কেমন আছেন বাংলাদেশের সমকামীরা
২৬ মে ২০১৯বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন জুলহাজ মান্নান৷ ২০১৪ সাল থেকে তাঁর সম্পাদনায় বের হতে শুরু করে এলজিবিটিদের নিয়ে প্রথম পত্রিকা ‘রূপবান'৷ ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের লেক সার্কাস রোডের এক বাসায় ঢুকে এই ইউএসএইড কর্মকর্তা ও তাঁর বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়কে হত্যা করা হয়৷ তিন বছর পর এসে সম্প্রতি অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করেছে পুলিশের কাউন্টার টেরোজিম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)৷ দায়ী করা হয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের কথিত নেতা সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকসহ আটজনকে৷ ৩৬ বার পেছানোর পর মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২০ জুন দিন ধার্য করেছে আদালত৷
কিন্তু এই তিন বছরে পরিস্থিতি কতটা বদলেছে? রাষ্ট্রের অসহযোগিতামূলক আচরণে সমকামীদের নিরাপত্তা আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে বলে জানান এই কমিউনিটির সদস্য ও তাঁদের নিয়ে কর্মরত মানবাধিকার কর্মীরা৷
নিগ্রহের শিকার
ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশের কয়েকজন সমকামীর সাথে৷ তাঁদের একজন বাঁধন (ছদ্মনাম), যিনি একজন নবীন আইনজীবী৷ কৈশোর থেকেই তিনি সমলিঙ্গের মানুষের প্রতি আকর্ষণ বোধের বিষয়টি টের পান, যা তাঁকে ক্রমান্বয়ে হতাশায় ফেলে৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন দশজন বন্ধুর সাথে থাকলেও আমার নিজেকে মনে হয় একা৷''
কলেজে-জীবন শুরুর পর ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন কমিউনিটির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়৷ এর বাইরে অন্য কাউকে তিনি বিষয়টি জানানোর কথা ভাবতে পারেন না সামাজিক নিগ্রহের ভয়ে৷ দীর্ঘদিনের পরিচিত একজনকে জানিয়েছিলেন৷ পরে সেই ব্যক্তি তাঁকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেন৷ তাঁর কাছে দশ হাজার টাকা দাবি করে বলেন, টাকা না দিলে বিষয়টা সবাইকে জানিয়ে দেবেন৷ ‘‘আমার একটি ট্যাব ছিল, টাকা দিতে না পারায় সেটি দিয়ে আসতে হয়েছে,'' বলেন বাঁধন৷
অনলাইনভিত্তিক কমিউনিটি ‘বয়েজ অব বাংলাদেশ' ২০১৫ সালে ৫৭১ জন সমকামীর ওপর একটি জরিপ চালিয়েছিল৷ তাঁদের মধ্যে ৫৪ দশমিক তিন ভাগই সব সময় এই ভয়ে থাকেন যে, কেউ হয়তো তাঁদের পরিচয় জেনে ফেলতে পারে৷ ঐ জরিপে ৬৬ দশমিক ছয় ভাগ জানিয়েছেন, সর্বোচ্চ পাঁচ জনের কাছে তাঁরা বিষয়টি প্রকাশ করেছেন৷
বাঁধনও একই কথা জানান৷ তাঁর আশেপাশের, কিংবা পরিবারের তেমন কেউ বিষয়টি জানেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে প্রচুর সমকামী আছে, সেটা সবাই জানে, তারপরও তাঁদেরকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়৷ সামাজিক, পারিবারিক সবক্ষেত্রেই তাঁরা নিগ্রহের শিকার হন৷''
আরেকজন সমকামী নিলয় নীল (ছদ্মনাম) বলেন, ‘‘কৈশোরে সমবয়সীরা যখন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়, আমরা তখন সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হই, বিষয়টি এক ধরনের হীনন্মন্যতা তৈরি করে৷ এরপর শুরু হয় পারিবারিক চাপ৷'' এই কারণে তিনি বছর দুয়েক আগে পরিবার ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন৷ বলেন, ‘‘যখন মনে হলো আর সহ্য করতে পারছি না, তখন আলাদা হয়ে যাই৷''
তিনি নিজে সমকামীদের একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, যার নাম নবপ্রভাত৷ এর যাত্রা শুরু হয়েছে এক বছর হলো৷ দায়িত্বশীল সদস্য আছেন ১১০ জন, এর বাইরে সাতশ' থেকে আটশ' জন বিভিন্ন সময়ে তাঁদের সেমিনারগুলোতে অংশ নিয়েছেন বলে জানান নিলয়৷ ‘‘যাঁরা নিজেদেরকে অপরাধী ভাবে, পাপী মনে করে, তাঁদের আমরা যাই, বোঝানোর চেষ্টা করি যে, আমরা স্বাভাবিক মানুষ৷''
নিলয় জানান, গত বছর খুলনায় তাঁদের এক বন্ধুকে জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়৷ সেই রাতেই সে আত্মহত্যা করে৷ ‘‘এরকম অনেক ঘটনাই আছে, যার মধ্যে পারিবারিকভাবে নির্যাতনের ঘটনাই বেশি৷''
নারীরা আরো বেশি সমস্যায়
নিলয়ের মতে, সমাজে মেয়েদের সমস্যা এমনিতেই বেশি, লেসবিয়ান হলে আরো বেশি ভুগতে হয়৷ তাঁদের কর্মশালায় যোগ দেয়া এক নারী সমকামীর তিন সন্তান রয়েছে৷ তিনি এখনও স্বপ্ন দেখেন সংসার ত্যাগ করে কোনো নারীর হাত ধরে চলে যাবেন৷ ‘‘অনেক লেসবিয়ান নারীকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে৷ তারা প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে,'' বলেন নিলয়৷
ডয়চে ভেলের সাথে কথা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন নারী সমকামীর সাথে৷ তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন উসনোসি নামে৷ শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি যখন বুঝতে শুরু করেছি, তখন কাঁদতাম আর ভাবতাম, আমি এমন কেন, আমার মেয়েদের কেন ভালো লাগে? বড় হওয়ার পর, গুগল করার পর বুঝলাম যে, শুধু আমি না, আমার মতো আরো অনেক জনই আছে বিশ্বে৷''
সমকামী হওয়ার কারণে কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়– এমন প্রশ্নের জবাবে উসনোসি জানান, নিজেকে মানিয়ে নেয়াটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা৷ ‘‘আমার আশেপাশের মানুষগুলোকে আমি বোঝাতে পারি না যে, আমি আর আট-দশটা মানুষের মতো না৷ আমি মেয়ে হলেও নিজেকে ছেলে ভাবি৷ প্রথমে আমার সমস্যা হয়েছে পোশাক নিয়ে৷ যেহেতু আমি মেয়ে, বাসা থেকে সব সময় থ্রিপিস পরতে বলে৷ কিন্তু আমি সেখানে শার্ট-প্যান্ট পরতে ভালোবাসি৷ আমাকে সবাই জিজ্ঞাসা করে, ‘এমন কেন তুমি?' আমার কাছে তার কোনো উত্তর নেই৷''
এক আত্মীয়ের সাথে উসনোসির সাত বছরের ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে৷ তাঁরা বন্ধু পরিচয়ে একসাথেই থাকেন৷ এখন তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ ‘‘এটা কেউ স্বাভাবিকভাবে নেয় না৷ বাবা-মা জানলে বিয়ে দিয়ে দেবে৷ আমি যেহেতু সমকামী, আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলে কী অবস্থা হবে সেটা বোঝেন৷ আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না৷'' এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে একটি পথই খোলা দেখছেন উসনোসি৷ সমকামী হিসেবে জীবন যাপন করতে বাধা থাকবে না, এমন কোনো পাড়ি জমানো৷
নিরাপত্তাহীনতা
২০১৫ সালের দিকে বাংলাদেশের সমকামীরা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে৷ কিন্তু জুলহাজ-তনয় হত্যাকান্ডের পর জীবনের নিরাপত্তাই এখন তাদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে, এমনটাই জানালেন সমকামী অধিকার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী শাহানূর ইসলাম সৈকত৷ তিনি বলেন, ‘‘সমকামী কমিউনিটির প্রত্যেকেই এখন লুকায়িত অবস্থায় বা হাইডিং এ আছে৷ যারাই এক্সপোজ হচ্ছে তাদের উপরই থ্রেটটা চলে আসছে প্রবল আকারে৷ কাজেই আগে যে অবস্থা ছিল তার চেয়েও এখন খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে৷''
তাঁর মতে, আগে জঙ্গি হামলার হুমকি ছিল, এর সঙ্গে এখন রাষ্ট্রীয় চাপও যুক্ত হয়েছে৷ ‘‘আমরা যারা লেখালেখি করেছিলাম, তাদের কণ্ঠটা রোধ করে দেয়া হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে৷'' তিনি অভিযোগ করেন, সমকামীদের নিরাপত্তা দেয়ার ন্যূনতম মানসিকতাও সরকারের নেই৷ উল্টো নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তাঁরা নিগ্রহের শিকার হন৷
২০১৭ সালের মে মাসে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে ২৭ জন সমকামীকে আটক করে র্যাব৷ তাঁদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা দিয়ে থানায় হস্তান্তর করা হয়৷ এই উদাহরণ টেনে নিলয় বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা তো দূরে থাক, উল্টো গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় থাকে৷ তাঁরা শুধু হোমোসেক্সচুয়ালের মামলা দেয় না, মাদকসহ অন্য মামলাও দিয়ে দিচ্ছে৷
আইন কী বলছে
বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা মোতাবেক সমকামিতা শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ৷ এজন্য দশ বছর থেকে আজীবন কারাদণ্ড, সাথে জরিমানার বিধান রয়েছে৷ ১৮৯৮ সালের আইন এটি, যার একই ধারা চালু ছিল ভারতেও৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সেটি বাতিল করে সমকামীতা কোন অপরাধ নয় বলে রায় দিয়েছে৷
শাহানূর ইসলামের মতে, এই ধারাটি বাংলাদেশের সংবিধানের সাথেও সাংঘর্ষিক৷ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে ও মেয়ে কারো অগোচরে যৌন সম্পর্ক করলে তা অপরাধ না৷ তাহলে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে বা মেয়ে কারো অগোচরে যদি সেক্সচুয়াল ইন্টারকোর্স করে, তাহলে কেন সেটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷ সংবিধানের ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান৷ কিন্তু এখানে ঠিকই বৈষম্য হচ্ছে৷''
দেশে এই আইন বাতিলের সহসাই কোনো সম্ভাবনা অবশ্য তিনি দেখেন না৷ তাঁর মতে, রাজনৈতিক কারণে সরকার এই উদ্যোগ নেবে না৷ একমাত্র আদালতে রিটের মাধ্যমেই ধারাটি বাতিল করা যেতে পারে৷ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কারো পক্ষে এই উদ্যোগ নেয়া সম্ভব নয়৷
তবে সমকামীদের মতে, তাঁদের প্রতি সমাজের মনোভাব পরিবর্তনটাই বেশি জরুরি৷ অপরাধী কিংবা সমকামী হওয়ার জন্য নিজেরা দায়ী নন বলে মনে করেন তাঁরা৷ ‘‘মেরে ফেলার ভয় দেখানো থেকে শুরু করে আইনের ভয়, সামাজিক চাপ, সবকিছুর পরও যখন আমরা পরিবর্তিত হতে পারছি না, তখন এটা ধরেই নিতে হবে যে, আমরা জন্মগতভাবে এমন,'' বলেন নিলয় নীল৷