আল-কায়েদার পোস্টার বয় থেকে আল কায়েদার আগামী নেতা বলে যার নাম শোনা যাচ্ছে, ওসামা বিন লাদেনের পুত্র সেই হামজা বিন লাদেনকে সদ্য ‘‘গ্লোবাল টেররিস্ট'' হিসেবে ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷
বিজ্ঞাপন
হামজা বিন লাদেনের খুব বেশি ছবি দেখতে পাওয়া যাবে না৷ যেগুলো আছে, সেগুলোও ২০০০ সালের কাছাকাছি সময়ে তোলা৷ তখন ওসামা বিন লাদেনের ছেলের বয়স ১২ বছর৷ মাথায় পাগড়ি, গায়ে মিলিটারি কামোফ্লেজের ভেস্ট, তরুণ হামজা একটি ঘোষণা পড়ে শোনাচ্ছে যেন সে ইতিমধ্যেই আল-কায়েদার একজন মুখপাত্র হয়ে উঠেছে৷ অন্যান্য ছবিতে কখনো সে গুলিতে ঝাঁঝরা উইন্ডশিল্ডের পিছনে অফ-রোড ভেহিকলে বসে, কখনো পাথুরে জমিতে মেশিন গান হাতে ৷
হামজা বিন লাদেনের যাত্রা তাকে আজ তার বাবার পর্যায়ে এনে দিয়েছে: এ বছরের সূচনায় মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাকে ‘‘ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্ট'' বা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসেবে ঘোষণা করেছে৷
দাম বাড়ল
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ওঠার ফলে স্বভাবতই আল-কায়েদার স্ট্র্যাটেজিস্টদের কাছে হামজা বিন লাদেনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও কর্তৃত্ব বাড়ল৷ ঐ তালিকায় শত শত নাম থাকা সত্ত্বেও, ওসামা বিন লাদেনের সন্তানের নাম স্বভাবতই চোখে পড়বে৷ আল-কায়েদা সংগঠন অবশ্যই হামজার এই ‘সম্মাননায়' সুখি৷
২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেন বিশেষ মার্কিন সেনাদের হাতে মিহত হবার পর আয়মান আল-জাওয়াহিরি আল-কায়েদার নেতৃত্ব নেন৷ কিন্তু মিশরীয় আল-জাওয়াহিরির বিন লাদেনের মতো ব্যক্তিত্ব না থাকার কারণে, ওসামা বিন লাদেনের ক্যারিসম্যাটিক পুত্র হামজা বিন লাদেনকে আল-কায়েদার নেতৃপদে দেখতে অনেক সদস্যেরই আপত্তি না থাকারই কথা৷
হামজার পুরনো ছবিগুলো থেকেই দেখা যায় যে, বাবার কাছে তার দীক্ষা হয়েছে, আল-কায়েদার আদর্শ তার মজ্জায় মজ্জায়৷ বড় হবার পরে সে আল-কায়েদার কার্যকলাপে আরো বেশিভাবে জড়িয়ে পরে৷ ২০০৫ সালের একটি ভিডিও-তে দেখা যায়, হামজা কীভাবে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর উপর আক্রমণে অংশ নিচ্ছে৷
‘ইসলামিক স্টেট’ আসলে কী?
আল-কায়েদার অখ্যাত এক উপদল থেকে প্রভাবশালী ‘মিলিট্যান্ট মুভমেন্টে’ পরিণত হয়েছে তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস৷ জিহাদি এই গোষ্ঠীটির দখলে থাকা অঞ্চল থেকে আক্রমণের কৌশল – আইএস-এর এমন নানা দিক তুলে দেয়া হলো এই ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
আইএস কোথা থেকে এসেছে?
ইসলামিক স্টেট (আইএস) সুন্নী ইসলামিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী আল-কায়েদার একটি উপদল, যেটি আইএসআইএল, আইসিস এবং দায়েশ নামেও পরিচিত৷ ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর এটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে৷ এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন আবু বকর আল-বাগদাদি৷ জঙ্গি গোষ্ঠীটির লক্ষ্য হচ্ছে ইরাক, সিরিয়া এবং অন্যান্যা অঞ্চল নিয়ে একটি ইসলামিক স্টেট বা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইএস কোথায় কাজ করে?
বিশ্বের ১৮টি দেশে আইএস সক্রিয় রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷ ইরাক এবং সিরিয়ার কিছু অংশ এই গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং এটি সিরিয়ার রাকা শহরকে রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করে৷ তবে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন অবধি নিজেদের দখলে থেকে এক চতুর্থাংশ এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে৷
কারা তাদের বিরুদ্ধে লড়ছে?
আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেশ কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে৷ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে তৈরি মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটি ‘কোয়ালিশন’ আইএস অধ্যুষিত এলাকায় বিমান হামলা চালাচ্ছে৷ এই কোয়ালিশনে কয়েকটি আরব দেশও রয়েছে৷ অন্যদিকে সিরিয়া সরকারের পক্ষে সেদেশে বিমান হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া৷ তবে ভূমিতে তাদের বিরুদ্ধে লড়ছে কুর্দিশ পেশমার্গার মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো৷
ছবি: picture-alliance/abaca/H. Huseyin
আইএস-এর অর্থের উৎস কী?
জঙ্গি গোষ্ঠীটির অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে তেল এবং গ্যাস৷ এটি এখনো সিরিয়ার তেল উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ দখলে রেখেছে৷ আর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিমান হামলার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জঙ্গি গোষ্ঠীর এই মূল্যবান সম্পদ৷ এছাড়া কর, মুক্তিপন এবং লুট করা পুরাকীর্তি বিক্রি করেও অর্থ আয় করে এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷
ছবি: Getty Images/J. Moore
আইএস কোথায় কোথায় জঙ্গি হামলা চালিয়েছে?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস৷ চলত বছর সবচেয়ে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলাটি চালানো হয়েছে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে, যেখানে দু’শোর বেশি মানুষ নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে৷ আইএস-এর নেতারা জঙ্গি গোষ্ঠীটির আদর্শে বিশ্বাসীদের এককভাবে বিভিন্নস্থানে আঘাত হানতে উৎসাহ প্রদান করে৷
অন্যান্য আর কী কৌশল ব্যবহার করে আইএস?
নিজেদের ক্ষমতার পরিধি বাড়াতে অনেক কৌশল ব্যবহার করে আইএস৷ জঙ্গি গোষ্ঠীটি ‘কালচারাল ক্লিনজিংয়ের’ নামে সিরিয়া এবং ইরাকের অনেক ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম লুট ও ধ্বংস করেছে৷ এছাড়া সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর কয়েকহাজার মেয়েকে ক্রীতদাসী বানিয়েছে৷ গোষ্ঠীটি নিজেদের ‘প্রোপোগান্ডা’ এবং নিয়োগের কাজে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
শরণার্থী হয়েছেন কতজন?
সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সেদেশের প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রতিবেশী লেবানন, জর্ডান এবং তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন৷ অনেক সিরীয় ইউরোপেও পাড়ি জমিয়েছেন৷ এছাড়া প্রায় ৩০ লাখ ইরাকে ইরাকের মধ্যেই অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
7 ছবি1 | 7
হামজার বার্তা
বিগত কয়েক বছর ধরে হামজা বিন লাদেনকে আল-কায়েদার একজন নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে দেখা যাচ্ছে৷ ২০১৫ সালের আগস্ট মাসের একটি অডিও বার্তায় হামজা তার অনুগামীদের প্রতি আল-কায়েদার সংগ্রামকে ওয়াশিংটন, লন্ডন, প্যারিস ও তেল আভিভে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে৷
২০১৬ সালের মে মাসে প্রকাশিত আরেকটি অডিও বার্তায় হামজা ঘোষণা করে যে, ‘‘পবিত্র সিরীয় বিপ্লব'' জেরুসালেমের ‘‘মুক্তি''-কে আরো সম্ভাব্য করে তুলেছে৷ সেই মাসেই আল-কায়েদা নেতা আল-জাওয়াহিরি ঘোষণা করেন যে, তরুণ হামজাকে সংগঠনের নেতৃমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ সেই পদ থেকে হামজা বিন লাদেন ২০১৬ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত আরেকটি অডিও বার্তায় ঘোষণা করে যে, ‘‘উই আর অল ওসামা'', ‘আমরা সকলেই ওসামা'৷ সেই বার্তাতেই হামজা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দেয় যে, তার বাবাকে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া হবে৷
আইএস-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা
হামজার এই সব বার্তার অর্থ, আল-কায়েদা নতুন সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা জোরদার করছে, কেননা ইসলামিক স্টেট যেখানে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়েছে, আল-কায়েদার লক্ষ্য তার চেয়ে অনেক কম উচ্চাভিলাষী৷ আল কায়েদার লক্ষ্য হলো মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা, বিশেষ করে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতির অবসান ঘটানো৷
আইএস-এর আরেকটি ট্রেডমার্ক হলো তাদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা, যার মধ্যে শিরচ্ছেদ থেকে শুরু করে ধর্ষণ অবধি সব কিছু পড়ে৷ আইএস-এর নিষ্ঠুরতার ভিডিওগুলিই আবার তাদের নতুন রংরুট এনে দেয়৷
এখন প্রশ্ন হলো, হামজার নেতৃত্বে আল কায়েদাও সেই পথেই যাবে কিনা৷
ক্যার্স্টেন ক্নিপ/এসি
বিশ্বের ভয়ংকর পাঁচ জঙ্গি সংগঠন
তথাকথিত জঙ্গিদের কারণে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷ অনেকেরই ধারণা তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস-ই সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি গোষ্ঠী৷ কিন্তু বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচি বা গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স কিন্তু বলছে ভিন্ন কথা৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Lieman
বোকো হারাম
ইসলামিক স্টেট বা আইএস নয়, বিশ্বের ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠনগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে নাইজেরিয়ার বোকো হারাম৷ ২০১৫ সালে আবু বকর শেকাউ-এর নেতৃত্বে এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি ৬ হাজার ৬৪৪ জন মানুষকে হত্যা করেছে৷ তাদের হামলায় আহত হয়েছে ১,৭৪২ জন৷ বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক৷ এছাড়া হাজারো কিশোরীকে অপহরণ করেছে বোকো হারাম৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S.Alamba
ইসলামিক স্টেট
যদিও বোকো হারাম আইএস-এর তুলনায় বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, কিন্তু আতঙ্ক সৃষ্টির দিক থেকে সবচেয়ে উপরে আছে আইএস৷ বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলা হচ্ছে আইএসকে৷ ২০১৫ সালে তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৬ হাজার ৭৩ জন মানুষ এবং আহত হয় ৫ হাজার ৭৯৯ জন৷ ১০৭১টি হামলা চালিয়েছে তারা বিশ্ব জুড়ে৷ আবু বকর আল-বাগদাদির নেতৃত্বে সংগঠনটি সিরিয়া, ইরাক, তুরস্ক ও ইউরোপ জুড়ে এখনো হামলা চালিয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তালেবান
১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলার সময় এই জঙ্গি সংগঠনটির আবির্ভাব৷ বিশ্বের সবচেয়ে অভিজ্ঞ জঙ্গি সংগঠন বলা হয় এদের৷ ২০১৫ সালে তালেবানের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৩ হাজার ৪৭৭ জন এবং আহত হয়েছে ৩ হাজার ৩১০ জন৷ গত বছর বিশ্ব জুড়ে ৮৯১ টি হামলা চালিয়েছে তারা৷ হিবাতুল্লাহ আকন্দজাদা এখন তালেবানের নেতৃত্বে রয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Noorullah Shirzada
ফুলানি জঙ্গি গোষ্ঠী
বিশ্বব্যাপী এদের তেমন পরিচিতি নেই৷ এরা নাইজেরিয়ার ফুলা সম্প্রদায়ের মানুষ৷ এদের লক্ষ্য ফুলানির ভূমি মালিকদের হত্যা করা৷ ২০১৫ সালে ১৫০ টি সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে ফুলানি, তাদের হামলায় মারা গেছে ১ হাজার ২২৯ জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Lieman
আল-শাবাব
বোকো হারামকে যদি আইএস-এর সাথে তুলনা করা হয়, তবে আল শাবাবকে তুলনা করা যায় আল-কায়েদার সঙ্গে৷ পূর্ব আফ্রিকায় এদের আধিপত্য অনেক বেশি৷ সোমালিয়াকে ইসলামিক রাষ্ট্র বানানোই তাদের মূল লক্ষ্য৷ গত বছর জঙ্গি গোষ্ঠীটি ৪৯৬টি হামলা চালিয়েছে, হত্যা করেছে ১ হাজার ২১ জন মানুষকে, আহত হয়েছে ৮৫০ জন৷