রাগ আর জিনিসের দামের মধ্যে অসম্ভব মিল৷ দুটোই কেবল বাড়ে, কমে না৷
বিজ্ঞাপন
সবজি, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে টমেটো, লেবু পর্যন্ত যাতেই হাত দিন, ছ্যাঁকা লাগবে৷ তেমনই, চারপাশে যে দিকে তাকান, দেখবেন শুধু ক্রুদ্ধ মানুষজন৷ রাগ এবং উত্তেজনার পারদ কেবল বাড়ছে৷ টিভির বিতর্কে চোখ রাখলে মনে হবে, রেগেমেগে, উত্তেজনায় রাজনীতিক বা উপস্থাপকের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে৷ গলা ব্যাথা তো হবেই৷ এখনই একজন আরেকজনের উপর চড়াও হয়ে যাবেন৷ সংসদের অধিবেশন কোনোদিন শান্ত থাকাটাই খবর৷
ক্রিকেট বা ফুটবল দেখুন, মনে হবে খেলা নয় যুদ্ধ চলছে৷ দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে, একে অন্যের দিকে তেড়ে গিয়ে একাকার কাণ্ড৷ রেফারি পেনাল্টি দিলে বা হলুদ কার্ড দেখাতে গেলেই যাচ্ছেতাই দৃশ্য৷ ভদ্রলোকের খেলা বলে পরিচিত ক্রিকেটে এখন আম্পায়ারও ছাড় পাচ্ছেন না৷ ক্রিকেটাররা একে অন্যের দিকে হামেশাই তেড়ে গিয়ে চেঁচাচ্ছেন৷ যে কথাগুলো বলছেন, তা একেবারেই শ্রুতিমধুর নয়৷
লকডাউনে পুলিশ চেকপোস্টের অভিজ্ঞতা
করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ ঠেকাতে দেশব্যাপী ‘‘সর্বাত্মক লকডাউন’’ এর দ্বিতীয় সপ্তাহ শুরু হয়েছে ২২ এপ্রিল৷ জরুরি প্রয়োজনে চলাফেরার জন্য পুলিশ কর্তৃক ‘মুভমেন্ট পাস’ চালু করা হলেও অনেকের কাছে তা পাওয়া যায়নি৷
ছবি: Mohammad P. Hossain/REUTERS
মোটরবাইক থেকে নামিয়ে দেয়া
মিরপুরের একটি চেকপোস্ট পার হওয়ার সময় পেশায় ঠিকাদার মোঃ জামাল উদ্দিন নামের একজনকে মোটরবাইক থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ কথা বলে জানা গেলো, রাইড শেয়ারিং এর মাধ্যমে মোটরবাইকে করে দুইজন চলাফেরা করা নিষেধ হওয়ায় পুলিশ এই পদক্ষেপ নিয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ইউনিফর্ম পরায় ঝামেলা হয়নি
মাহমুদুল হাসান নামের একজন প্রকৌশলী জানান, লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই তিনি বের হচ্ছেন৷ তবে তার প্রতিষ্ঠানের দেয়া বিশেষ পোশাক (ইউনিফর্ম) পরে গত কয়েকদিন চলাফেরা করছেন৷ প্রতিষ্ঠানের জরুরি সেবার কাগজপত্র সঙ্গে থাকায় আর কোন ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়নি বলে জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হেঁটে যেতে বাধ্য করা
ঢাকার মগবাজারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে সহকারী হিসেবে কাজ করেন তানিশা রহমান৷ লকডাউনের প্রথমদিন তাঁকে রিক্সা থেকে নামিয়ে দিয়ে কর্মস্থলে হেঁটে যেতে বাধ্য করা হয়েছে৷ জরুরি সেবাদানকারী পরিচয় দিয়েও কোন লাভ হয়নি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পুলিশের ধাওয়া
মান্নান আহমেদ নামের একজন রিক্সাচালক জানান, ৪-৫ দিন আগে মিরপুর ১০ নম্বরের চেকপোস্টে পুলিশ তাকেসহ আরও অনেক রিক্সাচালককে ধাওয়া করে৷ যাত্রী থাকার পরেও তাদের কোন রকম কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘এখন আর পুলিশ ধরে না’
ধানমন্ডির একটি সুপারশপে ব্র্যান্ড প্রমোটার হিসেবে কর্মরত মনিরা আক্তার জানান, তার কর্মস্থল বাসা থেকে অনেক দূরে৷ লকডাউন শুরু প্রথম দুই দিন চেকপোস্টগুলোতে পুলিশ বেশ তৎপর থাকলেও এখন আর কোন সমস্যা হয় না বলে জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘মামলার ভয়ে গাড়ি চালাই না’
রাজু আহমেদ নামের একজন মোটরবাইক চালক জানান, লকডাউন শুরুর দিন যাত্রী নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ চেকপোস্টে তাকে এক হাজার টাকার মামলা দেওয়া হয়৷ এরপর থেকে তিনি আর গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছেন না৷ কারণ হিসেবে তিনি জানান, ‘যা কামাই করি সবই যদি জরিমানা দিতে হয়, তাইলে আর লাভ হইলো কি?’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে ছাড়
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত মারিয়া গোমেজ জানান, লকডাউনে স্বাস্থ্যসেবাদানকারী হিসেবে চলাফেরার সময় তার ব্যক্তিগত কোন তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই৷ তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ব্যাপারে সহকর্মীদের হেনস্তা হওয়ার তথ্য পেয়েছেন বলে তিনি জানান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শেষ রক্ষা হলো না
সৌদিআরব প্রবাসী জাকির হোসেন কারওয়ান বাজার থেকে বিমানের টিকেট নিতে এসেছেন টাঙ্গাইল থেকে৷ ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় বিজয় সরণি মোড়ে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য তাকে ১২০০ টাকা জরিমানা করে৷ এর আগে আরো দুই জায়গায় ছাড় পেলেও এখানে এসে অনেক অনুরোধ করেও শেষ রক্ষা হলো না বলে জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সমস্যা হয়েছে প্রথম তিন দিন
সৈয়দা রাকিবা আক্তার নামের একজন ওষুধের ব্যবসায়ী জানান, লকডাউন শুরুর প্রথম ২-৩ দিন চলাচলে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর বাধার মুখে পড়তে হলেও এখন নিয়ম কানুন ঢিলেঢালা হয়ে গেছে৷ এভাবে দিনের পর দিন কর্মজীবী মানুষের পক্ষে ঘরে বসে থাকা সম্ভব না বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ক্ষমা চেয়ে রক্ষা
সিএনজি অটোরিক্সা চালক মোঃ কামাল হোসেন লকডাউনের পর আজই প্রথম বের হয়েছেন৷ বিজয় সরণির মোড়ে তিনজন যাত্রী নেওয়ার অপরাধে পুলিশ তাকে মামলা দিতে চায়৷ পরে বিশেষ কারণ দেখিয়ে এবং হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
10 ছবি1 | 10
সামাজিক মাধ্যমের অবস্থা তো কহতব্য নয়৷ কোনো যুক্তিসঙ্গত মন্তব্য করলে বা মত না মিললেই কিছু মানুষ রে রে করে তেড়ে আসবেন৷ গালাগালি দেবেন৷ কোন দলের এজেন্ট তা জানতে চাইবেন৷ ১৪ পুরুষ উদ্ধার করে দেবেন৷ তার মধ্যে যদি দুই অক্ষরের গালাগালি থাকে তা হলে বুঝতে হবে অল্পের উপর পার পাওয়া গেল৷ না হলে চার বা ততোধিক অক্ষরের গালাগালির স্রোত বইবে৷ গালাগলি নিয়ে একটা তত্ত্ব আছে৷ গালি দিলে নাকি মনের ক্লেদ দূর হয়৷ তা মানুষের মনে অন্তহীন ক্লেদ আছে নাকি!
নাকি এটা পুরোপুরি পরিচয়ের সংকট, আইডেনটিটি ক্রাইসিস? অথবা মানসিক চাপের প্রেসার কুকারে ক্রমাগত সেদ্ধ হতে হতে সর্বত্র বেরিয়ে আসছে অস্থিরতা, রাগ, হতাশা, খারাপ ব্যবহার৷ কোনো নিয়মকানুনই আর মানতে চাইছে না মানুষ৷ না হলে পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়া বা তা যাচাই করতে চাওয়া এমন কী আর গুরুতর ব্যাপার! এটা তো পুলিশ বা টোল বুথ কর্মীদের কাজের অঙ্গ৷ সেটাই করতে চেয়েছিলেন নয়ডা এক্সপ্রেসওয়ের একটি টোল বুথের কর্মীরা৷ সেখানে বাসে করে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা যাচ্ছিলেন৷ তাতে একজন এমএলএ বা বিধায়কের স্টিকার লাগানো ছিল৷ টোল কর্মী যাচাই করে দেখতে চেয়েছিলেন, সেই স্টিকারটা ঠিক কিনা৷ কিন্তু তাতে কান না দিয়ে শুরু হলো মারধর৷ একে রাজনৈতিক দলের কর্মী, তার উপর বিধায়কের স্টিকার বলে কথা৷ তাদের তো যেতে দিতেই হবে৷ নিয়ম থাক বা না থাক৷
করোনার আগে প্রায়ই খবর আসতো, সাংসদ গিয়ে টোলের কর্মীদের মেরেছেন, তার সমর্থকরা টোল ভাঙচুর করেছেন৷ কেন? তারা তো সচরাচর একটা গাড়ি নিয়ে ঘোরেন না৷ সঙ্গে একাধিক গাড়ির মিছিল থাকে৷ তাদের কাছে টোল চাওয়া হয়েছিল৷ ব্যস, আর যায় কোথায়? ২০১৮, ২০১৯-এ উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থানে এরকম ঘটনা প্রচুর ঘটেছে৷
২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি ইন্ডিয়া টুডে ওয়েবসাইটে একটা রিপোর্টে অনেকগুলি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছিল, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা সরকারি কর্মীদের চড় মেরেছেন বা গায়ে হাত তুলেছেন৷ সেই তালিকা অনুযায়ী, মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান তার দেহরক্ষীকে একটি জনসভায় চড় মেরেছিলেন৷ কারণ, জানা নেই৷ হিমাচলে কংগ্রেসের বিধায়ক আশা কুমারী চড় মেরেছেন একজন নারী কনস্টেবলকে৷ কারণ, ওই কনস্টেবল তার গাড়ি থামিয়েছিলেন৷ শিবসেনার সাংসদ বিমানকর্মীকে জুতোপেটা করেছিলেন৷
গ্যাস পাইপলাইনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গেছিলেন বলে একজন জেলা কালেক্টরকে মেরেছিলেন মহারাষ্ট্রে এনসিপি-র বিধায়ক৷ রাজস্থানে পুলিশ কর্মী চালান কেটেছিল বলে তাকে পিটিয়েছিলেন বিজেপি বিধায়কের স্বামী৷ মহারাষ্ট্রে এক বিজেপি বিধায়ক থানায় গিয়ে পুলিশকে মেরে এসেছিলেন৷
আর কত ঘটনার উল্লেখ করবো৷ এই ঘটনাগুলো কিন্তু পুলিশ বা সরকারি কর্মীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনীতিকদের আক্রোশ নয়৷ বরং, তারা এখানে পরিচয় সংকটে ভুগেছেন৷ পুলিশ বা সরকারি কর্মীরা আইন মেনে কাজ করেছেন৷ কিন্তু বিধায়ক, সাংসদের মনে হয়েছে, তিনি এত ক্ষমতাবান হওয়ার পরেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো৷ এত সাহস হয় কী করে? হয় তাকে চেনার পরেও পুলিশ বা সরকারি কর্মী ব্যবস্থা নিয়েছে, পরিচয় দেয়ার পরেও থামেনি, অথবা তিনি যে নিয়ম কানুনের বাইরে সেটা পুলিশ মানেনি৷
স্টিকার নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ভিআইপি-দের ঝামেলা তো হামেশাই হয়৷ এক পুলিশ কর্তা জানিয়েছিলেন, আজকাল যে কোনো স্টিকারের হুবহু নকল করা যায়৷ তার বক্তব্য ছিল, ভুলে যাবেন না, নকল স্টিকার গাড়িতে লাগিয়ে ভারতের সংসদ ভবন আক্রমণ করেছিল জঙ্গিরা৷ তাই স্টিকার থাকা সত্ত্বেও পরিচয়পত্র দেখা বা তা যাচাই করা জরুরি৷ আর উপমহাদেশে এই স্বাভাবিক ঘটনা ঘটলেই দেখা যায় অস্বাভাবিক রাগ৷ এই অস্বাভাবিকতাই এখন নিয়ম৷
রাগ কমানোর দোকান!
রাগ, ক্রোধ, ক্ষোভ কিংবা হতাশা দূর করতে চীনের মানুষ একটি বিশেষ দোকানে যান, যার নাম ‘স্ম্যাশ’৷ সেখানে গিয়ে ইচ্ছেমতো জিনিসপত্র ভাঙতে পারেন তাঁরা৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
রাগের কক্ষ
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে গত সেপ্টেম্বরে একটি দোকান খোলা হয়, যেখানে ক্রেতারা নিজেদের হতাশা, রাগ, ক্ষোভ দূর করতে পারেন৷ ইতিমধ্যে দোকানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
স্ম্যাশ বা ভাঙা
বেইজিংয়ে প্রতিষ্ঠিত দোকানটির নাম ‘স্ম্যাশ’৷ সেখানে গিয়ে মানুষ ইচ্ছেমতো জিনিস ভাঙতে পারেন৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
হতাশা ও ক্রোধ থেকে মুক্তি
এভাবে তাঁরা হতাশা, রাগ কিংবা ক্রোধ থেকে মুক্তি পেতে চান৷ মদের বোতল থেকে শুরু করে পুরোনো টিভি, টেলিফোন, কম্পিউটার, ফার্নিচার, ম্যানিকিন ইত্যাদি ভাঙতে পারেন ক্রেতারা৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
অর্থের বিনিময়ে হতাশা থেকে মুক্তি
এই দোকানে গিয়ে জিনিসপত্র ভাঙার জন্য অর্থ গুণতে হয়৷ আধ ঘণ্টার জন্য ক্রেতাদের প্রায় ২৩ ডলার দিতে হয়৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
প্রতি মাসে ৬০০ ক্রেতা
সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠিত দোকানটি দিয়েছেন জিন মেং ও তার বন্ধুরা৷ প্রতিমাসে গড়ে অন্তত ছয়শ’ জন ক্রেতা এই দোকানে যান৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
প্রয়োজনীয় পণ্য
পুরনো জিনিস পাওয়া যায় এমন দোকান থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য জোগাড় করা হয়৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
রাগ কমানোর অস্ত্র ব্যাট এবং হাতুড়ি
এসব জিনিস ভাঙতে ক্রেতাদের হাতে দেয়া হয় ব্যাট এবং হাতুড়ি৷ এগুলো দিয়ে তারা মদের বোতল গুঁড়ো করেন, এমনকি ম্যানিকিনগুলো ইচ্ছেমত ভাঙেন৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
মাসে ১৫ হাজার বোতল
ক্রেতাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ায় বর্তমানে প্রতি মাসে দোকানটিতে ১৫ হাজার কাচের বোতলের প্রয়োজন হয়৷
ছবি: Reuters/Jason Lee
ক্রেতাদের বয়স
সাধারণত দোকানটিতে ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সি মানুষরা বেশি যান৷ অল্পবয়সি একজন ক্রেতা জানান, জিনিসগুলো ভাঙার পর সেগুলোর ক্ষতবিক্ষত অবস্থা দেখে তাঁর মন শান্ত হয়৷