কেবল স্বাস্থ্য নয়, স্বাস্থ্যকর্মীরাও সংকটে
২৪ এপ্রিল ২০২০![](https://static.dw.com/image/53032861_800.webp)
সম্প্রতি হাওড়া জেলা পুলিশের একটি ভিডিও ছড়িয়েছে সোশাল মিডিয়ায়৷ সেখানে এক পদস্থ পুলিশ অফিসার এক আবাসনের বাসিন্দাদের উদ্দেশে বলছেন, ‘‘লক ডাউন ভাঙবেন না৷ কারণ করোনায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসা হবে না৷ হাসপাতালে জায়গা নেই! করোনা ধরা পড়ায় একটা হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে হয়েছে, অন্যটাও যে কোনো সময় বন্ধ করার দরকার হতে পারে৷ কাজেই ঘরে থাকুন৷’’
এতটাই খারাপ অবস্থা হাওড়ার৷ যেহেতু ভারতে সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করার পর, লক ডাউনের আগে পর্যন্ত বহু লোক বাইরে থেকে এসেছেন হাওড়ায়৷ ভিন রাজ্য, এমনকি বিদেশ থেকেও৷ তাঁদের কতজন করোনা ভাইরাসের বাহক ছিলেন, এখন আর জানার কোনো উপায় নেই৷
সরকারি হাসপাতালেও প্রথমে কোনো সাবধানতা নেওয়া হয়নি৷ ফলে অন্য উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগী করোনা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন এবং নিজের বাড়িতে, পাড়ায়, বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে জীবাণু ছড়িয়েছেন নিজের অজান্তেই৷ এই খবর দিচ্ছেন প্রশাসনিক আধিকারিকরা৷
কিন্তু করোনা ছড়াতে শুরু করার পরও যে পরিকল্পনাহীনভাবে কাজ করছে সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তর, যেরকম বাস্তববোধ বর্জিত কায়দায় দূর থেকে নির্দেশ ছুঁড়ে দিচ্ছেন স্বাস্থ্য আধিকারিকরা, তাতে সংক্রমণ আরো বাড়বে বৈ কমবে না৷ করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করার অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই উঠছে, যা খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি রাজ্যে আসে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল৷ কিন্তু সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, কীভাবে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের৷ যেমন, করোনার চিকিৎসার আলাদা বন্দোবস্ত করে বলা হয়েছে, সাধারণ চিকিৎসাও চালিয়ে যেতে হবে৷ বিশেষ করে সন্তানসম্ভবা মহিলাদের৷ তাঁদের সময়মতো টিটেনাস, ইত্যাদির ভ্যাকসিন দিতে হবে৷ আবার একই সঙ্গে নির্দেশ জারি হচ্ছে, ‘কন্ট্যাক্টলেস', অর্থাৎ ছোঁয়াচ এড়িয়ে চিকিৎসা করার৷ বুকে-পিঠে স্টেথোস্কোপ ঠেকানো, নাড়ি দেখা, ব্লাড প্রেসার মাপা, অথবা ইঞ্জেকশন দেওয়ার মতো কাজ কীভাবে দূর থেকে করা সম্ভব, সেটা চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের জানা নেই৷ তা-ও যদি পর্যাপ্ত সংখ্যায় সংক্রমণরোধী সুরক্ষা–পোশাক পাওয়া যেতো, কাছে গিয়ে চিকিৎসা করায় ডাক্তার, রোগী, কারোই সংক্রমণের ভয় থাকতো না৷ কিন্তু সেখানেও ঘোর আকাল৷
এর পাশাপাশি করোনা সংক্রমণের হদিস পেতে গিয়েও ব্যাপক সামাজিক প্রতিরোধের মুখে পড়ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ জানালেন হাওড়া জেলা হাসপাতালে কর্মরত সোমঋতা বসু৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের মেয়েরা যখন কমিউনিটিতে যাচ্ছে, যথারীতি অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে৷ একটা হয়ত ‘কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং’ বেরিয়েছে, সেখানে ২৭-২৮ জনের একটা পাড়া পুরো কন্ট্যাক্টে এসেছে৷ তাদের ‘থার্মাল স্ক্রিনিং’ করা, তাদের মধ্যে কারা আসবে কোয়ারান্টাইন সেন্টারে, সেটা স্ক্রিনিং করে বের করানো— ইট উইল টেক টাইম৷ কিন্তু একটা মেয়ে হয়ত রাস্তায় একটু পিছিয়ে গেছে একটা টিম থেকে, কী একটু আলাদা হয়ে গেছে, কারণ, সে হয়ত একটা গলিতে ঢুকেছে, আবার পরের গলিতেও আবার ‘ট্রেস’ করতে যেতে হবে, তো দেখা যাচ্ছে, তাকে পাড়ার লোকেরা ইভটিজ করছে৷ তারা বলছে, এই যে এরা এসেছে, এরাই এসেছে জীবাণুগুলো ছড়াতে! এইরকম ব্যাপারগুলো ঘটছে৷ তার পর নার্সিং স্টাফেরা যেখানে থাকে, এটা তো একদম কমন প্রবলেম (হয়ে গেছে)— বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া, উঠিয়ে দেওয়া৷ এইরকম ব্যাপারগুলো চলছিলই৷ তা-ও সেসব মানুষকে গিয়ে কিছুটা বোঝানো গেছে৷ কিন্তু কমিউনিটির ভেতরে গিয়ে আমরা মানুষের বিরূপ চোখে পড়ছি৷ মানুষ কিন্তু আমাদের সাথে খুব একটা ভালো ব্যবহার করছে না৷’’
কাজেই করোনা সংক্রমণ পরীক্ষার হার বাড়ানোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সচেতনতা বাড়ানো খুবই জরুরি যে, নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে হবে৷ করোনার উপসর্গ দেখা দিলে লুকিয়ে রাখলে হবে না৷ স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে সহযোগিতা করতেই হবে, যাঁরা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াইটা লড়ছেন৷ এবং এই সচেতনতা প্রসারে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকেও দায়িত্ব নিতে হবে৷
করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা, সংক্রমণের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে, অন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে আরো একটা খুব জরুরি কথা বলেছেন এই স্বাস্থ্যকর্মী৷ বলেছেন, কলকাতা, হাওড়ার যে তথাকথিত ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত এলাকা, সেখানকার বাসিন্দা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যে আগামী অন্তত দেড় বছর আবশ্যক অলঙ্কারের মতো হয়ে গেল মুখ ঢাকার মাস্ক৷ এবং চালিয়ে যেতে হবে ব্যাপক হারে স্ক্রিনিং৷ রোগ চেপে রাখা, লুকিয়ে রাখা চলবে না৷