এমনিতে ফ্রান্সের মানুষ গর্ভপাতের পক্ষে। তা সত্ত্বেও পার্লামেন্ট সদস্যরাও তাকে সাংবিধানিক অধিকারের রূপ দিলেন।
বিজ্ঞাপন
সংবিধান সংশোধন করার জন্য একটি বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। সেখানেই গর্ভপাতের অধিকারকে সাংবিধানসম্মত করা হলো। ফ্রান্সই বিশ্বের প্রথম দেশ যারা গর্ভপাতকে সাংবিধানিক অধিকারের স্বীকৃতি দিলো।
২০২২ সালের নভেম্বরে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তখন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। গত বুধবার সেনেট এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
গর্ভপাতের অধিকারের বিষয়টি ফ্রান্সে আগেই জনপ্রিয় ছিল। এমনকী দক্ষিণপন্থি রাজনীতিকরাও এর বিরোধিতা করেননি। তারাও গর্ভপাতকে সংবিধানসম্মত অধিকার করার প্রস্তাব সমর্থন করেছেন।
প্রায় পাঁচশ জন সাংসদ ভোটাভুটিতে অংশ নেন। তার মধ্যে ৩০ জন রক্ষণশীল ও নির্দল প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ফ্রান্সের জনমতও এর পক্ষে ছিল। ২০২২ সালে ফরাসি সংস্থা আইএফওপি যে সমীক্ষা করেছিল, তাতে ৮৬ শতাংশ মানুষ গর্ভপাতকে সাংবিধানিক অধিকার করার পক্ষে রায় দেন।
জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো গর্ভপাত-বিরোধী বিক্ষোভ
যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাত ক্লিনিকের সামনে গর্ভপাত-বিরোধী বিক্ষোভ সাধারণ ঘটনা৷ জার্মানিতেও এমন বিক্ষোভ হয়ে থাকে৷ তবে এটি নিষিদ্ধ করতে চান জার্মান পরিবারমন্ত্রী৷
ছবি: Helen Whittle/DW
বিক্ষোভ
সম্প্রতি ‘ইউরোপ্রোলাইফ’ সংগঠনের কয়েকজন বিক্ষোভকারী জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ‘প্রো ফ্যামিলিয়া’র কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন৷ তাদের কারো কারো হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে ছিল হাসিখুশি বাচ্চার ছবি৷ কারো প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘আনবর্ন লাইভস ম্যাটার’ বা ‘গর্ভপাত সমাধান নয়’ ইত্যাদি৷
ছবি: Helen Whittle/DW
বিক্ষোভের প্রভাব
ক্লাউডিয়া হোমান নয় বছর ধরে ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রো ফ্যামিলিয়া অফিসে কাজ করেন৷ ২০১৭ সালে তিনি প্রথম এমন বিক্ষোভ দেখেছিলেন৷ হোমান বলেন, অফিসের সামনে এমন বিক্ষোভ, যারা পরামর্শের জন্য তাদের অফিসে যেতে চান, তাদের উপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলে৷ এছাড়া অনেকে পরামর্শ নিতে যেতে ভয়ও পান বলে জানান তিনি৷
ছবি: Helen Whittle/DW
গণমাধ্যমে তেমন প্রচার নেই
যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন গর্ভপাত কার্যালয়ের সামনে এমন বিক্ষোভ সাধারণ ঘটনা৷ জার্মানি ও ইউরোপেও এমন বিক্ষোভ হয়৷ তবে গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর বেশি প্রকাশিত হয় না৷
ছবি: Sachelle Babbar/ZUMA/picture alliance
রোল মডেল যুক্তরাষ্ট্র
বার্লিনের সাংবাদিক উলি ইয়েনশ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এ ধরনের বিক্ষোভ সম্পর্কে খবর রাখছেন৷ তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের গর্ভপাতবিরোধী আন্দোলন জার্মানি ও ইউরোপে রোল মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের আন্দোলনের কৌশল অনুসরণ করা ছাড়াও সে দেশের কর্মীদের সঙ্গে ইউরোপের বিক্ষোভকারীরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন বলে জানান ইয়েনশ৷
ছবি: Evelyn Hockstein/REUTERS
আইন প্রণয়নের উদ্যোগ
গর্ভপাতবিরোধী বিক্ষোভকারীরা যেন গর্ভপাত ক্লিনিকগুলোর সামনে জ হতে না পারেন সে কারণে আইন করার অঙ্গীকার করেছেন জার্মানির পরিবারমন্ত্রী লিজা পাউস৷ তিনি বলেন, ‘‘নারীদের অবশ্যই কাউন্সেলিং পরিষেবা এবং গর্ভপাত করায় এমন ক্লিনিকে বাধাহীনভাবে যাওয়ার সুযোগ থাকতে হবে৷’’
ছবি: Carsten Koall/dpa/picture alliance
জার্মানিতে গর্ভপাত অবৈধ, তবে...
জার্মানির ক্রিমিনাল কোডের ২১৮ ধারা অনুযায়ী গর্ভপাত অবৈধ৷ তবে গর্ভধারণের পর সর্বোচ্চ ১২ সপ্তাহের মধ্যে যদি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় তাহলে সার্টিফিকেট পাওয়ার তিনদিনের মধ্যে গর্ভপাত করানা সম্ভব৷
ছবি: Sachelle Babbar/ZUMA/picture alliance
পরিসংখ্যান
জার্মানির পরিসংখ্যান কার্যালয়ের হিসেবে, দেশটিতে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ গর্ভপাত করানো হয়৷ ১৯৯৬ সালে সংখ্যাটি ছিল প্রায় এক লাখ ৩১ হাজার৷ জার্মানির কিছু অঞ্চলে গর্ভপাতের জন্য ক্লিনিক পাওয়া কঠিন৷ কিছু শহরে একটিও নেই৷ ২০০৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে জার্মানিতে গর্ভপাত ক্লিনিকের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে৷
ছবি: Sean Gallup/Getty Images
‘শিশু হত্যাকারী’
নেদারল্যান্ডসের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ গাবি রাফেন বলছেন, জার্মানি থেকে অনেকে তার ক্লিনিকে গর্ভপাত করাতে যাচ্ছেন৷ সে কারণে গত নভেম্বরে তিনি ডর্টমুন্ডে একটি ক্লিনিক খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ এর পরপরই তিনি গর্ভপাত বিরোধীদের লক্ষ্যে পরিণত হন৷ তাকে ‘শিশু হত্যাকারী’ বলা হয়েছে এবং তার ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর বিভিন্ন গর্ভপাত-বিরোধী ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে৷
ছবি: Helen Whittle/DW
8 ছবি1 | 8
অতি-দক্ষিণপন্থি ন্যাশনাল রেলি পার্টি সাধারণত গর্ভপাতকে সমর্থন করে। তবে এই দলের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়েছে। তাদের ৮৬ জন পার্লামেন্ট সদস্যের মধ্যে ৪৬ জন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এর মধ্য়ে লে পেনও আছেন। ১২ জন বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। বাকিরা ভোটদানে অংশ নেননি।
ইতিহাস আছে
২০২২ সালের আগে এই অধিকারকে সংবিধানসম্মত করার কথা ভাবা হয়নি। কারণ, তখনো মেয়েদের গর্ভপাতের অধিকার ছিল এবং তারা তা করতে পারতেন।
১৯৭৫ সালে আইন পাস করে ফ্রান্সে গর্ভপাতের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। গর্ভধারণের ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত করার অধিকার সেই আইনে দেয়া হয়েছিল। পরে ২০০১ সালে তা বাড়িয়ে ১২ সপ্তাহ করা হয়। ২০২২ সালে তা ১৪ সপ্তাহ করা হয়। ১৯৮০ সাল থেকে ফ্রান্সের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পে গর্ভপাতের বিষয়টি ঢোকানো হয়েছে।
ফ্রান্সের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের তুলনা
গর্ভপাতের পক্ষে থাকা মানুষরা ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, এটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।
২০২২ সালের ২৪ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট জাতীয় স্তরে গর্ভপাতের অধিকার বাতিল করে দেয়। তারপরই ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁ গর্ভপাতকে সংবিধানস্বীকৃত করার প্রয়াস শুরু করেন।
১৯৭৩ সালে এক মামলার রায়ে যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা পেয়েছিলেন গর্ভপাতের অধিকার৷ সেই অধিকার এখন আইনত নিষিদ্ধ৷ গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে চলছে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ...
ছবি: Evelyn Hockstein/REUTERS
৪৯ বছর পর…
১৯৭৩ সালের রো বনাম ওয়েড মামলা এতদিন যুক্তরাষ্ট্রে নারী অধিকার ইতিহাসের মাইলফলক মামলার মর্যাদা পেয়েছে৷সম্প্রতি ডবস বনাম নারীদের স্বাস্থ্য সংস্থার গর্ভপাত বিষয়ক এক মামলায় ৪৯ বছর আগে দেয়া গর্ভপাতের অধিকার আইনত নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট৷ সর্বোচ্চ আদালতের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চলছে বিক্ষোভ৷ ওপরের ছবিতে নিউইয়র্কের বিক্ষোভ মিছিল৷
ছবি: CAITLIN OCHS/REUTERS
নারীরা ভীত
সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানানো এক নারীর হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘‘ (এই রায়ে) আমাদের সবারই ভয় পাওয়া উচিত৷’’ বিক্ষোভকারীরা মনে করেন, গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নিলে অনেক নারীর জীবন সংকটে পড়বে৷
ছবি: Caitlin Ochs/REUTERS
এ রায় গর্ভধারণ বাধ্যতামূলক করার নামান্তর...
অনেকেই মনে করছেন গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেয়া মানে অনেক নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভধারণে বাধ্য করা৷ তাই ছবির প্ল্যাকার্ডে ‘‘কোনো বাধ্যতামূলক গর্ভধারণ নয়’’ লিখে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাচ্ছেন এক নারী৷ ওহাইয়োর কলম্বাস শহরের ছবি৷
ছবি: Megan Jelinger/REUTERS
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও গর্ভপাত
এক নারীর (মাঝখানে) হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘‘অ্যাবরশন ইজ হেল্থকেয়ার৷’’ তার মতো অনেকেই মনে করেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর সুস্থ জীবনের স্বার্থেই গর্ভপাতের অধিকার থাকা প্রয়োজন৷ ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামির ছবি৷
ছবি: Marco Bello/REUTERS
‘শরীর আমার, সিদ্ধান্তও আমার...’
মায়ামির বিক্ষোভ সমাবেশের ছবি৷এক বিক্ষোভকারীর হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘‘নট ইয়োর বডি, নট ইওর লাইফ, নট ইয়োর চয়েস৷’’ এর মাধ্যমে আদালতকে তিনি বলতে চাইছেন, শরীর যেহেতু নারীর, জীবন নারীর, তাই গর্ভপাত করাবেন কি করাবেন না তা ঠিক করার অধিকারও নারীরই থাকা উচিত৷
ছবি: Marco Bello/REUTERS
‘শরীর থেকে দূরে রাখুন’
নিউিয়র্কের রাস্তায় এক নারী আদালতকে বলছেন, ‘‘আইনগুলো আমার শরীর থেকে দূরে রাখো৷’’
ছবি: Brendan McDermid/REUTERS
নারীদের বাঁচান!
ওয়াশিংটনের এক বিক্ষোভকারী প্ল্যাকার্ডে লিখেছেন, ‘‘নারীরা মারা যাবেন৷’’ অর্থাৎ, তিনি মনে করেন গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেয়ার কারণে অনেক নারীর অকালমৃত্যু হবে৷ তাই নারীদের জীবন রক্ষার স্বার্থেই গর্ভপাতের অধিকারের দাবি জানাচ্ছেন তিনি৷
ছবি: Evelyn Hockstein/REUTERS
নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নাও!
ম্যাসাচুসেটসের এক বিক্ষোভকারীর হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘‘ আমাদের শরীর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নাও!’’
ছবি: Brian Snyder/REUTERS
পুরুষদের হুমকি...
নিউইয়র্কের এই নারী জানাচ্ছেন, রো বনাম ওয়েড মামলার রায়ে দেয়া গর্ভপাতের অধিকার ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি পুরুষদের সঙ্গে যৌনমিলনে বিরত থাকবেন৷
ছবি: Brendan McDermid/REUTERS
9 ছবি1 | 9
সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের পর অ্যামেরিকায় অনেক রাজ্যই গর্ভপাতকে বেআইনি বলে ঘোষণা করে।
ইউরোপে গর্ভপাতের আইনকে আরো উদার করার একটা প্রবণতা আছে। নেদারল্য়ান্ডসে গর্ভধারণের ২৪ সপ্তাহ, সুইডেনে ১৮ সপ্তাহ, লুক্সেমবুর্গে ১৪ সপ্তাহ, আয়ারল্যান্ড ও ডেনমার্কে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত করা যায়।
ইইউ-র অনেক সদস্য রাষ্ট্রে দক্ষিণপন্থিরা গর্ভপাতের অধিকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। তার প্রভাবে গর্ভপাতের অধিকারও কাটছাঁট করা হয়েছে।
মাল্টায় মায়ের শরীরে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পোল্যান্ডেও নানান কড়াকড়ি করা হয়েছে। হাঙ্গেরিতে আইন আরো কড়া করা হয়েছে। ইটালির দক্ষিণপন্থি প্রধানমন্ত্রী মেলোনি গর্ভপাতের বিরোধিতা করলেও বলেছেন, তিনি আইন পরিবর্তন করবেন না।
২০২৩ সালে ইইউ-তে জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭১ শতাংশ মানুষ। গর্ভপাতের সমর্থক, ২১ শতাংশ বিরোধিতা করছেন।
এই পরিস্থিতিতে ফ্রান্স গর্ভপাতের অধিকারকে সংবিধানসম্মত করার পক্ষে রায় দিলো।