১৯৬২ সালে হয়েছিল, ১৯৭১ সালেও হয়েছিল, আবার হতে চলেছে ২০২৫ সালের ৭ মে। কেন এই নিরাপত্তা মহড়া?
পহেলগাম নিয়ে উত্তেজনা যখন বাড়ছে, তখন ভারতে নিরাপত্তা মহড়া হবে। ছবি: picture-alliance/dpa/R. Gupta
বিজ্ঞাপন
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা যাদের স্মরণে আছে, তারা মনে করতে পারবেন কলকাতায় তখন সাইরেন বাজতো, ব্ল্যাক আউট হয়ে যেত। বাড়ির জানালার কাচে কাগজ লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। গাড়ির হেডলাইটের কাচ অর্ধেক কালো করে ঘুরতেন চালকেরা। সেসময় বলা হয়েছিল, সম্ভাব্য আক্রমণ হলে কী করতে হবে এবং কোন কোন জিনিস করা যাবে না।
ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে বহুবার উত্তেজনা প্রবল হয়েছে। তার কয়েকটি উদাহরণ হলো, উরি, পাঠানকোট, সংসদ ভবন আক্রমণ এবং কার্গিল। কিন্তু তখনো এই নিরাপত্তা মহড়ায় অংশ নিতে হয়নি সাধারণ মানুষকে। যা তাদের করতে হবে বুধবার।
কারামহড়াকরাবেন?
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গ্রাম থেকে মহানগর পর্যন্ত দেশের ২৪৪টি সিভিল ডিফেন্স জেলায় এই মহড়া হবে। জেলাশাসক, বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মীরা, হোমগার্ড, সিভিল ডিফেন্স ওয়ার্ডেন, স্বেচ্ছাসেবকরা ছাড়াও থাকবেন এনসিসি, এনএসএস, এনওয়াইকেএসের স্কুল ও কলেজ পড়ুয়ারা। তাছাড়া হটলাইনে বিমান বাহিনীর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হবে।
কীবলছেস্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়?
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোনো বিমান হামলা হলে কী করতে হবে তা মহড়ায় থাকবে। বিমান হামলার সাইরেন বাজলে কী প্রস্তুতি নিতে হবে তা মহড়ায় থাকবে। কন্ট্রোল রুম ও শ্যাডো কন্ট্রোল রুম কীরকম কাজ করছে তাও দেখা হবে।
বলা হয়েছে, ব্ল্যাক আউট হলে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটাও জানানো হবে।গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলির জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে সেটাও বলা হবে। কোনো হামলা হলে কীভাবে উদ্ধার করতে হবে, কীভাবে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটাও বলা হবে। দমকল এবং উদ্ধারকারীদের প্রস্তুতির বিষয়টিও দেখা হবে।
যে সব জায়গা নিরাপদ নয়, সেখান থেকে দ্রুত মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার মহড়াও হবে।
কেনএইমহড়া?
এরকম মহড়া ৫৪ বছর পর আবার হচ্ছে। এরকম মহড়া হচ্ছে, পহেলগাম-কাণ্ডের পর। এরকম মহড়া হচ্ছে, সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় এবং প্রতি রাতে গুলির লড়াই চলতে থাকায়। ভারত অভিযোগ করেছে, পাকিস্তানের সেনা প্রতিদিন কোনোরকম উসকানি ছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে গুলি চালাচ্ছে। তখন তাদের জবাব দিচ্ছে বিএসএফ।
কাশ্মীরে হামলার পর আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে বাড়তে থাকে উত্তেজনা৷ হামলার পর থেকে বিভিন্ন দেশের বাছাই করা প্রতিক্রিয়া নিয়ে এই ছবিঘর...
ছবি: Tauseef Mustafa/AFP/Getty Images
পহেলগামে হামলায় নিহত ২৬
২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামের একটি পর্যটনকেন্দ্রে হামলায় ২৬ জন নিহত হন৷ আকস্মিক এই হামলার এই ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠে৷ হামলার ঘটনার পর ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ নামের একটি জঙ্গি গোষ্ঠী এর দায় স্বীকার করে৷ ভারতের অভিযোগ, ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টের’ সাথে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার যোগ রয়েছে৷
ছবি: ANI
ভারতের অভিযোগের আঙ্গুল পাকিস্তানের দিকে
ভারত মনে করে, সীমান্তের ওপাড় থেকে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমকে মদত দিচ্ছে পাকিস্তান৷ এ অভিযোগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন চুক্তি বাতিলসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় তারা৷
ছবি: ANI
নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান পাকিস্তানের
হামলার ঘটনার পর দেশটির সেনেটে পাশ হওয়া এক রেজ্যুলেশনে সব ধরনের সন্ত্রাবাদী কার্যক্রমের নিন্দা জানায় পাকিস্তান৷ হামলার সাথে পাকিস্তানের যোগ রয়েছে- ভারতের এমন অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করে এই বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানায় দেশটি৷ ভারতের পদক্ষেপের জবাবে পাকিস্তানও বেশ কিছু পালটা পদক্ষেপ নেয়৷
ছবি: Pakistan's Prime Minister Office/AP Photo/picture alliance
জাতিসংঘের নিন্দা
হামলার পর এক বিবৃতিতে এর নিন্দা জানায় জাতিসংঘ৷ জাতিসংঘের মহাসচিবের পক্ষ থেকে তার মুখপাত্র বলেন, ‘‘জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস হাতহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছেন৷’’ কোনো পরিস্থিতিতেই সাধারণ মানুষের উপর হামলা গ্রহণযোগ্য নয়- জাতিসংঘের মহাসচিব তা মনে করেন বলেও তার মুখপাত্র জানান৷
কাশ্মীরে হামলার ঘটনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করে ঘটনার নিন্দা ও সমবেদনা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘আপনারা জানেন, ভারতের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক রয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক রয়েছে৷’’ তিনি বলেন, ''তারা কোনো না কোনোভাবে একটি পথ খুঁজে নেবে৷’’ দুই দেশের প্রতি সংযম প্রদর্শনের আহ্বানও জানায় হোয়াইট হাউস৷
ছবি: Jim Watson/AFP/Getty Images
হামলার নিন্দা চীনের, তদন্তের দাবিতে সমর্থন
হামলার ঘটনার পর এক বিবৃতিতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুয়া জিয়াকুন বলেন, ‘‘চীন সব ধরনের সন্ত্রসবাদের বিরোধী৷’’ পাকিস্তানের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবির প্রতিও সমর্থন জানিয়েছে চীন৷ দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইসাক দারের সাথে ফোন কলে বলেন, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার সুরক্ষায় চীনের সমর্থন রয়েছে৷ চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই কথা বলা হয়৷
ছবি: Kevin Frayer/Getty Images
জার্মানির তীব্র নিন্দা
হামলার ঘটনার পর জার্মানির বিদায়ী চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘আমরা পহেলগামে পযটকদের উপর বর্বর সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাই৷’’ বার্তায় শলৎস ভারতের জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেন৷
ছবি: Stephanie Lecocq/REUTERS
মধ্যস্ততার প্রস্তাব ইরানের
পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে ইরান৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে ফোন কলে হামলার নিন্দা জানান ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেসকিয়ান৷ এদিকে ভারত-পাকিস্তানের সাথে শতাব্দী প্রাচীন সভ্যতার যোগসূত্রের উল্লেখ করে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাগচি উত্তেজনা নিরসনে মধ্যস্ততার প্রস্তাব দেন৷
পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে তুরস্ক৷ প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়্যেপ এর্দোয়ান বলেন, ‘‘কাশ্মীর বিষয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা খারাপ পরিস্থিতির দিকে মোড় নেওয়ার আগেই তা দ্রুত প্রশমিত হওয়া উচিত৷’’ এদিকে ভারতের বেশ কিছু গণমাধ্যমে তুরস্ক থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো হয়েছে- এমন প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়ে তুরস্ক সরকার জানায়, জ্বালানির নিতে একটি কার্গো বিমান পাকিস্তানে অবতরণ করেছিল৷
ছবি: Emin Sansar/Anadolu Agency/picture alliance
হামলার নিন্দায় আরো যেসব দেশ
হামলার ঘটনার দিনে সৌদি আরব সফরে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ সফর সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত দেশে ফেরেন তিনি৷ অন্যান্য দেশের মধ্যে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইসরায়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশও পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানায়৷
ছবি: REUTERS
10 ছবি1 | 10
এই আবহে নিরাপত্তা মহড়া হচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত লেফটোন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''১৯৬২ সালে এটা আসামে হয়েছে। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় হয়েছে। সেসময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৩ দিনের যুদ্ধ হয়েছিল। তখন এই ড্রিলের গুরুত্ব বোঝা গেছিল। এটা হচ্ছে রেডি থাকা। খুব তাড়াতাড়ি সাধারণ মানুষ কী করবেন তা তাদের শিখিয়ে দেয়া হয়। এই মক ড্রিলে সব ধরনের বিষয় থাকে। সেখানে কখন লাইট অফ করতে হবে, জল ভরে রাখতে হবে, আগুন লাগলে কী করতে হবে থেকে শুরু করে কার কী কাজ হবে এ নিয়ে বিস্তারিতভাবে বলা হয়। সেজন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ।''
সাবেক আইপিএস অফিসার এবং মরিশাসের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শান্তনু মুখোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''মানসিক প্রস্তুতির জন্য দরকার হয়। সবাই বুঝতে পারেন, তাদের কতটা সতর্ক থাকতে হবে। এটা একটা প্রস্তুতি ও মানুষকে সচেতন রাখার জন্য করা হয়।''
উৎপল ভট্টাচার্যের মত হলো, ''ভারত একটা প্রত্যাঘাত তো করবে। কিন্তু কবে করবে, কখন করবে, কীভাবে করবে তারা ঠিক করবে। পাকিস্তান বিষয়টি নিয়ে ধন্ধে থাকবে।''
উৎপল ভট্টাচার্য মনে করেন, ''এর মধ্যে একটা সারপ্রাইজ এলিমেন্ট আছে। হয়ত দুই বছর আমরা কিছু করলাম না। কিন্তু যখন করলাম তখন তা কার্যকরী হবে এবং পাকিস্তান কিছুদিন এই ধরনের কাজ করা থেকে বিরত থাকবে।''
অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল কে পি ত্যাগী নিউজএক্সকে বলেছেন, ''জেনারেল কোছার বলে দিয়েছেন, ভয় পাওয়ার দরকার নেই। এটা যুদ্ধ নয়, এটা শুধুমাত্র যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে আমরা কী করব?''
শান্তনু মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ''এখন দুই দেশের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা আছে বলে এটা জরুরি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, যুদ্ধ শুরু হবে। এটা নিজেদের প্রস্তুত রাখা। মানুষকে সচেতন রাখা। এখন তো সরকারি ও বেসরকারি অফিসেও আগুন লাগলে কী করতে হবে তার মহড়া হয়। মহড়ার পুরো বিষয়টিই হলো, কিছু হলে তার মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকা। এর বেশি কিছু নয়।''