1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কেন ওয়াকফ নিয়ে অবস্থান বদল রাজ্যের?

৩ ডিসেম্বর ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ সম্পত্তির বিশদ তথ্য কেন্দ্রীয় পোর্টালে আপলোড করা হচ্ছে। হঠাৎ কেন এই সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকারের?

ইমাম ও মুয়াজ্জিমদের সমাবেসে ভাষণ দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২৫ সালের এপ্রিলের ছবি।
ওয়াকফ সম্পত্তি নথিভুক্ত করা নিয়ে সিদ্ধান্তবদল করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: Debajyoti Chakraborty/picture alliance/NurPhoto

ভারতে মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তির তথ্য সরকারি খাতায় নথিবদ্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রীয় এই আইন কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। হঠাৎ তারা সিদ্ধান্ত বদল করে এই আইন অনুযায়ী তথ্য দিতে বলেছে পোর্টালে।

ওয়াকফ সম্পত্তির নথিভুক্তি

এ রাজ্যে ৮২ হাজার ৬০০-র বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ভবন, ভূসম্পত্তি ওয়াকফের অধীনে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ এস্টেটের সংখ্যা আট হাজারের উপরে। দেশের অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও তথ্য আপলোড করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারি পোর্টাল উমিদ-এ।

কেন্দ্রীয় সরকার এই সংক্রান্ত নির্দেশ জারি করেছিল ছয় মাস আগে। এই সময়সীমা শেষ হতে চলেছে পাঁচ ডিসেম্বর। নির্দেশ জারির পরে রাজ্যে এ নিয়ে গন্ডগোল হয়, হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। রাজ্য সরকার জানিয়ে দেয় পশ্চিমবঙ্গে ওয়াকফ আইন কার্যকর হবে না।

একইসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াই চলছিল। গত সপ্তাহে শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয়, তারা ওয়াকফ আইন বলবৎ করার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করছে না। এরপরে রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু দপ্তর প্রত্যেক জেলায় বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে জানায়, ওয়াকফ সংক্রান্ত তথ্য কেন্দ্রীয় পোর্টালে আপলোড করতে হবে।

একদিকে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের কাজ চলছে। তার মধ্যে ওয়াকফ সম্পত্তির খতিয়ান সংগ্রহ করে আপলোড করা যথেষ্ট কঠিন হতে পারে। বিভিন্ন ধরনের তথ্য পোর্টালে দিতে হচ্ছে।

কোনো বিশেষ সম্পত্তি কোন বছরে ওয়াকফের অধীনে এসেছিল, তার এলাকা কতটা, কে রক্ষণাবেক্ষণ করেন, এই সম্পত্তির মূল্য কত ইত্যাদি নানাবিধ তথ্য পোর্টালে দিতে হচ্ছে। কিন্তু আর মাত্র দিন তিনেকের মধ্যে আদৌ কি সম্ভব সব তথ্য পোর্টালে তুলে দেওয়া?

এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী ও জমিয়তে উলেমা ইন হিন্দের রাজ্য সভাপতি সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী। তিনি বলেছেন, "মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি, তিনি যাতে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে এই সংক্রান্ত সময়সীমা বৃদ্ধির দাবি করেন।"

নেপথ্যে রাজনীতি

ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর রয়েছে। তৃণমূল সহ বিরোধীদের বক্তব্য, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার লক্ষ্যে এই আইন আনা হয়েছে। বিজেপির দাবি, জমি মাফিয়ারা মুসলমানদের জমি গ্রাস করে নিচ্ছে। জমি ওয়াকফের অধীনে সরকারি খাতায় নথিবদ্ধ হলে জমি কেড়ে নেয়া যাবে না।

কিন্তু আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী রাজ্যের অবস্থানের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, "আমরা গোড়া থেকে এর বিরোধিতা করেছি, এখনো করছি। রাজ্য সরকার কেন এতদিন পরে অবস্থান বদল করল, তার জবাব দিতে হবে।"

তৃণমূল সরকার প্রথমে বিরোধিতা করে কেন এখন এই আইন কার্যকর করছে?

সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "বিজেপি বিরোধী দলগুলি শাসিত রাজ্যের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে আপলোড করতে বলছে, সেভাবে আপলোড করে রাখা হোক। আপলোড করে না রাখলে, পরে টেকনিক্যালি এইসব ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো নিয়ে আইনি সমস্যা হতে পারে। ওয়াকফ আইনের যে সমস্ত ধারাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, তৃণমূল সেটাকে মেনে নেয়নি। আমার সঙ্গে ওয়াকফ কমিশনের চেয়ারম্যান আহমেদ হাসান ইমরানেরও কথা হয়েছে। পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীরও বক্তব্য আমি দেখেছি। ওদের পরিষ্কার বক্তব্য যে, আমাদের প্রতিবাদ আছে। কিন্তু যদি নিয়ম মেনে আপলোড না করা হয়, তাহলে সম্পত্তিগুলো নিয়ে সমস্যা হবে। সেজন্য আপলোড করা হচ্ছে।"

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম ডিডাব্লিউকে বলেন, "তৃণমূল দুদিকেই খেলছে। এসআইআর-এর ক্ষেত্রেও যেটা হলো, প্রথমে বিরোধিতা করল, কিন্তু পরে মেনেও নিল। এখন এসআইআর যাতে সুষ্ঠুভাবে হয়, সেজন্য চেষ্টাও চালাচ্ছে বিএলএ-র মাধ্যমে। আবার নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখছে। ওয়াকফের ক্ষেত্রেও একই জিনিস। প্রথমে ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে ছিল, এখনও তৃণমূলের অবস্থান ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে। কিন্তু আবার এই বিলটা যেহেতু পাশ হয়ে গিয়েছে, সেক্ষেত্রে এটাকে মেনে নিতে হবে।"

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক শিবাজীপ্রতিম বসু ডিডাব্লিউকে বলেন বলেন, "তৃণমূলকে তো সব সম্প্রদায়ের ভোটের কথা ভাবতে হচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ভোট ধরে রাখার পাশাপাশি এটাও ভাবতে হচ্ছে যে হিন্দুদের ভোট যেন সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে না চলে যায়। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার হাতে টাকা পৌঁছয় বা তারা বিভিন্ন সুবিধা পান। অর্থাৎ সংখ্যালঘুরা উপকৃত হন রাজ্যের কাছ থেকে। ওয়াকফে কোন রাজা, আগেকার পুরোনো নবাব, আগেকার অমুক-তমুক কাদের টাকা আছে, তার দ্বারা গরিব মুসলমানের কী উপকার হবে, তাদের জানা নেই। তাদের কাছে সরকারি প্রকল্প বেশি গুরুত্বপূর্ণ।"

সে কারণেই ওয়াকফের নথি পোর্টালে তোলার সিদ্ধান্তে তৃণমূলের বিশেষ সমস্যা হবে বলে মনে করেন না পর্যবেক্ষকরা।  

মইদুল বলেন, "আমার মনে হয় না খুব একটা বেশি এদিক-ওদিক হবে। কারণ মুসলিম ভোট এত তাড়াতাড়ি শিফট করে না। বিজেপির বিরুদ্ধে যিনি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হবেন, তাকেই মুসলিমরা সমর্থন করবে। এটা হতেই পারে যে এক-একটা জায়গায় হয়তো কংগ্রেস কিংবা বামের কোনো পছন্দের প্রার্থী লড়াই করলেন। কিন্তু আমার মনে হয় না, একটা-দুটো জায়গা ছাড়া তৃণমূল থেকে সংখ্যালঘু ভোটাররা সরে যাবে।"

শিবাজীপ্রতিম বলেন, "রাজ্যের সাধারণ মুসলমান দরিদ্র, ওয়াকফের ব্যাপারে তারা জানেন না। তাদের যদি কেউ প্ররোচিত না করে, যেমন মুর্শিদাবাদে হয়েছিল, তাদের  খুব একটা কিছু এসে যায় না এই ওয়াকফের কী হল না হল। ওয়াকফের যে সম্পত্তি, তাতে কোনো অংশীদারিত্ব নেই সাধারণ মুসলমানদের।"

তার মতে "ওয়াকফ বোর্ডের যারা মাথা, তারা অনেক ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিরও মাথা। তার ফলে তারা খুব সহজেই তারা সাধারণ মুসলমানদের প্রভাবিত করতে পারেন। কিন্তু ওয়াকফের সম্পত্তির তথ্য ডিজিটাইজেশন যদি হয়, তাতে যে সাধারণ মুসলমানরা খুব বিপদে পড়বেন এমনটা নয়। তাই তারা তৃণমূলের দিকেই থাকবে।"

ভোটার তালিকার সমীক্ষা সাধারণ মুসলমানদের ক্ষেত্রে বড় সমস্যার বলে তিনি মনে করেন। শিবাজী বলেন, "মুসলমানদের সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে এসআইআর। এর ফলে তাদের এখন অস্তিত্বের সংকট। ওয়াকফ নিয়ে কী আর মাথা ঘামাবেন তারা? এখন তাদের নাম ভোটার তালিকায় থাকলেও খসড়া তালিকা, চূড়ান্ত তালিকায় শেষমেশ কী হবে, তা নিয়ে অনেকে চিন্তিত। তাদের ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হবে কি না, তা নিয়েও ভাবনা রয়েছে। তাই মুসলমান প্রধান এলাকায় এনুমারেশন ফর্ম পূরণ বেশি হয়েছে। যেহেতু তাদের অস্তিত্বে টান পড়েছে, তাই তারা তৃণমূলের পাশে থাকবে।"

এআইএমআইএম বা মিম, আইএসএফ যে দলগুলির নেতৃত্বে মুসলমান নেতারা রয়েছেন, তারা ওয়াকফকে সামনে রেখে তৃণমূলকে কি বেগ দিতে পারবেন?
 
মইদুল বলেন, "এআইএমআইএম এখানে খুব একটা বেশি ফায়দা তুলতে পারবে না, কিন্তু আইএসএফের একটা সংগঠন আছে, একজন বিধায়ক আছে। আইএসএফ এটাকে ইস্যু করতে পারে। বাম-কংগ্রেসও কিছুটা ইস্যু করতে পারে। কয়েকটি পকেটে হয়ত তারা মুসলিম ভোট পেতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় না সামগ্রিক চিত্রটা খুব একটা বেশি এদিক-ওদিক হবে।
মুসলিমদের কাছে এখনো মূল বিবেচ্য হচ্ছে, কীভাবে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখবে। এটাই তাদের কাছে মূল ভাবনার বিষয়। এই মুসলমান সম্প্রদায় বাম আমলে, যখন তৃণমূল ও বিজেপির বোঝাপড়া ছিল, তারা বামেদের ভোট দিত। বিজেপিকে রোখাই সংখ্যালঘুদের মূল লক্ষ্য।"

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ