রোহিঙ্গারা বিশ্বের বুকে নিপীড়নের শিকার অন্যতম সম্প্রদায়৷ ঠুনকো কারণে তাদের নির্বিচারে হত্যা করে সেনারা৷ রোহিঙ্গা নারীরা হন ধর্ষণের শিকার৷ সভ্য দুনিয়ায় এই অসভ্যতা বিশ্বমিডিয়া সবাইকে দেখালেও কার্যত নিরব মিয়ানমার৷
বিজ্ঞাপন
হত্যা, ধর্ষণ আর নির্যাতন থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গাদের সামনে সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে সে দেশ থেকে পালানো৷ আর পালিয়ে বাঁচার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে তাদের বেশিরভাগই আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে৷ কেউ কেউ একটু দূরের পথ থাইল্যান্ড বা ইন্দোনেশিয়া অবধিও পৌঁছাতে পারে সমুদ্র পথে৷ সে পথে অবশ্য যেতে যেতেই সমুদ্র সলিল সমাধি ঘটে অনেকের৷
মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী হওয়ায় বাংলাদেশের উপর চাপটা একটু বেশি৷ বেসরকারি হিসেবে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে অবস্থান করছে৷ তাই স্বাভাবিকভাবেই অনেক বাংলাদেশি তাদের মনে করছেন বাড়তি বোঝা৷ পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে৷ কেউ কেউ বলছেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে৷
ভুলে যাওয়া শরণার্থীরা: বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা
গত অক্টোবরে মিয়ানমারে দমনপীড়ন শুরুর পর ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন৷ মুসলিমপ্রধান দেশটিতে বর্তমানে পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছেন৷ কুতুপালংয়ের মতো জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে তাদের অনেকের বাস৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
মিয়ানমার থেকে পালানো
মিয়ানমারে গত অক্টোবরে নয় পুলিশ হত্যার অভিযোগ ওঠে এক রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে৷ তারপর থেকে সেদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর আবারো দমনপীড়ন শুরু হয়৷ ফলে সত্তর হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷ তারা যেসব ক্যাম্পে বসবাস করেন সেগুলোর একটি এই কুতুপালং৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
স্বনির্ভরতা দরকার
কুতুপালং ক্যাম্পের শরণার্থীরা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে নিরাপদ আছে বটে, তবে জীবন সেখানে মোটেই সহজ নয়৷ সেখানে সত্যিকারের কোনো অবকাঠামো নেই, সবই শরণার্থীদের গড়া অস্থায়ী আবাস৷ তারা নিজেদের দেশ ছেড়ে এসেছেন, কেননা, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং অসংখ্য মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ করেছে৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
শিশুদের খেলা নয়
আশ্রয়শিবিরটির অধিকাংশ এলাকায় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই৷ কয়েক হাজার শরণার্থী শিশুর খেলোধুলারও কোন ব্যবস্থা নেই৷ ক্যাম্পের লেক থেকে মাটি সংগ্রহ করছে এই শিশুটি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
কুঁড়েঘরে বসবাস
কাদা মাটি এবং সহজলভ্য অন্যান্য উপাদান দিয়ে ঘর তৈরি করে বাস করেন শরণার্থীরা, যাতে মাথার উপরে অন্তত ছাদ থাকে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস
সেই ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সেদেশে রোহিঙ্গারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ তাদেরকে নাগরিকত্ব এবং ভোট দেয়ার অধিকার দিচ্ছে না সরকার৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
বাংলাদেশেও বৈষম্যের শিকার?
বাংলাদেশেও বৈষম্যে শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা৷ ক্যাম্পে আর জায়গা নেই- বলে বাংলাদেশে জলপথে আশ্রয় নিতে আসা অসংখ্য রোহিঙ্গাকে তাদের নৌকাসহ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে সীমান্তরক্ষীরা৷ পাশাপাশি কক্সবাজার ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একটি দুর্গম দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার৷ স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, দ্বীপটি বর্ষাকালে অধিকাংশ সময় পানির নীচে তলিয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
নির্জন দ্বীপে সরিয়ে নেয়া
ঠ্যাঙ্গার চর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর মোহনায় কয়েকবছর আগে জেগে ওঠা এক দ্বীপ৷ শুধুমাত্র নৌকায় করে সেখানে যাওয়া যায় এবং চরটিতে অতীতে একাধিকবার জলদস্যু হানা দিয়েছে৷ এক উন্নয়নকর্মী সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন যে দ্বীপটিতে কর্মসংস্থানেরও তেমন কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী স্বীকার করেছেন যে, ঠ্যাঙ্গার চরকে বসবাসের উপযোগী করতে আরো অনেক কাজ করতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘দ্বীপটিতে উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করার পর রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেয়া হবে৷’’ তবে সরকার অতীতে এরকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি৷ কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের তেমন কোন উন্নয়ন সাধন করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
ইতিহাস থেকে মোছার চেষ্টা
নিরাপদ আবাসভূমি না থাকায় রোহিঙ্গাদে ভবিষ্যত ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে৷ অন্যদিকে, মিয়ানমার তাদের অতীত মুছে ফেলতে কাজ করছে৷ দেশটির সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিহাস বিষয়ক পাঠ্যবই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে যেখানে রোহিঙ্গাদের কথা একেবারেই উল্লেখ থাকবে না৷ গত ডিসেম্বরে মন্ত্রণালয়টি দাবি করেছে, মিয়ানমারের ইতিহাসে কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে কখনো রোহিঙ্গা নামে আখ্যায়িত করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
9 ছবি1 | 9
এটা ঠিক, বিভিন্ন ছোট-বড় অপরাধের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে৷ গণমাধ্যমে তেমনটা দেখাও যায়৷ আর পাঁচ লাখ মানুষ যেখানে থাকবেন, সেখানে কোনো অপরাধ হবে না, এমনটা ভাবাও কঠিন৷ তবে আমার কাছে মনে হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যতটা অপরাধ করছেন, তারচেয়ে বেশি তা সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়ানো হচ্ছে৷ যেমন, ইয়াবা পাচারের পেছনে রোহিঙ্গাদের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে দাবি করেন কেউ কেউ৷ অথচ কক্সবাজারের স্থানীয় এক এমপি মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত৷ শুধু জড়িত নন, সেখান থেকে বাংলাদেশে যে মাদক প্রবেশ করে তার পুরোটাই বলতে গেলে তার দখলে৷ আর তিনি রোহিঙ্গা নন, বাংলাদেশি৷
আর রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে ইউরোপের কয়েকটি ঘটনা আমি জানি৷ একজন বাংলাদেশি হিসেবে ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া যতটা কঠিন, একজন রোহিঙ্গা হিসেবে ততটাই সহজ৷ কারণ, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমাজ সচেতন৷ ফলে কেউ যখন ইউরোপে প্রবেশের পর প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে তিনি রোহিঙ্গা, তাঁর জার্মানির মতো দেশেও আশ্রয় মেলে সহজে৷ আর এই সুযোগটা অনেক বাংলাদেশিও নেন৷ ফলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ইউরোপের এসে রোহিঙ্গা পরিচয় দেয়া বাংলাদেশির সংখ্যাও নেহাত কম নয়৷
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার পেছনে একটাই কারণ থাকতে পারে৷ সেটা হচ্ছে মানবিকতা৷ যে মানবিকতার কারণে ১৯৭১ সালে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশিকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিল, যে কারণে এক মিলিয়নের বেশি মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীকে জার্মানি আশ্রয় দিচ্ছে, একই কারণে বাংলাদেশেরও উচিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া৷
খেয়াল রাখতে হবে, এই আশ্রয় যেনে চিরস্থায়ী না হয়৷ বরং মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক সমাজের সহায়তায় বাংলাদেশের কঠোর চাপ প্রয়োগ করা উচিত৷ মিয়ানমারের অবশ্যই রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে হবে৷ মিয়ানমারের একজন সাধারণ নাগরিক যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, রোহিঙ্গাদের জন্যও তা নিশ্চিত করতে বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশটিকে রাজি হতে হবে৷ আর সেটা নিশ্চিত করা গেলে, রোহিঙ্গারা যে স্বেচ্ছায় নিজের দেশে ফিরে যাবে তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই৷