‘জেনারেশন ব্রেক থ্রু' প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোতেও যৌন শিক্ষা দেয়া হচ্ছে৷ একশ মাদ্রাসা এই প্রকল্পের আওতায় আছে৷ শুরুর দিকে অনেক সমস্যা হলেও এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা৷
বিজ্ঞাপন
২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিকের পাঠ তালিকায় স্বাস্থ্যশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হয়৷ ২০১৪ সাল থেকে সেক্স এডুকেশনের জন্য শুরু হয় ‘জেনারেশন ব্রেক থ্রু' প্রকল্প৷ প্রকল্পের প্রথম পর্যায় ২০১৮ সালে শেষ হয়৷ এখন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হচ্ছে৷ প্রথম পর্যায়ে ঢাকাসহ চারটি জেলার তিনশ' হাইস্কুল ও ৫০টি মাদ্রাসাকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে আলাদা পাঁচটি জেলায় দুইশ' হাইস্কুল এবং ৫০টি মাদ্রাসাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানান প্রকল্পটির প্রধান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন৷
তিনি বলেন, ‘‘দুই পর্যায়ে আমরা মোট একশ' মাদ্রাসাকে এই প্রকল্পের আওতায় নিলাম৷ মাদ্রাসা এবং সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা একই পদ্ধতিতে কাজ করি৷ আর আমাদের পদ্ধতি হলো এন্টারটেইনিং৷ মেয়েদের জন্য নারী এবং ছেলেদের জন্য পুরুষ প্রশিক্ষক থাকেন৷ ১৫ থেকে ১৯ বছরের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়৷''
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে চারজন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়৷ তারাই জেনারেশন ব্রেক থ্রু'র প্রশিক্ষণ দেয় শিক্ষার্থীদের৷ আর এর মূল উদ্দেশ্য হলো দুইটি৷ লৈঙ্গিক সাম্যের ব্যাপারে সচেতন করা এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার সম্পর্কে ধারণা দেয়া বলে জানান প্রকল্প পরিচালক৷
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত কনসার্নড উইমেন ফর ডেভেলপমেন্টের টেকনিক্যাল অফিসার ইয়াসমিন আক্তার জানান, ‘‘আমরা রিপ্রোডাকটিভ হেলথ-এর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্নার তৈরি করে দিই৷ সেখানে এ সংক্রান্ত তথ্য থাকে৷ শিক্ষার্থীরা ক্লাবের মত এখান থেকে নিজেরাই শেখে৷ আর জেন্ডার সমতার জন্য ক্লাসেই নানা গেম, রোল ও ক্যারেক্টারের মাধ্যমে কাজ করি৷''
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর
তিনি বলেন, ‘‘মাদ্রাসায় কাজ করতে গিয়ে প্রথম দিকে সমস্যা হয়েছে৷ এটা নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের আড়ষ্টতা ছিলো৷ তারা এটাকে কিভাবে উপস্থাপন করবেন, এই ধরনের সমস্যা ছিলো৷ কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পর তাদের এই জড়তা কেটে যায়৷ শিক্ষার্থীরাও আসলে বিষয়গুলো সম্পর্কে আগে খেকেই জানেন৷ কারণ মাদ্রাসার বইয়েও স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়টি আছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি নির্ভর করে উপস্থাপনার ওপর৷ সেক্স এবং সেক্সুয়ালিটির পার্থক্য জানেন না অনেকেই৷ তারা সেক্স বলতে বোঝেন যৌনকর্ম৷ এজন্য আরো মোটিভেশন দরকার৷ মাদ্রাসাগুলোতে আমরা চেষ্টা করছি৷ তবে পুরোপুরি যে ট্যাবু ভাঙছে তা নয়৷''
ঢাকার তেজগাঁও এলাকার মদিনাতুল উলুম মহিলা কামিল মাদ্রাসায় জেনারেশন ব্রেক থ্রু প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে৷ এই প্রকল্পের আওয়তায় যৌন শিক্ষার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সহকারী শিক্ষক মাকসুদা আক্তার৷ তিনি এখন ছাত্রীদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগে আমরা বিষয়গুলো জানতাম না৷ আমাদের প্রশিক্ষণ ছিলো না৷ তাই অনেকে নেতিবাচকভাবে দেখতো৷ তবে এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে এটার প্রয়োজন আছে৷ বয়ঃসন্ধিকাল, আচরণ, আত্মরক্ষা এগুলো জানা দরকার৷ শিক্ষার্থীরাও ক্লাস করে উপকৃত হচ্ছেন৷ তারা বেশ আনন্দের সাথেই শেখে৷ তারা আমাদের লিখিত মতামত দেন৷ সেখানেও তারা এর উপকারের কথা বলেছেন৷ তবে অভিভাবকরা মাঝেমধ্যে আপত্তি করেন৷ মাদ্রাসা তো তাই৷ তবে আমি এর মধ্যে ক্ষতিকর কিছু দেখি না৷''
মাকসুদা আক্তার
ডেমরার দারুজান্নাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসায়ও সেক্স এডুশেনের এই প্রকল্প আছে৷ মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ মাওলানা আবুবকর সিদ্দিকও এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ছাত্রদের ক্লাশ ও প্রশিক্ষণ আমি দেখেছি৷ আমার কাছে মনে হয়েছে তাদের কিছু না কিছু উপকার হচ্ছে৷ এটাকে আমার ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে হয়নি৷''
তবে যাত্রাবাড়ির তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ড. আবু ইউসুফ মনে করেন, যৌন শিক্ষা এভাবে দেয়ার দরকার নেই৷ এগুলো এমনিতেই মানুষ শেখে৷ বরং এতে ক্ষতি হতে পারে বলে তিনি মনে করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যেহেতু আমাদেরটা সরকারি এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা, তাই বাধ্য হয়ে আমরা সরকারি চাপে এই প্রকল্প পরিচালনা করছি৷''
কিন্তু ওই মাদ্রাসারই সহকারী শিক্ষক এবং ব্রেক থ্রু প্রকল্পের প্রশিক্ষক জিয়াউর রহমান বলেন, ‘‘প্রশিক্ষণ নেয়ার আগে আমার কাছেও যৌন শিক্ষার বিষয়টি ভালো লাগেনি৷ কিন্তু এখন আমার কাছে বিষয়গুলো পরিষ্কার৷ প্রজনন স্বাস্থ্যসহ আরো যা আমরা ছাত্রদের শিখাই তা অনেক প্রয়োজন৷ ছাত্ররাও এখন আগ্রহ নিয়ে শেখেন৷ ধীরে ধীরে এটা নিয়ে ভুল ধারণা ভেঙে যাচ্ছে৷''
বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা ও শিক্ষা
কওমি মাদ্রাসা বেসরকারি ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ ঢাকার কামরাঙ্গির চরে এমনই এক মাদ্রাসা জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া৷ সেখানে একটা গোটা দিন কাটিয়ে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার নানা দিক ক্যামেরায় তুলে ধরেছেন মুস্তাফিজ মামুন৷
ছবি: DW/M. Mamun
সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি
বাংলাদেশে প্রচলিত দু’ ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কওমি মাদ্রাসা একটি৷ উনিশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার মাধ্যমে বাংলাদেশেও কওমি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হয়৷ দীর্ঘকাল ধরে কওমি মাদ্রাসা সরকারের আর্থিক সহায়তা ছাড়াই সাধারণ জনগণের সহায়তায় পরিচালিত হয়ে আসছিল৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করেছে ইসলামি এ শিক্ষা ব্যবস্থা৷
ছবি: DW/M. Mamun
১৪ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখেরও বেশি৷ তবে বেসরকারি হিসেব মতে, সারা দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
মাদ্রাসার একটি ক্লাসরুম
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিচালিত ঢাকার জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তরের একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরে আরবির পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজিসহ সাধারণ শিক্ষাও দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
সহশিক্ষায় বাধা নেই শিশুদের
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থায় সহশিক্ষা স্বীকৃত নয়৷ তাই মহিলাদের শিক্ষার জন্য আলাদা কিছু প্রতিষ্ঠান আছে৷ তবে প্রাথমিক স্তরে শিশুদের সহশিক্ষার কোনো বাধা নেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
স্বতন্ত্র শিক্ষা বোর্ড দ্বারা পরিচালিত
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর একাংশ পরিচালিত হয় স্বতন্ত্র একটি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে৷ ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া’ (বেফাক) নামের এই শিক্ষা বোর্ড কওমি মাদ্রাসার পরীক্ষাসহ নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ক্লাস হয় আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সেশন পরিচালনা হয় আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী৷ সাধারণত বেফাক আওতাধীন মাদ্রাসাগুলোর নতুন সেশন শুরু হয় আরবি ক্যালেন্ডারের শাওয়াল মাসের ১০ তারিখ থেকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পড়া ও শোয়ার জায়গা একটাই
ঢাকার জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এই কক্ষটি শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গাও৷ সাধারণত কওমি মাদ্রাসাগুলিতে পাঠদান এবং শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা একই হয়ে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সর্বক্ষণের সঙ্গী একজন শিক্ষক
কওমি মাদ্রাসার প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি একজন শিক্ষকও থাকেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
রুটিনমাফিক জীবন
কওমি মাদ্রাসাগুলো সম্পূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থায় পরিচালিত৷ তাই শিক্ষার্থীদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন রুটিনের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
উচ্চশিক্ষার সুযোগ
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ হিফজুল কোরান (বানানভেদে কোরআন)৷ এ বিষয়ের শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র পবিত্র কোরান শরীফ মুখস্থ করে থাকেন৷ তবে হিফজুল কোরান শেষ হলে কওমি মাদ্রাসাগুলোতে অন্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষারো সুযোগ আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সর্ব্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিস
জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের একটি শ্রেণিকক্ষ৷ এটি কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ শ্রেণি৷ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার এই শ্রেণিকেই মাস্টার্স-এর সমমান বলে ঘোষণা করেছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পড়াশোনার মূল মাধ্যম আরবি
কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের হাদিস সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত পড়ানো হয়৷ এ বিষয়ে পড়ানোর মূল মাধ্যম আরবি ভাষা৷ হাদিসের যথাযথ ব্যাখ্যা আরবি ভাষাতেই সম্ভব, এমনটাই মনে করা হয়ে থাকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
আছে উর্দু এবং ফারসি ভাষাও
বাংলাদেশের কাওমি মাদ্রাসাগুলোয় প্রাথমিক স্তরে আরবির সঙ্গে বাংলা, ইংরেজি ইত্যাদি পড়ানো হলেও উচ্চস্তরে আরবি ছাড়াও পড়ানো হয় উর্দু এবং ফারসি ভাষা৷
ছবি: DW/M. Mamun
গরিব ছাত্রদের জন্য ফ্রি খাবার
কওমি মাদ্রাসাগুলোয় গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে৷ তবে সামর্থবানদের থাকা ও খাওয়ার জন্য নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
মেঝেতেই খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা
শিক্ষা কার্যক্রম, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে টেবিল-চেয়ারের ব্যবহার নেই কওমি মাদ্রাসাগুলোয়৷ ইসলামি সুন্নত অনুসরণে পাঠদান কার্যক্রম, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সম্পন্ন হয় মেঝেতেই৷