷
ছবি: REUTERS
10 ছবি1 | 10
সেই সময়কার বিচারের সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড৷ অপরাধ বিবেচনায় আজকে শীর্ষ যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, তাঁদের সবার অপরাধই মানবতার বিরুদ্ধে জঘণ্যতম অপরাধ, সেখানে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনতা শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করবে, এটাই স্বাভাবিক৷
আজকের যুগে বিশ্বে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড রোধের ব্যাপারে অনেক ‘অ্যাক্টিভিস্ট' কাজ করছেন৷ ইতিমধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ডের মতো চূড়ান্ত শাস্তির বিধান রহিত হয়ে গেছে৷ শান্তির দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বন্ধ করে দেয়াটা হয়ত সমাধান৷ কিন্তু এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শান্তি অর্জন করতে হলে শান্তি স্থাপনের সবগুলো বাধাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই৷
এ প্রসঙ্গে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলের কথাটি এখানে টানা যেতে পারে৷ ইতিহাসের মহত্তম ট্রায়েল হিসেবে যে বিচারকে অভিহিত করা হয়েছে সেই ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলেও ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, কারণ, মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘণ্যতম অপরাধ তারা করেছিল, তাদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ভুক্তভোগী মানুষদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে সুস্থ জীবনধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিল না৷ যদি কোনো কারণে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলের বিচার-কাজ স্থগিত কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতো, আমার বিশ্বাস পরবর্তীতে বিচারেও একই রায় দেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না৷
আমাদের বাংলাদেশে এই অবস্থা আরো সমস্যাসংকুল৷ ১৯৭৫ সালে একবার আইন বাতিল করে বিচার শুধু বন্ধই করে দেয়া হয়নি, বরং যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল৷ এই সুযোগে পরবর্তীতে তারা দেশের মধ্যে অর্থ ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি তৈরি করেছে৷ আবার যদি কখনো দূর্ভাগ্যক্রমে এই দেশে তাদের স্বপক্ষের শক্তির কাছে ক্ষমতা চলে যায় তাহলে আবারও এই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে৷ তখন আজকে যে বিচার চালানো হচ্ছে তার শাস্তি হিসেবে কারাভোগী আসামীরা বের হয়ে আসতে পারে৷ সেক্ষেত্রে একটি দেশের ইতিহাসের জঘণ্যতম গণহত্যার আসামীরাই শুধু বেরিয়ে আসবে- শুধু তাই নয়, এই বিচারের বিচারক, আইনজীবী, তদন্ত কর্মকর্তা এবং সাক্ষীরাও জীবনের ঝুঁকিতে পড়বেন৷
কাদের মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলা কাদের মোল্লাকে ইসলামপন্থিরা বলছেন ‘শহিদ৷’ এই শহিদের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিভিন্ন জেলায় চলছে সহিংসতা৷ মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা নিয়ে আমাদের বিশেষ ছবিঘর৷
ছবি: AP
ইসলামপন্থিদের কাছে ‘শহিদ’
জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা কাদের মোল্লাকে মনে করছেন একজন ‘শহিদ৷’ যিনি ‘‘ইসলামি আন্দোলন করার কারণে’’ ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন৷ এই ‘শহিদের’ মৃত্যুতে তাই শুক্রবার বিভিন্ন জেলায় গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে জামায়াত-শিবির৷ মোল্লার জন্য পাকিস্তানেও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ছবিটি সেখানকার৷
ছবি: Rizwan Tabassum/AFP/Getty Images
অনেকের কাছে ‘মিরপুরের কসাই’
তবে বাংলাদেশে অনেকেই কাদের মোল্লাকে মনে করেন ‘মিরপুরের কসাই,’ যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷ ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী ছয়টি অভিযোগের পাঁচটি প্রমাণিত হয়েছে৷ ফলে তাকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত দশটা এক মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মোল্লার পরিবার আক্রান্ত
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর ঢাকার মগবাজারে তার পরিবারের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে৷ কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল বাংলাদেশের একাধিক সংবাদপত্রের কাছে দাবি করেন, ‘‘কিছু ছাত্রলীগের নেতা পরিবারের সদস্যদের উপর হামলা চালায়৷’’ এসময় মোল্লা পরিবারের কয়েক সদস্যকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/Afp/Munir Uz Zaman
ফরিদপুরে শেষ ঠিকানা
বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মাইক্রোবাসে করে কাদের মোল্লার মরদেহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করা হয়৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘স্থানীয় সময় রাত ৪টার দিকে ফরিদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়৷’’
ছবি: Mustafiz Mamun
ফাঁসির রায় উদযাপন
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার শাহবাগে সমবেত হন অসংখ্য মানুষ৷ তাদের আন্দোলনের ফলে পরবর্তীতে আইন সংশোধন করে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়৷ সেই আপিলে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হয় মোল্লার৷ রায় কার্যকরের পর স্বাভাবিকভাবেই তাই শাহবাগে আনন্দ মিছিল দেখা গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্যাপক সহিংসতা
এদিকে, শুক্রবার বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে পাঁচ ব্যক্তি৷ রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সড়ক অবরোধ করে, সেতু ভেঙে, গাড়ি পুড়িয়ে চালানো হচ্ছে নাশকতা৷ এমতাবস্থায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷
ছবি: DW/M. Mamun
তবে সাঈদীর মতো নয়
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শাহেদুল আনাম খান এবং শরীফ এ কাফি অবশ্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জামায়াত তার সহিংস তত্পরতা নিয়ে কতদূর এগোতে পারবে তাও দেখার বিষয় আছে৷ কারণ সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর তারা যে মাত্রায় সহিংসতা চালাতে সক্ষম হয়েছিল এবার এখন পর্যন্ত তারা সেই মাত্রায় যেতে পারেনি৷ এর কারণ আগের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়েছে৷’’ তবে এই প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় বলেই মনে করেন এই দুই বিশেষজ্ঞ৷
ছবি: DW/M. Mamun
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দিতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন৷ তবে মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়৷
ছবি: Reuters
মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না জার্মানি
বৃহস্পতিবার জার্মানির মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মার্কুস ল্যোনিং এক বিবৃতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘জার্মানি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না৷’’ তাই ফাঁসির পরিবর্তে কারাদণ্ড দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: dapd
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
বাংলাদেশের মানুষ এই পটপরিবর্তনকে ভয় পায়৷ তাই তারা মনে করে, বিচারের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হওয়াটাই এই আশংকা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়৷ এ জন্যই বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতাদের মৃত্যুদণ্ড না হলে মানুষের মন খারাপ হয়, তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন এবং প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন৷
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে ৪৩ বছর কেটে গেছে৷ বাংলাদেশের মানুষ এখন এই আটকে থাকা বিচারটি সম্পন্ন করে সামনের দিকে তাকাতে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন৷ তাঁরা মনে করেন, ৩০ লক্ষ শহিদের হত্যার বিচার সম্পন্ন করার মাধ্যমে যে মানসিক শান্তি তাঁরা লাভ করবেন, তার মাধ্যমে তাঁরা দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিয়ে কাজ করতে পারবেন৷ ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের উত্তরাধিকারীরা দেশে ও বিদেশে শান্তি স্থাপনে, যুদ্ধ-গণহত্যার বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান ব্যক্ত করে বিশ্বকে আরো সুন্দর করে তুলতে পারেন৷ আর সেটা করতে হলে বিগত যুদ্ধাপরাধের বিচারটি চূড়ান্ত হওয়া দরকার৷ যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত শীর্ষ অপরাধীরা কখনো মুক্তি পাবেন, এমন আশংকা তাঁদেরকে উদ্বিগ্ন করে তোলে৷
বাংলাদেশে চলমান এই বিচারটি কোনোভাবেই কোনো ক্ষোভ ও বিদ্বেষের বিচার নয়, কারণ, সর্বোচ্চ সহনশীলতা ও উদারতা দেখিয়ে যুদ্ধ পরবর্তী সময়েই ২৬ হাজার অভিযুক্তকে ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে৷ এখন যাঁদের বিচার চলছে, তাঁরা ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন৷ শান্তির জন্য, নিহত লাখো মানুষের প্রতি ন্যায়বিচারের জন্যই এই বিচার সম্পন্ন করা জরুরি এবং এদের প্রত্যেকটি অপরাধের জন্যই যেহেতু সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য, তাই তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি করা এই দেশের জনসাধারণের অধিকার৷
ন্যুরেমবার্গের ট্রায়ালে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পরেই যুদ্ধবিদ্ধস্থ ইউরোপ আবার শান্তি ও কল্যাণের পথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগোতে পেরেছে৷ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরে বাংলাদেশও শান্তি ও কল্যাণের পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পাবে৷ আর তাই, শান্তি ও কল্যাণের জন্যই গত ৪৩ বছর ধরে আমরা এই অপরাধীদের ফাঁসি চাচ্ছি৷ এদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সেই চাওয়া শেষও হবে না৷