কোটা সংস্কার আন্দোলনের ত্রিমুখী ‘প্রতিক্রিয়া'
১৭ এপ্রিল ২০১৮কোটা সংস্কার আন্দোলনের যাঁরা নেতৃত্বে আছেন, তাঁরা গ্রেপ্তার ও হামলার আতঙ্কে আছেন৷ মঙ্গলবার তিনজনকে আটক এবং পরে ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় তাঁরা এখন ভয়ের মধ্যে আছেন৷ দু-একজন গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে হল ছেড়ে দিয়েছেন৷
কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান, নুরুল হক ও ফারুক হাসানকে মঙ্গলবার দুপুরের পর ঢাকা মেডিকেলের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি৷ পরে অবশ্য তাঁদের ছেড়ে দেয়া হয়৷ ওই তিনজনের একজন রাশেদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের চোখ বেঁধে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় গালাগাল করা হয়৷ ডিবি অফিসে নিয়ে আমাদের ফ্লোরে বসিয়ে রাখা হয়৷ তখন আমাদের এক বন্ধু নুরুল অসুস্থ হয়ে পড়লেও তার চোখ খোলা হয়নি৷ ডিবি অফিসে আমাকে বলা হয়, তোরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিস৷ তোরা কোনোদিন সরকারি চাকরি পাবি না৷ একই সময়ে ঝিনাইদহে আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে আমার বাবাকেও থানায় নিয়ে যাওয়া হয়৷ তাঁকে বলা হয়, তিনি জামায়াতের সঙ্গে জড়িত৷ আমার বাবা কৃষক৷ আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তান৷ কষ্ট করে এ পর্যন্ত এসেছি৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ-তে ভর্তি হয়েছি৷ কিন্তু এখন যে পরিমাণ হুমকির মুখে আছি, তাতে শেষ করতে পারব কিনা জানি না৷ আটকের পর ছাড়া পেয়ে হুমকির মুখে হল ছেড়ে দিয়ে মিরপুরে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছি৷''
তিনি বলেন, ‘‘এখন আমাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে৷ এর একটাই কারণ, সামনেই ছাত্রলীগের যে কাউন্সিল, সেই কাউন্সিল যাতে না হতে পারে, দেশে একটা সহিংসতা বাধে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের তুলে নেয়ার সময় অনেকেই দেখেছেন৷ সাংবাদিকরা দেখেছেন৷ এই খবর সংবাদ মাধ্যমে আসায় আমাদের ছেড়ে দেয়া হয়৷''
রাশেদ খান আরো বলেন, ‘‘আমি এখন হুমকির মুখে আছি৷ আমাদের ওপর হামলা হতে পারে, আমরা গ্রেপ্তার হতে পারি, আমাদের গুম করে দেয়া হতে পারে৷ এবং এই সুযোগটা কিন্তু যারা ষড়যন্ত্রকারী আছে, বিরোধীপক্ষ বলেন, জঙ্গিগোষ্ঠী বলেন, তারাও কিন্তু সুযোগ নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে৷''
কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা কালকের (শুক্রবার) মামলা তুলে নেয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছি৷ যদি তুলে না নেয়া হয়, তাহলে আমরা নতুন কী কর্মসূচি দেবো সে ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি৷ কিন্তু এরইমধ্যে আমাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে৷ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থক ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের তিন জনকে তুলে নেয়া হয়েছে ভয় দেখানোর জন্য৷ আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য৷ একটি সেটেলড ইস্যুকে নিয়ে নতুন আরেকটি পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে৷ যারা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, তারা কেউ রাজনৈতিকভাবে অংশ নেয়নি৷ যার যার রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকতে পারে৷ কিন্তু এখানে সবাই কোটা সংস্কারের জন্য অংশ নিয়েছে৷ এখন এটাকে একটা রাজনৈতিক কালার দেয়ার চেষ্টা চলছে৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে হাসান আল মামুন বলেন, ‘‘আমরা কখনোই কোটা বাতিল চাইনি৷ আমরা কোটা সংস্কার চেয়েছি৷ তারপরও প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমরা তা মেনে নিয়েছি৷ আমরা আমাদের আন্দোলন স্থগিত করেছি৷''
এশাকে ফিরিয়ে ২৪ জনকে বহিস্কার করল ছাত্রলীগ
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ১০ এপ্রিল রাতে বেগম সুফিয়া কামাল হলে আন্দোলনকারীদের পেটানো এবং মোর্শেদা খানম নামে এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দেয়ার অভিযোগ তুলে ওই হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ইফফাত জাহান এশাকে বেদম প্রহার করে জুতার মালা পরানো হয়৷ এ ঘটনার পরই ছাত্রলীগ তাকে বহিস্কার করে৷বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তাৎক্ষণিকভাবে বহিস্কার করে তাকে৷ তবে পরে জানা যায়, এশা রগ কাটেননি, রাগ করে জানালায় লাথি মারায় মোর্শেদা খানমের পা কেটেছিল৷
এরপর ছাত্রলীগ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে৷ একদিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি এশাকে নির্দোষ ঘোষণা করে এবং ছাত্রলীগ আবার তাকে আগের পদে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে৷ তারপর যাদের বিরুদ্ধে এশাকে হেনস্তা করা এবং তার গলায় জুতার মালা পরানোর অভিযোগ ওঠে, বুধবার রাতে তাদের মধ্যে ২৪ জন ছাত্রলীগ নেত্রীকে বহিস্কার করে ছাত্রলীগ৷ বহিস্কৃতরা সবাই সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী৷
তাদের মধ্যে আহত ওই ছাত্রী, বেগম সুফিয়া কামাল হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোর্শেদা খানমও রয়েছেন৷ এ বিষয়ে কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে৷ তারা দাবি করেছেন,মোর্শেদার রগ কাটা হয়নি৷ তিনি নিজেই বিক্ষুব্ধ হয়ে গেস্টরুমের কাঁচের দরজায় লাথি মারলে তাঁর পা কেটে যায়৷ কিন্তু তার আগে গেস্টরুমে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাওয়া ছাত্রীদের ‘বিচার' করছিলেন এশা৷ আর তাতে সাধারণ ছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হলে ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বলে তাদের দাবি৷ তারা বলেন, অতিউৎসাহী হয়ে কেউ কেউ এশার গলায় জুতার মালা পরিয়েছে৷ এ নিয়ে এই ঘটনায় ওই হলের বহিস্কৃত ছাত্রলীত নেত্রী খালেদা হোসেন মুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি গত এক বছর ধরে হলে থাকি না৷ ঘটনার রাতেও ছিলাম না৷ আমাকে ওই রাতে ছাত্রলীগ নেতারা ফোন করেছিলেন৷ আমি তখন বাসায় ছিলাম৷ আমি বলেছিলাম কোনো গাড়ি বা মোটরসাইকেল পাঠালে আমি হলে গিয়ে এশাকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারি৷'' তিনি বলেন, ‘‘ওই রাতে কী ঘটেছিল হলে না থাকায় আমি তা বলতে পারবো না৷ কিন্তু অন্যায়ভাবে আমিসহ আরো কয়েবজনকে বহিস্কার করা হয়েছে৷ আমি তাই ফের নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছি৷''
এবার রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন?
২৪ এপ্রিল শাহবাগে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ ডাকা হয়েছে৷ নৌমন্ত্রী শাহজাহান খানসহ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী এই সমাবেশের দায়িত্বে আছেন৷ এর আগে তাঁরা প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা করে তাদের রাষ্ট্রীর সুযোগ-সুবিধা বাতিলের দাবি জানানো হবে৷ জানা গেছে, শাহবাগের সমাবেশ থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের সন্তানদের সরকারি চাকরি থেকে বাদ এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বাতিলেরও দাবি জানানো হতে পারে৷ একইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটার দাবিও তুলতে পারেন তাঁরা৷