কেন দেশ ছাড়ছেন ভারতীয়রা
১৯ ডিসেম্বর ২০২৫
২০২০ সালের পর থেকে নয় লক্ষেরও বেশি ভারতীয় নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। এই তথ্য চলতি শীতকালীন অধিবেশনে সংসদে পেশ করা হয়েছে।
কী জানিয়েছে কেন্দ্র
লোকসভায় প্রশ্নের উত্তরে বিদেশ মন্ত্রক লিখিত জবাবে জানিয়েছে, ২০১১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ২০.৬ লক্ষের বেশি ভারতীয় নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। এই ১৩-১৪ বছরে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক মানুষ গত পাঁচ বছরে, কোভিড মহামারির সময়ে ও তার পরবর্তী পর্যায়ে দেশ ছেড়েছেন।
এই সময়সীমার মধ্যে প্রায় এক দশক ধরে প্রতি বছর নাগরিকত্ব ত্যাগের সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। এই সংখ্যা বছরে গড়ে ১.২ লক্ষ থেকে ১.৪৫ লক্ষের মধ্যে ঘোরাফেরা করত। কিন্তু ২০২২ সালের পর থেকে এটা বেড়ে বছরে দুই লক্ষের বেশি হয়ে যায়।
সংসদে পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, নাগরিকত্ব ত্যাগের কারণ ব্যক্তিগত। সেই কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই জানেন। মন্ত্রকের বক্তব্য, অনেকেই ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য বিদেশি নাগরিকত্ব বেছে নিচ্ছেন।
বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, জ্ঞান ও মেধা দ্বারা চালিত অর্থনীতির যুগে বিশ্বজুড়ে কর্মক্ষেত্রের যে প্রসার ঘটেছে, তাকে ভারত স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৭০-এর দশক থেকে ভারত ক্রমাগত ব্রেন ড্রেনের মুখে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা বেড়েছে। ২০২০-র দশকে তা চরমে পৌঁছেছে। কিন্তু শুধু মেধা দেশান্তরিত হচ্ছে, এমন নয়, ধনীরাও ভারত ছাড়ছেন।
কারা দেশ ছাড়ছেন
অতীতে ভারত ছেড়েছিলেন মূলত দুই ধরনের মানুষ। একদল ছিলেন ব্রিটিশ আমলে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক। অন্য দল ছিলেন ১৯৭০-এর দশক থেকে বিদেশে পাড়ি দেওয়া ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য দক্ষ পেশাজীবী।
কিন্তু এখন দেশ ছাড়ছেন মূলত ধনী ভারতীয়রা। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা ও পিএমও-র মুখপাত্র সঞ্জয় বারু তার বইয়ে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন।
তিনি ভারতীয়দের বিদেশ যাত্রার একাধিক পর্যায়ের কথা বলেছেন। তার মতে, এখন দেশান্তরের চতুর্থ ধাপ চলছে।
এই পর্যায়ে দেশ ছাড়ছেনধনীদের সন্তানরা, উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তিরা। রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান অভিজাতরাও এর অংশ। বারুর মতে, এই চতুর্থ ঢেউ সফল বিত্তশালী মানুষকে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে।
ফ্যাক্টর দ্বৈত নাগরিকত্ব
অনেক ভারতীয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন বা কানাডার নাগরিকত্ব নিতে চান, তার পিছনে বড় কারণ হল ভারতে দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতি নেই।
ভারতীয় আইন অনুযায়ী, কোনও ভারতীয় নাগরিক স্বেচ্ছায় অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিলে, তার ভারতীয় নাগরিকত্ব নিজে থেকেই বাতিল হয়ে যায়। তার জায়গায় ওভারসিস সিটিজেনশিপ অফ ইন্ডিয়া বা দীর্ঘ মেয়াদী ভারতীয় ভিসা পান তারা। বহু ভারতীয় অনেক বছর ধরে বিদেশে বসবাস ও কাজ করছেন। তাদের ক্ষেত্রে পূর্ণ নাগরিক অধিকার ও পেশাগত সুযোগ পেতে বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে।
লিঙ্কডইন থেকে রেডিট পর্যন্ত বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রবাসী ভারতীয়দের অসংখ্য পোস্ট দেখা যায়। সেখানে অনেকেই লিখেছেন, ভারতীয় পাসপোর্ট ত্যাগ করা কতটা বেদনার। এই নথি যা তাদের ভারতীয় পরিচয়ের প্রতীক, সেটি ত্যাগ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় অনেকের কাছে।
অতিমারিতে হার কম
কোভিড-পরবর্তী সময়ে পাসপোর্ট ত্যাগের হার বেড়েছে। এই হঠাৎ বৃদ্ধি কেন? ২০২০ সালে মহামারি শুরু হলে দূতাবাস বন্ধ ছিল। যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশের ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে।
এর ফলে নাগরিকত্ব ত্যাগের সংখ্যা হঠাৎ কমে যায়। গড়ে যেখানে বছরে ১.৩ লক্ষ মানুষ নাগরিকত্ব ছাড়তেন, সেখানে সংখ্যা নেমে আসে প্রায় ৮৫ হাজারে। এটি ছিল এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
পরবর্তী সময়ে সীমান্ত খুলে যায়। প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়। ২০২০ সাল থেকে জমে থাকা আবেদনগুলি একসঙ্গে নিষ্পত্তি হয়। এর ফলেই ২০২২ সালে নাগরিকত্ব ত্যাগের সংখ্যা হঠাৎ দুই লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।
কিন্তু বিষয়টি শুধু এককালীন বকেয়া আবেদনের নিষ্পত্তি হওয়ার জন্য ঘটেনি। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালেও নাগরিকত্ব ত্যাগের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কমেনি।
ব্রেন ড্রেনের সমস্যা
ভারত বহু দশক ধরে ব্রেন ড্রেনের সমস্যায় ভুগছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, বিজ্ঞানী সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের দক্ষ পেশাজীবীরা দেশ ছেড়েছেন। অনেকেই প্রথমে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যান। পরে সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, শিক্ষা ও দক্ষতা অনুযায়ী ভারতে কাঙ্খিত উচ্চমানের কর্মসংস্থান অনেক কম বলে তাদের মনে হয়।
মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতীয় অভিবাসীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা মার্কিন নাগরিক এবং অন্যান্য অভিবাসীদের তুলনায় অনেক বেশি। ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ২৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ভারতীয় অভিবাসীদের প্রায় ৮১ শতাংশেরই অন্তত স্নাতক ডিগ্রি ছিল। তুলনায়, সব বিদেশি অভিবাসীর মধ্যে এই হার ছিল প্রায় ৩৫ শতাংশ।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রবাসী ভারতীয়দের দাবি, বিদেশে সুযোগ অনেক বেশি। একই ধরনের কাজের জন্য বিদেশে বেতন অনেক বেশি। জীবনযাত্রার মানও উন্নত। তাদের মতে, নির্মল বাতাস, নিরাপত্তা, উন্নত গণপরিবহণ এবং নাগরিক পরিকাঠামো বিদেশে অনেক ভালো। বিদেশে জীবনযাপনের খরচ বেশি। কিন্তু সেই খরচ ধরেও সামগ্রিক আয় ও জীবনযাপনের মান ভারতের তুলনায় অনেক উন্নত।
রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অভিবাসীর উৎস হিসেবে ভারত বহু বছর ধরে শীর্ষে রয়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ভারতীয় প্রবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৭৫ লক্ষ।
চাকা ঘুরবে কি
কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি অনুযায়ী, ভারতের অর্থনীতি দ্রুত গতিতে বাড়ছে। অমৃতকালের ঘোষণা করা হয়েছে। বিকশিত ভারতের স্লোগান দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এসব কিছুই কেন ভারতীয় মেধা ও বিত্তকে দেশে ধরে রাখতে পারছে না?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "ভারতের উন্নতি হচ্ছে এটা সত্যি কথা। কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলি দীর্ঘদিন ধরে মানুষের কাছে একটি স্বপ্নের জায়গা হয়ে আছে। সেখানে শুধু আর্থিক সুবিধা নয়, বরং জীবনযাত্রার মান অনেকটাই উন্নত। সম্পূর্ণ নিজের মতো জীবন যারা কাটাতে চান এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক স্বচ্ছলতাও যেখানে অর্জন করা সম্ভব, সেই দেশের আকর্ষণ রয়েছে। আমাদের দেশে কেউ খুব বড় চাকরি বা ব্যবসা করলেও তাকে সেই একই রাস্তাঘাট বা নাগরিক পরিষেবাজনিত সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অনেকে এখন মনে করেন যে, কেন তারা এসবের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে থাকবেন যদি অন্য উপায় থাকে?"
কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ শুভনীল চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেন, "ভারতের অর্থব্যবস্থা নিয়ে যে রঙিন ছবি তুলে ধরা হচ্ছে, সেটা সঠিক নয়। বিপুল অসাম্য আছে। যারা ধনী বা স্বচ্ছল-সম্ভ্রান্ত, তারা যে লাইফস্টাইল চান, সেটা আমাদের দেশে এখনো অবধি গুটিকয় মানুষ বাদ দিয়ে বাকিদের কাছে নেই। তারা আরও ভালোর প্রত্যাশায়, আরও ধন আহরণের আশায় দেশের বাইরে যাচ্ছে।"
তিনি বলেন, "কর্মসংস্থান না থাকার থেকেও বড় কথা ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড লাইফ। আমাদের দেশের জীবনযাত্রার যে মান, সেটা উন্নত দেশের তুলনায় পিছিয়ে। আমেরিকার একজন ধনীর আর আমাদের একজন ধনীর যা জীবনযাত্রার মান, তার মধ্যে ফারাক আছে। আমাদের স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা, পথঘাট কী অবস্থায় রয়েছে? ট্রেন টাইমে চলে না, প্লেন টাইমে চলে না, মেট্রো টাইমে চলে না। রাস্তাঘাটে জ্যাম, একটা হাইওয়েকে সম্প্রসারণ করতে চার, পাঁচ, ১০ বছর লাগে।"
দ্বৈত নাগরিকত্বের ফলে বিদেশ যাত্রার প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করেন রাজাগোপাল। বলেন, "এখন পৃথিবীর অনেক দেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের ব্যবস্থা আছে, অর্থাৎ আমেরিকান হয়েও কেউ ভারতীয় নাগরিক থাকতে পারেন। কিন্তু আমাদের সংবিধানে সেই সুযোগ নেই। আপনি অন্য দেশের নাগরিক হওয়া মাত্রই ভারতীয় নাগরিকত্ব হারাবেন। তবুও অনেকেই লুকিয়ে দুটো পাসপোর্ট রাখতেন, যা বিপজ্জনক। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে এই ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কমছে। তারা মনে করেন যে, ভারতীয় পাসপোর্টের তেমন কোনো উপযোগিতা নেই, ভোট দেওয়ার অধিকার ছাড়া। তাই তারা পাসপোর্ট সারেন্ডার করার পথ বেছে নিচ্ছেন। আগে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের মধ্যেও এমন প্রবণতা দেখা যেত। তারা মনে করত যে ভারতে একটা পাসপোর্ট থাকলে বিপদে কাজে আসবে। এখন ভারত সরকার যদি দ্বৈত নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা ভাবে, তবে হয়তো এই প্রবণতা কিছুটা ঠেকানো সম্ভব হবে।"
শুভনীলের বক্তব্য, "ব্রেন ড্রেন কথাটা তো অনেকদিন ধরেই শুনছি। এখন যেটা হচ্ছে, ধনীদের একটা অংশ সরাসরি বিদেশে গিয়ে সেটল করছে। গ্লোবালাইজেশনের দুনিয়ায় সেটা করাও সহজ হয়ে গিয়েছে। তারা ভাবছে যে, বিদেশে গেলে আরও বেশি সুখ উপভোগ করবে, জীবনযাত্রার মান বাড়বে। অমৃতকাল, বিকশিত ভারত এগুলো তো ভালো জিনিস, কিন্তু এসব কথার কথা হয়েই থেকে যাচ্ছে।"