কোহলির সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশকে হারিয়ে ভারতের চারে চার
১৯ অক্টোবর ২০২৩নীল জার্সির ভরা গ্যালারিতে এবং ভারতের ড্রেসিং রুমে; গোটা ম্যাচে টানটান উত্তেজনার কারণ ছিল একটাই। বিস্তর বল হাতে রেখে ভারত যখন জয় থেকে মাত্র ১৯ রান দূরে, বিরাট কোহলি তখন ৮১ রানে অপরাজিত। কোহলি কি সেঞ্চুরি করতে পারবেন? নাকি নব্বইয়ের ঘরে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়তে হবে? হাসান মাহমুদ এবং নাসুম আহমেদ দুজনেই একটা করে ওয়াইড দিয়ে সেঞ্চুরির সমীকরণটাকে নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, তবে পারেননি। কোহলি দারুণভাবে ডাবলস নিয়ে নিয়ে স্ট্রাইক ধরে রেখে রেখে জয়সূচক রানটা তুলেছেন নাসুমকে মারা ছক্কায়। তাতেই ৯৭ থেকে ১০৬* রানে পৌঁছে গেছেন কোহলি, তুলে নিয়েছেন ওয়ানডেতে নিজের ৪৮তম সেঞ্চুরি। একই সঙ্গে দলকে এনে দিয়েছেন ৫১ বল হাতে রেখে ৭ উইকেটের বিশাল জয়, যাতে করে ৪ ম্যাচে ৮ পয়েন্টের সঙ্গে রানরেটটাও স্বাস্থ্যবান করে নিয়েছে ভারত। এমন ইনিংসের পর ম্যাচসেরা কোহলি ছাড়া আর কে হতে পারে!
বাংলাদেশের বোলাররা ভারতের ব্যাটিং দূর্গে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটতে পারেননি। বল করেছেন, ভারতের ব্যাটসম্যানরা ইচ্ছেমতো রান তুলেছেন। উড়িয়ে মারতে গিয়ে কেউ আউট হলে পরের ব্যাটসম্যান এসে দ্বিগুণ উৎসাহে বল সীমানাছাড়া করেছেন। রোহিত শর্মা করেছেন ৪৮ রান। ডেঙ্গু থেকে ফিরে এসে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে খানিকটা বিবর্ণ ছিলেন শুভমান গিল, ৫৩ রানের ইনিংসে জানান দিলেন তিনিও তৈরি। শ্রেয়াশ আইয়ার ১৯ রানের বেশি না করাতেই না কোহলির সেঞ্চুরিটা হলো!
অন্যদিকে লোকেশ রাহুলও ৩৪ রানে অপরাজিত থেকেছেন, তিনি কোহলির সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জাগার পর আর রান করার চেষ্টাও করেননি।
দুঃসংবাদ দিয়ে যে ম্যাচের শুরু, তার শেষটায় যে কোনো সুসংবাদ অপেক্ষা করে থাকবে না সেটা অনেকটা অনুমিতই ছিল। সাকিব আল হাসানের খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। চেন্নাইতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে দৌড়ে রান নেবার সময় তার পেশিতে টান লাগে, পরে স্ক্যান করে দেখা যায় পেশিতে গ্রেড-ওয়ান টিয়ার। সাকিবকে তাই ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামানোর ঝুঁকি নেয়নি বাংলাদেশ, কারণ, বিশ্বকাপের আরো ৫টা ম্যাচ বাকি। তার অবর্তমানে সহ-অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশকে। টস করতে শান্তকে আসতে দেখেই অনেকের বোঝা হয়ে যায়, দিন শেষে ফলটা কী হতে যাচ্ছে। দলের সেরা খেলোয়াড়কে ছাড়া বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দলের মুখোমুখি হওয়াটা যুদ্ধের ময়দানে অনেকটা নিরস্ত্রভাবে হাজির হওয়ার মতোই। হয়েছেও তাই। ভালো শুরুর পর বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশ মাঝপথে খেই হারিয়েছে। এরপর বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত সেরা ব্যাটিং উইকেটে নির্বিষ বোলিং নিয়ে সেই মাঝারি পুঁজি বাঁচাতে খাবি খেয়েছে।
টস জয়ী শান্ত বেছে নেন ব্যাটিং। শুরুতে সাবধানী হলেও ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসেন দুই উদ্বোধনী ব্যাটার তানজিদ হাসান তামিম (৫১) ও লিটন কুমার দাস (৬৬)। দুজনেই করেন হাফসেঞ্চুরি। উদ্বোধনী জুটিতে আসে ৯৩ রান, যা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। এর আগে নর্দাম্পটনে, পাকিস্তানের বিপক্ষে মেহরাব হোসেন ও শাহরিয়ার হোসেনের ৬২ রানই ছিল বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উদ্বোধনী জুটি। তানজিদ তামিম দেখা পেয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের প্রথম হাফসেঞ্চুরির। তাকে ঘিরে ক্রমাগত সমালোচনার মাঝেও দলের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন ৪৩ বলে ৫১ রানের ইনিংস খেলে, তাতে পাঁচটি বাউন্ডারি আর তিনখানা ছক্কা।
অবশ্য প্রাপ্তির আনন্দ বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারেননি তরুণ এই ব্যাটার, ব্যক্তিগত মাইলফলকে পৌঁছাবার পরই সবার প্রথমে বিদায় নেন কুলদীপ যাদবের সোজা আসা বলে সুইপ খেলতে গিয়ে এলবিডাব্লিউ হয়ে। এরপর ব্যাট করতে আসেন অধিনায়ক শান্ত, তিনিও বিদায় নেন মাত্র ৮ রান করে। রবীন্দ্র জাদেজার বলে ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে তিনিও পড়েন লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে। চারে আসা মেহেদি হাসান মিরাজ (৩) আউট হন মোহাম্মদ সিরাজের লেগ স্টাম্প দিয়ে বের হয়ে যাওয়া বলে খোঁচা দিয়ে, উইকেটের পেছনে দারুণ ক্যাচ নিয়েছেন লোকেশ রাহুল। একপ্রান্তে অব্যাহত উইকেট পতনের ধারা দেখে লিটনও বোধহয় অন্যপ্রান্তে অধৈর্য্য হয়ে ওঠেন। জাদেজার বলে ক্যাচ তুলে দেন লং অফে দাঁড়ানো শুভমান গিলের হাতে। ৮২ বলে ৬৬ রানে থামে লিটনের ইনিংস। প্রথম রানটা করার আগে লিটন সময় নিয়েছিলেন ১২ বল, পরে সেই দূরত্ব কমিয়ে এনেছিলেন। চার মারেন সাতটি। যখন আউট হলেন, তখনও ইনিংসের ২২ ওভার বাকি। নিশ্চিতভাবেই একটা শতক হাতছাড়া করলেন লিটন, আরো একবার ঝলক দেখিয়ে বিদায় নিলেন অতৃপ্তি রেখে।
এশিয়া কাপে ভারতকে হারানো ম্যাচটায় হাফসেঞ্চুরি ছিল তাওহিদ হৃদয়ের। বৃহস্পতিবার সুযোগ ছিল সেই কীর্তির পুনরাবৃত্তির। মিড উইকেট দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে একবার বেঁচেছেন, শার্দুল ঠাকুরের বলে শুভমান গিলের হাতে ক্যাচ দিয়ে ৩৫ বলে ১৬ রান করে হতাশার ছাপ রেখেই অবশেষে ফিরেছেন হৃদয়। মুশফিকুর রহিম লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।কিন্তু জাসপ্রিত বুমরার বলে কাট করতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে জাদেজার দুর্দান্ত ক্যাচের শিকার হয়ে তাকে থেমে যেতে হয় ৩৮ রানেই।
বাংলাদেশের ইনিংসের সমাপ্তিটা সুন্দর হয়েছে মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে। বুমরার ইয়র্কারে বোল্ড হবার আগে পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে খেলেছেন ৩৬ বলে ৪৬ রানের ইনিংস। চার মেরেছেন ৩টি, ছক্কা ৩টি। নিজের সবশেষ চার ইনিংসের তিনটিতেই হাফসেঞ্চুরির কাছাকাছি গিয়ে আউট হলেন মাহমুদউল্লাহ। সবশেষ ওয়ানডে হাফসেঞ্চুরি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে, ভারতের বিপক্ষে।
৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ২৫৬ রান- এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। ভারতের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া এবং পাকিস্তানের মতো দল দুইশ রান পার করতে পারেনি, বাংলাদেশ পেরেছে। এই তৃপ্তি স্থায়ী হয়নি বেশিক্ষণ। শুরুতে রোহিত ও শুভমানের সংহার মূর্তির পর ৬ বাউন্ডারি আর ৪ ছক্কায় সাজানো বিরাট কোহলির নিখুঁত অথচ নিষ্ঠুর ইনিংসে ৫১ বল আগেই ৭ উইকেট হাতে রেখে ম্যাচটা জিতেছে ভারত।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
বাংলাদেশ ৫০ ওভারে ২৫৬/৮, লিটন ৬৬,তানজিদ ৫১, মাহমুদউল্লাহ ৪৬; বুমরাহ ২/৪১, জাদেজা ২/৩৮, সিরাজ ২/৬০
ভারত ৪১.৩ ওভারে ২৬১/৩, কোহলি ১০৩*, গিল ৫৩, রোহিত ৪৮; মিরাজ ২/৪৭
ফল: ভারত ৭ উইকেটে জয়ী
ম্যাচসেরা: বিরাট কোহলি