1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কেন বারবার আত্মঘাতী আইআইটি পড়ুয়ারা

৬ মে ২০২৫

মেধাবী পড়ুয়াদের আত্মহত্যা ঘিরে বাড়ছে উদ্বেগ। গত শনিবার আইআইটির এক ছাত্র ফের আত্মঘাতী হয়েছেন। কিসের চাপে জীবন শেষ করে দিচ্ছেন এই উজ্জ্বল তরুণরা?

দিল্লির আইআইটি ক্যাম্পাস
আইআইটি দিল্লিছবি: Sonu Mehta/Hindustan Times/Sipa USA/picture alliance

দেশের সেরা মেধার ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চতর শিক্ষার জন্য বেছে নেন আইআইটিকে। পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুর আইআইটিতে গত পাঁচ মাসে তিনটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তাও আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই।

আইআইটিতে আত্মহত্যা

গত শনিবার গভীর রাতে নিজের ঘর থেকে উদ্ধার হয় মহম্মদ আসিফ কামারের দেহ। মৃত ছাত্র আইআইটি খড়গপুরের মদনমোহন মালব্য হলের এসডিএস ব্লকের ১৩৪ নম্বর ঘরে থাকতেন।

শনিবার রাত থেকেই আসিফের ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। সহপাঠীরা বারবার দরজা খোলার চেষ্টা করেও সফল হননি। তারা খবর দেন পুলিশে। ক্যাম্পাসে পুলিশ এসে রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আসিফের ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকে। তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। খড়গপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে আসিফকে চিকিৎসকেরা মৃত বলে জানান। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আসিফের বাড়ি বিহারের শিওহর জেলার গারাহিয়ার গ্রামে।

আসিফকে নিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে আইআইটিতে দুজন ছাত্র আত্মঘাতী হলেন। গত ২০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আত্মহত্যা করেন অনিকেত ওয়ালকার। তিনি ওশেন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড নাভাল আর্কিটেকচারের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। জগদীশচন্দ্র বসু হল থেকে তার দেহ উদ্ধার হয়।

গত তিন বছরে যারা আত্মহত্যা করেছেন, তারা সকলেই এই ক্যাম্পাসে তিন-চার বছর পড়াশোনা চালিয়েছেন। এ বছরের গোড়ায় আর এক ছাত্র আত্মহত্যা করেছিলেন। ১২ জানুয়ারি শাওন মালিকের দেহ উদ্ধার হয় আজাদ হল থেকে। তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ২০২৪ সালের ১৭ জুন বায়োটেকনোলজির তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া দেবিকা পিল্লাই আত্মঘাতী হন। তার দেহ মেলে সরোজিনী নাইডু হলে।

২০২৩-এর ১৯ অক্টোবর লালবাহাদুর শাস্ত্রী হলে কে কিরণচন্দ্রের দেহ মেলে। তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফাইজান আহমেদ আত্মঘাতী হন ২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর। তার দেহ উদ্ধার হয় লালা লাজপত রায় হল থেকে।

২০২১ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন সতীশ রেড্ডি ও সার্থক বিজয়ওয়াত নামে দুই পড়ুয়া। যদিও প্রতিষ্ঠানে নয়, এরা দুজনে আত্মঘাতী হন নিজেদের বাড়িতে।

প্রত্যাশার চাপে ছাত্ররা

গোটা দেশ থেকে উচ্চমেধার পড়ুয়ারা ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজির মতো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে যান খড়গপুর আইআইটিতে। অনেকেই পড়াশোনার পর্ব শেষ হওয়ার আগে দেশি-বিদেশি সংস্থায় চাকরির সুযোগ পান।

স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষার ফলাফলের উপরে অনেকটাই নির্ভর করে চাকরিপ্রাপ্তি। আইআইটি পরীক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ কিউমুলেটিভ গ্রেড পয়েন্ট। প্রতিটি সেমিস্টারে ১০ নম্বরের কম পেলে চূড়ান্ত ফল খারাপ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় পড়ুয়াদের মধ্যে। কোনো ছাত্র একটি সেমিস্টারে সামান্য খারাপ ফল করলে অনেকটা চাপে পড়ে যান। তাদের মনে আশঙ্কা দানা বাঁধে, ভালো প্যাকেজের চাকরি তারা পাবেন তো?

বড় বেতনের ভালো চাকরির হাতছানির পাশাপাশি অনেকের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কারণেও সংকট তৈরি হয়। এর মধ্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রণয়ঘটিত কারণ থাকে। তবে সার্বিকভাবে মানসিক চাপের পিছনে রয়েছে প্রতিযোগিতা। যে ছাত্র বা ছাত্রী মেধার জোরে আইআইটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, তিনি মোটা বেতনের লোভনীয় চাকরি পাবেনই, এমন একটা ধারণা তৈরি করা হয়। ক্রমশ এই প্রত্যাশায় চাপা পড়ে মানসিক রোগের শিকার হয়ে পড়েন পড়ুয়ারা।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক সুহৃতা সাহা ডিডাব্লিউকে বলেন, "উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, তেমনি প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এই বাজারে সবাইকে খুব ভালো করতে হবে, এরকম একটা চাপ পড়ুয়াদের উপরে ছোট থেকেই দেয়া হচ্ছে। এই প্রত্যাশার চাপ সামাজিক ও পারিবারিক। পড়ুয়ার নিজের আপন সত্তা এই চাপের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। প্রতিযোগিতামূলক শব্দটা অনেকসময় পড়ুয়াদের পার্সোনালিটির সঙ্গে খাপ খায় না। এটা আরো বেড়েছে, কারণ প্রতিযোগিতা বেড়েছে।"

উপস্থিতি নিয়ে কড়াকড়ি

আইআইটির মতো প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাসে হাজিরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে নিয়ম বেশ কড়া। কাউন্সেলিং-এর সময় এই বিষয়টি পড়ুয়াদের দিক থেকে উঠে আসে বলে আইআইটি সূত্রের খবর। পড়াশোনার চাপ, প্রতিযোগিতা ও তার সঙ্গে উপস্থিতির ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা ছাত্র-ছাত্রীদের আরও কোণঠাসা করে ফেলে। এর ফলে তারা ফুরসত পান না। বাড়তে থাকে মানসিক চাপ।

এই বিষয়টি নিয়ে সজাগ আইআইটি কর্তৃপক্ষ। খড়গপুরের ভারপ্রাপ্ত ডিরেক্টর অমিত পাত্র বলেন, "উপস্থিতির ক্ষেত্রে যে নীতি আমাদের রয়েছে, তা সংস্কার করার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা চলছে। তবে এটা করতে সময় লাগবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটিতে। এর ফলে পড়ুয়াদের উপর যে চাপ তৈরি হচ্ছে, সেটা কমানো আমাদের লক্ষ্য।"

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট বা চিকিৎসা মনোবিদ ডা. প্রশান্তকুমার রায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "১৫-৪০ বয়স আত্মহত্যাপ্রবণ। ভারতবর্ষের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই বয়সে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা হয়। আক্যাডেমিক চাপ, সুপারভাইজারদের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি পড়ুয়াদের মানসিক চাপ বাড়ায়। তাছাড়া ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে পড়াশুনো করতে হয় পড়ুয়াদের। এই পরিস্থিতিতে আইআইটির পরিবেশে মানিয়ে নিতে না পারলে তা খুবই পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। সব সময় অ্যাকাডেমিক কারণের জন্যই আত্মহত্যা হয় তা নয়, সম্পর্কের টানাপোড়েন তাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়।"

প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের একাংশ মনে করেন, উপস্থিতির নিয়ম যদি শিথিল করা হয়, তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাবেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য এটা জরুরি।

অনেকেই এ ধরনের চাপ থেকে মুক্ত হতে মোবাইলে ভার্চুয়াল দুনিয়াকে বেছে নেন। সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তাতে লাভের বদলে কি ক্ষতি বেশি হচ্ছে?

সুহৃতা বলেন, "বাস্তব ও রিল জগতের মধ্যে যে ভারসাম্য, সেটা পড়ুয়ারা করে উঠতে পারছে না। বাস্তবতা যখন তাদের আঘাত করছে, সেটা মেনে নেওয়ার মতো মানসিক গঠন তাদের নেই। এত বেশি ভার্চুয়াল জগতে ঘোরাঘুরি করে তারা অতি স্পর্শকাতর হয়ে উঠছে। নিজের সমস্যা বলার মতো কাউকে সে সামনে পায় না। তখন আত্মহত্যার মতো বেপরোয়া পদক্ষেপ নেয়।"

ভার্চুয়াল জগতের বদলে আশপাশে থাকা বন্ধুদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে মত প্রশান্তর। তিনি বলেন, "সহায়তা করতে পারে বন্ধুদের গ্রুপ। রুমমেট বা বন্ধুরা কারো ব্যবহারে পরিবর্তন দেখলে চিহ্নিত করতে পারেন। অনেক বড় সাপোর্ট সিস্টেম হিসেবে কাজ করতে পারেন তারা। হোস্টেলের বন্ধুদের এই সাপোর্ট সিস্টেমে কাজে লাগানো উচিত। ১৬-১৭ বছরের ছাত্রদের হোস্টেলে একলা থাকার চেয়ে একাধিক জনের সঙ্গে ঘর ভাগাভাগি করে থাকার মধ্যে সুবিধা আছে। আলাদা রুমে থাকলে একাকীত্ব আরো বেশি তৈরি হয়।"

বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন

প্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যা রুখতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে চলেছে খড়গপুর আইআইটি। দিল্লি আইআইটির ধাঁচে এই কমিটি তৈরি করা হবে। বিশেষজ্ঞদের প্যানেলে থাকবেন মনোসমীক্ষক, কাউন্সিলর, আইনি উপদেষ্টা, সাবেক শিক্ষক ও আইআইটি প্রাক্তনীরা। তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করবে বিশেষজ্ঞ কমিটি। তারা সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে দেবে। প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে কর্তৃপক্ষের কাছে।

বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ার আগেই আত্মহত্যা রুখতে আইআইটি কর্তৃপক্ষ একাধিক ব্যবস্থা নিয়েছেন। অতীতে প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে মাত্র একটি কাউন্সেলিং সেন্টার ছিল। এখন প্রতিটি হলে কাউন্সেলর বসেন পড়ুয়াদের সমস্যা শুনতে। কাউন্সেলর থেকে চিকিৎসক, সকলের নম্বর ছাত্রদের কাছে রয়েছে। ব্যক্তিগত স্তরের কোনো বিষয়ে আলাপচারিতার জন্য ফোনে কথা বলার অবকাশ আছে। এক্ষেত্রে অনলাইন কাউন্সেলিং করা হয়ে থাকে। নাম, পরিচয় কিছুই জানাতে হয় না।

প্রশান্ত বলেন, "আইআইটির প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বহু কাউন্সেলরদের সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝেছি, তারা এই আত্মহত্যাগুলোকে অনেকটাই রুখেছেন। তারা পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলে নিবিড়ভাবে বোঝার চেষ্টা করেন সংশ্লিষ্ট ছাত্রের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা কতটা রয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, যারা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন, পরে সেই রাস্তা থেকে সরে এসেছেন, এমন পড়ুয়ার সংখ্যা অনেক। কিন্তু এই তথ্যটা সামনে আসে না। পড়ুয়াদের আত্মহত্যার সংখ্যাটা অনেক বেড়ে যেত, যদি না কাউন্সেলররা এই কাজ নিরন্তর করে যেতেন। তবুও একটা-দুটো ঘটনা ঘটে যায়। কোনো ছাত্র বা ছাত্রী সাহায্য চাইলে তাকে সাহায্য করা হয়। কিন্তু কেউ সাহায্য না চাইলে কীভাবে সহায়তা করা যাবে?"

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ