1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কেন কলকাতা এভাবে ভাসে, কেন এত মৃত্যু, দায় কার?

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এক রাতের বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত কলকাতা। একের পর এক মৃত্যু। জলবন্দি শহরের বিভিন্ন এলাকা। অতিবৃষ্টিই কি একমাত্র কারণ বিপর্যয়ের?

কলকাতায় জলের মধ্যে দিয়ে আসছে একটি গাড়ি।
কলকাতার এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কে?ছবি: Subrata Goswami/DW

ফিরে এলো 'ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর'। কলকাতা আবার ডুবে গেল বৃষ্টির জলে। একের পর এক প্রাণহানি শুধু নয়, স্তব্ধ হয়ে গেল জনজীবন। 

সোমবার রাত এগারোটা নাগাদ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল কলকাতা ও আশপাশের এলাকায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি বাড়তে থাকে।

অতীতেও সেপ্টেম্বর মাসে, বর্ষার পরে ঠিক শরতের শুরুতে এমন বৃষ্টি-প্রলয়ের সাক্ষী থেকেছে কলকাতা। ১৯৭৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ৩৬৯.৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২৫৯.৫ মিলিমিটার। এরপরেই থাকবে সোমবারের বৃষ্টি। ২৫২.৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে কয়েক ঘণ্টায়। সব শেষ এমন ভারী বৃষ্টি কলকাতা দেখেছিল ২০০৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। সেদিন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২১১.৬ মিলিমিটার।

যে কলকাতাকে ভৌগোলিকভাবে একটি কড়াইয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তার পক্ষে এই বিপুল পরিমাণ জল ধারণ করা সম্ভব ছিল না। এর ফলে মঙ্গলবার সকালে কলকাতা হয়ে ওঠে ভেনিস। মানুষের দুর্ভোগ-দুর্গতির ছবি সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠে যায়, এর দায় কার? শুধুই কি প্রকৃতির বিপর্যয়, না মানুষের হাত আছে?

জল নিয়ে তরজা 

কলকাতায় জল জমার ফলে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নয়জন মারা গেছেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। এজন্য বিদ্যুৎ সরবরাহকারী বেসরকারি সংস্থা ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন (সিইএসসি)-এর দিকে আঙুল তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তিনি বলেন, "সিইএসসি-কে অনেকবার বলেছি, খোলা তার ঠিক করতে। যারা মারা গিয়েছেন, তাদের পরিবারকে সাহায্য করতে হবে সিইএসসি-কে। তাদের চাকরি দিতে হবে।" 

সিইএসসি দুঃখপ্রকাশ করে বলেছে, যে ক'জন মারা গিয়েছেন, তাদের মধ্যে পাঁচটি ঘটনা বাড়ির লাইনে ত্রুটির কারণে হয়েছে। একটি মৃত্যু সিগন্যাল বক্স থেকে ও দুটি স্ট্রিট লাইট থেকে হয়েছে।

কলকাতায় জল জমার পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "এত বৃষ্টি কখনো দেখিনি। ফরাক্কায় ঠিকভাবে ড্রেজিং হয় না বলে বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা জলে চারপাশ ভরে যাচ্ছে।" 

কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন, "এর আগে কলকাতায় ১৮০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এদিন বৃষ্টি হয়েছে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি। উত্তর ভারতে যেমন মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়, এটা তেমনি। জল পাম্প করে বার করতে গেলে ব্যাক ফ্লো করে যাচ্ছে। বহু জায়গায় জল সরাতে সময় লাগছে।"

রাজ্য সরকারকে দায়ী করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন,  "আবহাওয়া দপ্তর আগাম সর্তকতা দেওয়া সত্ত্বেও পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারেনি রাজ্য। যারা জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন, তাদের মৃত্যুর দায় সরকারকেই নিতে হবে। ফরাক্কার ড্রেজিংয়ের সঙ্গে কলকাতায় জল জমার সম্পর্ক নেই।"

হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়

শুধু অতিবৃষ্টি নয়, এর সঙ্গে নিকাশির সমস্যা, জলাশয়ের সংখ্যা হ্রাস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ত্রুটির কথা উঠে আসছে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে। 

কলকাতার জলাশয় নিয়ে গবেষণা করেছেন মোহিত রায়। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "কলকাতায় অপরিকল্পিতভাবে জলাশয় বোজানো হচ্ছে বহু বছর ধরে। আইন হওয়ার পরে এই প্রবণতা বেশ কিছুটা কমেছে। কিন্তু পুরসভার প্রান্তিক এলাকায় এখনো জলাশয় বোজানো হচ্ছে। গুলশান কলোনি গড়ে উঠেছে জলাশয় বুজিয়ে। গুগল ম্যাপ দেখলেই বোঝা যায়, যে জায়গাগুলি ১০ বছর আগে জলাশয় ছিল, সেগুলি বুজিয়ে দেয়া হয়েছে।"

তিনি জানিয়েছেন, কলকাতায় জলাশয়ের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। তিন দশক আগে যেখানে সাড়ে আট হাজার জলাশয় ছিল, সেই সংখ্যা সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজারে নেমে এসেছে। 

জলাশয় সংরক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম বলে মত রবীন্দ্র সরোবরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কাজ করে চলা সোমেন্দ্রমোহন ঘোষ। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "১০৫ বছরের পুরনো এই সরোবর এলাকা ১১৯ একর জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে ৭৩ একর জলাশয়। দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজিংয়ের কথা বলা হলেও এখনও তা করা হয়নি। সোমবারের অতিবৃষ্টিতে লেক ক্লাব থেকে জল এসে সরোবর ভাসিয়ে দিয়েছে। এর ফলে এখানকার জল দূষিত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে বাস্তুতন্ত্রের।"

তার বক্তব্য, "এর সমাধানে গঙ্গা-সহ বিভিন্ন ক্যানেল ড্রেজিং করতে হবে। পলি তুলে ফেলতে হবে, যাতে এগুলির জলধারণ ক্ষমতা বাড়ে। জলাশয় বোজানো বন্ধ করতে হবে। নতুন করে জলাশয় তৈরি করতে হবে। কলকাতা পুরসভাকে দক্ষতার সঙ্গে লকগেট খোলা ও বন্ধ করতে হবে জোয়ারের সময় অনুযায়ী। এজন্য উন্নত সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে।"

নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "কলকাতা শহরের যে স্বাভাবিক জলাধার অর্থাৎ পূর্ব কলকাতা জলাভূমি, সেখানে নগরায়ন হয়েছে। গড়ে উঠেছে বিধান নগর ও নিউ টাউন। এর ফলে প্রাকৃতিকভাবে শহরের যে জলাধার ছিল সেটি কমে এসেছে।"

কেন জলাশয় হারিয়ে যাচ্ছে? কারণ তা বেআইনিভাবে বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে। সেখানে বাড়ি, আবাসন গড়ে উঠছে। রাজনীতিবিদ ও প্রমোটারচক্রের বেআইনি আঁতাত নিয়ে অভিযোগ উঠছে।

প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিকাঠামো

একদিকে পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাব, অন্যদিকে বেহাল নিকাশি শহরবাসীকে বিপদে ফেলেছে।

মোহিতের মতে, "কলকাতা শুধু নয়, বিদেশের কোনো শহরে এক দিনে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে জমা জল থেকে সমস্যা হতে পারে। তবে কলকাতা শহরে যেভাবে জনবসতি বেড়েছে, তার জন্য যে ধরনের পরিকল্পনা ও পরিকাঠামো নির্মাণ দরকার ছিল, সেটা করা হয়নি। জমা জল নদীপথে বার করা যেতে পারে। নদীর পশ্চিম দিকটা উঁচু, তাই পূর্বদিকে জলটাকে পাঠানোর দরকার। জলাশয় কমে যাওয়ার ফলে এই জল নিষ্কাশন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।"

বিপর্যয় মোকাবিলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তুহিন ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, 

"কোনো একটি কারণে এই বিপর্যয় হয়েছে এমনটা নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হঠাৎ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনি মানুষের বেহিসেবে কাজকর্মের ফলে বেড়েছে দুর্ভোগ।" 

তার মতে, "নিকাশি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমাদের বড়সড় গলদ আছে। যে কোনো উন্নত দেশে গেলে দেখা যাবে যে, নর্দমা বা  নিকাশি নালা অনেক বড় বড় হয়। তাতে হয়তো জলই দেখা যায় না। এত বড় নালা বানানো হয়েছে সবচেয়ে বেশি জল ধারণের কথা মাথায় রেখে। আর আমাদের দেশে যতটা কম জায়গা নিয়ে করা সম্ভব, সেভাবে নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এর ফলে বিপর্যয় যখন হয়, তখন মানুষ সমস্যায় পড়েন। অতি বৃষ্টির সঙ্গে পরিকল্পনার ঘাটতি মিলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে।" 

মাথাব্যথার কারণ প্লাস্টিক

যেটুকু নিকাশি পরিকাঠামো আছে, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কঠিন বর্জ্য বিশেষত প্লাস্টিক। 

প্লাস্টিক বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকায় সংকট বেড়েছে: কল্যাণ রুদ্র

This browser does not support the audio element.

কল্যাণের বক্তব্য, "প্লাস্টিক বর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকায় সংকট বেড়েছে।  আমাদের সচেতনতা কম বলে যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলে দেয়া হয়। কলকাতা শহরে দৈনিক যে চার হাজার ৫০০ টন বর্জ্য পাওয়া যায়, তার প্রায় ১০ শতাংশ প্লাস্টিক। ৪০০-৫০০ বছরেও এই প্লাস্টিকের বিনাশ হয় না। খুব সহজেই এগুলি নিকাশি নালার মুখ আটকে দেয়।"

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক সাধন ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, "অতিবৃষ্টির সময়ে বিপুল পরিমাণ জল জমছে। কোথাও কোথাও কোমর সমান জল জমেছে। এটা মেনে নেয়া যায় না। সলিড ওয়েস্ট ঠিকমতো ব্যবহার করা না গেলে এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। একই সঙ্গে নিকাশি নালা পরিষ্কার রাখতে হবে, যাতে তার মধ্যে দিয়ে জল প্রবাহিত হতে পারে। আমাদের বিভিন্ন হাইড্রেন্ট বর্জ্যে ভর্তি হয়ে আছে, ফলে সেখান দিয়ে জল যেতে পারে না। একইভাবে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে টালি নালার মধ্যে। এর ফলে সেখান দিয়েও জল নিষ্কাশনের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। পুরসভা ও সরকারের উচিত টাস্ক ফোর্সের মাধ্যমে নিয়মিত নজরদারি চালানো, যাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক মতো হয়।"

নিকাশি যেখানে পর্যাপ্ত নয়, সেখানে খুব অল্প সময়ে অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত হলে সংকট তৈরি হয়। 

কল্যাণ রুদ্র বলেন, "কলকাতার যে নিকাশি ব্যবস্থা, তা ২৪ ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টির জল নিষ্কাশন করতে পারে। সেখানে এক রাতে পাঁচ ঘণ্টায় কোনো কোনো জায়গায় ৩০০ বা ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। একইসঙ্গে কলকাতার প্রান্তিক দুটি নদীতে বর্ষার সময়ে জোয়ারের মাত্রা বেশি থাকে। এত জল জায়গা করে দেয়ার জন্য যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা, সেটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে কলকাতায় বিপর্যয় হচ্ছে।"

নিকাশির উন্নতিকেই ভবিষ্যৎ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ বলে মনে করছেন তিনি। বলেন, "অতিবৃষ্টিতে এই বানভাসি হওয়ার পরিস্থিতি থেকে পুরোপুরি নিস্তার পাওয়া সম্ভব নয়। তবে নিকাশি ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। প্রতি সেপ্টেম্বরে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এই সময়ে মাটির আর জলধারণ করার ক্ষমতা থাকে না। ভূগর্ভস্থ জলধার সম্পূর্ণ ভরে থাকে। সব নদী জলে ভর্তি। এখন যা বৃষ্টি হবে, সেই জল বার করতে হলে নিকাশি ব্যবস্থা উন্নত করতেই হবে। যাতে নর্দমা আটকে না যায় দেখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনকে আমরা স্থানীয়ভাবে রুখতে পারব না, বরং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে পারি।'' 

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ