কেবল তাবলিগ নয়, দায় সকলের
১০ এপ্রিল ২০২০শেষ মুহূর্তে বড় সড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করল কর্ণাটক হাইকোর্ট। আদালতের নির্দেশে বেঙ্গালুরুতে কারাগা উৎসব বাতিল করতে বাধ্য হল বি এস ইয়েদুরাপ্পার নেতৃত্বাধীন রাজ্যের বিজেপি সরকার। গত ৮ এপ্রিল রাজ্যের ধর্মরায়াস্বামী মন্দিরে শতাব্দীপ্রাচীন এই উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ইয়েদুরাপ্পা সরকারও তার অনুমতি দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আদালত হস্তক্ষেপ করায় এ বছরের মতো স্থগিত থাকল উৎসব।
কর্ণাটকের এই ঘটনা নতুন করে পুরনো একটি বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে। এখনও ধর্মকী ভাবে যুক্তিবোধকে প্রভাবিত করে এটি তার অন্যতম নিদর্শন। মাত্র কিছু দিন আগেই দিল্লিতে তাবলিগ-ই-জামাতের অনুষ্ঠান থেকে গোটা দেশ জুড়ে হু হু করে ছড়িয়ে পড়েছিল করোনার সংক্রমণ। সরকার এবং প্রশাসন যে তা থেকেও শিক্ষা নেয়নি, কর্ণাটক তার প্রমাণ।
এমনিতে ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই মন্দির, মসজিদ, গির্জায় আপাতত কোনও রকম সমাবেশ হচ্ছে না। অধিকাংশই সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ। কর্ণাটকও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু কারাগা উৎসব নিয়ে গোলমাল শুরু হয়। ইয়েদুরাপ্পার ঘনিষ্ঠ কর্ণাটকের এক বিধায়ক মুখ্যমন্ত্রীর কাছে উৎসব পালন করার দাবি জানান। কেন? তাঁর যুক্তি, উৎসব না হলে ঈশ্বর রুষ্ট হবেন এবং মানুষের অমঙ্গল করবেন। এর পরেই ইয়েদুরাপ্পা জানিয়েছিলেন, উৎসব হবে। তবে মন্দিরে চার পাঁচজনের বেশি এক সঙ্গে ঢুকতে পারবেন না। হাইকোর্ট তার রায়ে জানিয়েছে, এই পরিস্থিতিতে যে কোনও উৎসবই প্রাণঘাতী হতে পারে। ফলে কারাগাও করা যাবে না।
মার্চের শেষে দিল্লিতে তাবলিগের জময়াতে নিয়ে বিপুল শোরগোল শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, তাদের মাধ্যমেই দেশ জুড়ে করোনার সংক্রমণ ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তথ্য পুরোপুরি ভুল নয়। গত ১৩ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত দিল্লির নিজামুদ্দিন অঞ্চলে তাবলিগের জমায়েতে অংশ নিয়েছিলেন দুই হাজারেরও বেশি লোক। বিদেশ থেকেও বহু প্রচারক এসেছিলেন সেখানে। লকডাউন শুরু না হলেও, সে সময়ে ৫০ জনের বেশি জমায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল দিল্লি সরকার। তা সত্ত্বেও কী ভাবে ওই অনুষ্ঠানহলো, তা যথেষ্ট প্রশ্নের অবকাশ রাখে। বস্তুত সেখানে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মাধ্যমে যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে করোনার গোষ্ঠী সংক্রমণ ঘটেছে, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। তাবলিগের ঘটনা অবশ্যই নিন্দাযোগ্য এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করে নেওয়া দরকার যে, শুধুমাত্র তাবলিগের ঘটনায় ভারতে প্রায় সাত হাজার মানুষ করোনা আক্রান্ত হননি। ২২৭ জনের মৃত্যু হয়নি। এর দায় আরও অনেকের। তাবলিগকে কাঠগড়ায় তুলে বাকিদের ক্লিনচিট দিয়ে দিলে সত্যের অপলাপ হবে।
তাকানো যাক কেরালার দিকে। এই মুহূর্তে ভারতের অন্যতম সংক্রমিত রাজ্য কেরালা। সেখানে এখনও পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৪০০। তাবলিগের জমায়েত থেকে ছড়ানো সংক্রমণের অনেক আগে থেকেই করোনা রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে বেড়েছে কেরালায়। কী ভাবে? ফেরা যাক ৮ মার্চের ঘটনায়। ওই দিন থেকে সেখানে শুরু হয় ১০ দিনের পোঙ্গল উৎসব। বিশেষজ্ঞদের নিষেধ সত্ত্বেও সেই অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয়। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে উৎসবে যোগ দেন। ফল? এক দিনের ব্যবধানে ৪৩ জনের শরীরে করোনার জীবাণু মেলে। ৮ তারিখেই আক্রান্ত হন পাঁচ জন। সেই পোঙ্গল উৎসবের জন্যই আজ কেরালার এই পরিস্থিতি কি না, কোনও আলোচনায় তা উঠে আসছে না। করোনা নিয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার সময় পোঙ্গল উৎসবের প্রসঙ্গে একটি শব্দও ব্যবহার করা হচ্ছে না।
কর্ণাটকে এখনও পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২০০। সেখানেও তাবলিগের প্রভাব বিশেষ নেই। তা হলে কী ভাবে দক্ষিণ ভারতের এই রাজ্যটিতে সংক্রমণ ছড়ালো? একটি ঘটনার উল্লেখ করা খুবই জরুরি। ১৫ মার্চ মহা ধুমধামের সঙ্গে বিজেপির এক নেতা তথা রাজ্যের বিধায়কের মেয়ের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক হাজার লোক তাতে যোগ দেন। খোদ মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। কী ভাবে ওই জমায়েত হলো, তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও তদন্ত হয়নি। যাঁরা ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদেরও আলাদা করে করোনা পরীক্ষা হয়নি। কেন হলো না? ওই জমায়েত করোনা সংক্রমণের জন্য দায়ী কি না, কেন তা বিবেচনায় আনা হলো না?
আসা যাক যোগী আদিত্যনাথের উত্তর প্রদেশে। করোনা নিয়ে খুবই ব্যতিব্যস্ত এই রাজ্য। এখনও পর্যন্ত সংক্রমিত ৪১০ জন। তাবলিগের মাধ্যমে এই রাজ্যে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। কিন্তু তারও আগে একটি ঘটনা ঘটেছিল। এক হাই প্রোফাইল জন্ম দিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন গায়িকা কনিকা কাপুর। তিনি যে লন্ডন থেকে সদ্য ফিরেছেন লন্ডন থেকে তা বেমালুম চেপে গিয়ে পার্টিতে হাজির হয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানেই যোগ দিয়েছিলেন একাধিক রাজনীতিবিদ। রাজস্থানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াও হাজির ছিলেন সেখানে। ছিলেন তাঁর ছেলে সাংসদ দুষ্মন্ত সিং-ও। কনিকা করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরে উপস্থিত অন্য রাজনীতিবিদদের ১৪ দিনের আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছিল। কনিকার বিরুদ্ধেও এফআইআর দাখিল করা হয়। কিন্তু সেই তদন্ত কোন পর্যায়ে সে বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি। জানা যায়নি, কনিকার মাধ্যমে আরও কত জনের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে। কী করে ওই পরিস্থিতিতে জন্মদিনের অনুষ্ঠান হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি। শুধু তাই নয়, লকডাউন ঘোষণার পরে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ স্বয়ং যোগ দিয়েছিলেন রাম নবমীর উৎসবে। সেই অনুষ্ঠান থেকে কোনও সংক্রমণ ঘটেছে কি না, তা নিয়েও কোনও আলোচনা হয়নি। পরবর্তী সময়ে অবশ্য রামনবমীর উৎসব বন্ধ করা হয় উত্তর প্রদেশে।
আলোচনা বা তদন্ত হয়নি ১৯ তারিখ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন মন্দির এবং মসজিদ কী ভাবে খোলা রাখা হল, তা নিয়ে। লকডাউনের আগের সপ্তাহ পর্যন্ত জুম্মার নামাজ যেমন হয়েছে দেশের বিভিন্ন মসজিদে, একই সঙ্গে হাজার হাজার ভক্ত প্রতিদিন লাইন দিয়ে পুজো দিয়েছেন তিরুপতি সহ দেশের একাধিক মন্দিরে। সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে কি না, সে তথ্যও অন্ধকারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগেই জানিয়েছিল, ভারতে করোনার পরীক্ষা কার্যত হচ্ছে না। ১০ লাখে তিন জনের পরীক্ষা হচ্ছে। গত কয়েক দিনে সে সংখ্যা বেড়েছে। তবু বিশেষজ্ঞদের এক বড় অংশের দাবি, যথেষ্ট পরীক্ষা এখনও হচ্ছে না। এমনকী, গত কয়েক সপ্তাহে যত লোক মারা গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে করোনা আক্রান্ত কতজন ছিলেন, সে বিষয়েও একশ শতাংশ নিশ্চিত তথ্য এখনও পর্যন্ত মেলেনি। এখনও সকলের পরীক্ষা হচ্ছে না। সে কারণেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঠিক ভাবে পরীক্ষা হলে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়তে পারতো। সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ(আইসিএমআর)-এর রিপোর্টেও সেই সম্ভাবনার ইঙ্গিত আছে। রিপোর্টে পরিষ্কার, বিদেশযাত্রা করেননি, এমন বহু লোকের শরীরেই সংক্রমণ মিলেছে। গোষ্ঠী সংক্রমণের কথাও সেখানে বলা হয়েছে।
বস্তুত, মৃত্যু হয়েছিল বলেই পাঞ্জাবের এক শিখ ধর্মগুরুর শরীরে করোনার সংক্রমণ বোঝা গিয়েছিল। যাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন পাঞ্জাবের প্রায় ডজনখানেক গ্রামের মানুষ। করোনার সংক্রমণ মিলেছিল কয়েকশ মানুষের শরীরে।
সমস্যা হলো, ভারতের মতো দেশে প্রভাবশালীরা বরাবরই নিজেদের সব কিছুর ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন। সুযোগ মতো রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রভাবশালীরা ইচ্ছে মতো আইন ভেঙে সংক্রমণের তোয়াক্কা না করে নিজেদের অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন এবং এখনও করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এটা মানসিকতার সমস্যা। তাবলিগের মতো কিছু সংগঠনের ঘটনা সামনে এসেছে এবং তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন মহল বিষয়টিতে সাম্প্রদায়িক রং ছড়ানোরও চেষ্টা চালাচ্ছে। শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নয়, মূলস্রোতের কোনও কোনও গণমাধ্যমও ভুয়ো, সাম্প্রদায়িক খবর প্রচার করে চলেছে। আবারও বলছি, তাবলিগ যা করেছে তা অপরাধ। কিন্তু বাকিদের অন্যায় ধামা চাপা দিয়ে রাখা আরও বড় অপরাধ। মনে রাখা দরকার, করোনা ধর্মীয় বা রাজনৈতিক প্রভাব দেখে আক্রমণ করে না। মানসিকতা না বদলালে দোষারোপের পর্ব বাড়তেই থাকবে। সমাধানের রাস্তা খুলবে না।