কে চালায় ইন্টারপোল?
২২ আগস্ট ২০১৭
একটা সময় ছিল, যখন বড় ধরনের অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া ছিল খুব সহজ৷ অপরাধীরা দেশের সীমানা পেরিয়ে গেলেই তাদের আর আটক বা গ্রেপ্তারের সুযোগ থাকতো না সেদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর৷ এই সুযোগ বেশ ভালোই কাজে লাগাচ্ছিল বিভিন্ন মাফিয়া চক্র৷
বারবার এভাবে অপরাধীদের কাছে পরাজিত হওয়ার হতাশা থেকেই চিন্তা আসে একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গড়ে তোলার৷ ১৯১৪ সালে মোনাকোতে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ জুডিশিয়াল পুলিশের প্রথম বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়৷ এই সমস্যাকে বৈশ্বিকভাবে মোকাবেলা করার ব্যাপারে বৈঠকে একমত হন অংশগ্রহণকারীরা৷ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, 'আন্তর্জাতিক অপরাধীদের দমন করা হবে আন্তর্জাতিকভাবেই৷’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এই উদ্যোগের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরিকে দীর্ঘায়িত করে৷ কিন্তু ১৯২৩ সালে সংস্থাটির দ্বিতীয় কংগ্রেসে ভিয়েনায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ কমিশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ পরবর্তীতে এই সংস্থারই নামকরণ হয় ইন্টারপোল৷
কিন্তু সংস্থাটির কোনো আইনি কাঠামো না থাকায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর এর তেমন কর্তৃত্বও ছিল না৷ শুধু গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং বিভিন্ন দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাই ছিল এর প্রধান কাজ৷
ইন্টারপোলের কাজের ধরণ
সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বা দেশগুলোর মধ্যকার রাজনৈতিক বিষয়ে যাতে ইন্টারপোল নাক না গলাতে পারে, সেজন্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতিতে বলা হয়, এই সংস্থা 'রাজনৈতিক, সেনা সম্পর্কিত, ধর্মীয় ও জাতিগত' বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে৷ মূলত জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধ, মাদক চোরাচালান, মানবপাচার, শিশু পর্নোগ্রাফি, দুর্নীতির মতো অপরাধ নিয়েই কাজ করে ইন্টারপোল৷
ইন্টারপোলের সদরদপ্তর এখন ফ্রান্সের লিওঁতে৷ সংস্থাটির বার্ষিক বাজেট প্রায় ৭৮ মিলিয়ন ইউরো বা ৭০ কোটি টাকা৷ এই বাজেটের অর্থ আসে এর ১৯০টি সদস্য রাষ্ট্রের বার্ষিক অনুদান থেকে৷ ইন্টারপোলের নিজস্ব কর্মকর্তা আছেন মাত্র সাড়ে ছয়শ'র কাছাকাছি৷ এদের সবাই বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মচারি ও পুলিশ কর্মকর্তা৷
অপব্যবহার
অপরাধীদের অপরাধ বিষয়ে বিভিন্ন দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক করতে নানা রঙের নোটিশ ব্যবহার করে থাকে ইন্টারপোল৷ সবচেয়ে বিপদজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় রেড নোটিশকে৷ রেড নোটিশকে এই সংস্থাটির আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সমতুল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ এই ব্যবস্থায় মুহূর্তের মধ্যে ১৯০ সদস্য রাষ্ট্রের পুলিশের কাছে চলে যায় অপরাধীদের অপরাধ, সর্বশেষ অবস্থান এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য৷
পালিয়ে বেড়ানো অপরাধীদের ধরতে এই ব্যবস্থা খুব কার্যকর বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও, আছে বিপরীত ঘটনাও৷ ইউরোপিয়ান কমিশন এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের অভিযোগ, নানা সময়েই বিভিন্ন স্বৈরাচারী সরকার তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে ব্যবহার করেছে ইন্টারপোলের এই রেড নোটিশ৷ ইন্টারপোলও কোনোপ্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সে নোটিশ জারি করে দেয়৷
নির্দোষ ব্যক্তিকে হয়রানিতেও অনেকবার ইন্টারপোলের রেড নোটিশ কাজে লাগানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বেসরকারি সংগঠন ‘ফেয়ার ট্রায়ালস'-এর ক্যাম্পেইন ও কমিউনিকেশন ম্যানেজার অ্যালেক্স মিক৷ ডয়চে ভেলেকে পাঠানো এক ই-মেলে তিনি বলেন, ‘‘অপরাধ দমনে ইন্টারপোলের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, গুরুতর অপরাধীদের ধরতে কাজে লাগানোর বদলে এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনেকেই রেড নোটিশকে কাজে লাগিয়েছে শরণার্থী, অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের ধরতে৷ কোনো কোনো শাসক সমালোচকদের চুপ করাতেও সুযোগের অপব্যবহার করেছেন৷''
ফলে অনেকক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অযৌক্তিক প্রমাণের আগেই তাদের মাসের পর মাস কাটাতে হয়েছে কারাগারে৷
জবাবদিহিতার অভাব
ইন্টারপোলের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো, এর কাজের তত্ত্বাবধান ও জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থাই নেই৷ বছরে একবার সাধারণ সভায় বসে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পুলিশ কর্মকর্তারা৷ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত তখনই নেয়া হয়৷ কিন্তু এছাড়া, সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানের আর কোনো ব্যবস্থাই নেই সংস্থাটিতে৷
কোনো আদালত, বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছেও ইন্টারপোলের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখা হয়নি৷ নিজের সদস্য ও কর্মকর্তাদের ছাড়া অন্য কোনো সংস্থা, এমনকি জাতিসংঘকেও কোনো তথ্য দিতে বাধ্য নয় ইন্টারপোল৷ গোপনীয়তা রক্ষার নামে সংস্থাটির কর্মকাণ্ডে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের অস্বচ্ছতা৷ ফলে সংস্থাটি যদি নিজেই নিজের নিয়ম ভঙ্গ করে, আইনের অধীনে এর প্রতিকার পাওয়ার কোনো উপায় নেই৷
এ সমস্যার সমাধানে আলোচনায় উঠে আসে ইউরোপের দেশগুলোর নিজেদের পুলিশি সংস্থা ইউরোপোলের কথা৷ ইন্টারপোলের মতো সংকট যাতে তৈরি না হয়, সেজন্য ইউরোপোলের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টকে৷ বাজেটের অনুমোদন এবং জ্যেষ্ঠ পদগুলোতে নিয়োগ দেয় এই পার্লামেন্ট৷ ইউরোপোলকে আইনি কাঠামোর মধ্যে রাখার দায়িত্ব দেয়া আছে ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিসের অধীনে৷
রব মাজ/এডিকে/এসিবি