কে নেতা কে আমলা বোঝা দায়
২৭ আগস্ট ২০২১একদিন আমাকে আমাদের চেয়ারম্যান মহোদয় (চ্যানেলের মালিক) ডাকলেন৷ গিয়ে দেখি তার টেবিলের সামনে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে৷ ৩৫ থেকে ৩৮ বছর বয়স হবে৷ আমাকে চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, ‘‘ওকে নিয়ে নিউজ রুমের কাজে লাগিয়ে দাও৷'' কী কাজে দেবো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সাংবাদিক বানিয়ে দাও৷'' তাকে নিউজ রুমে নিয়ে এলাম৷ তারপরে জানতে চাইলাম কোথায় পড়াশুনা করেছেন, আগে কী করেছেন৷ পড়াশোনার খবর আপনাদের নাইবা দিলাম৷ তার আগের কাজের সম্পর্কে বলি৷ তিনি সৌদি আরবে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন৷ চুক্তি শেষ হওয়ায় দেশে ফিরে এসেছেন৷ চেয়ারম্যান সাহেবের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন৷ এখন কী উপায়! অবশেষে এক বুদ্ধি বের করলাম৷ চেয়ারম্যান সাহেবকে গিয়ে বললাম, প্রশিক্ষণের প্রথম ধাপে তাকে ক্যামেরা স্টোরের কাজে লাগিয়ে দিই৷ সব কিছু দেখবে৷ ক্যামেরা পার্সন, সাংবাদিকদের সাথে পরিচয় হবে, ধীরে ধীরে সাংবাদিকতা বুঝবে৷ চেয়ারম্যান সাহেব রাজি হয়ে গেলেন৷ আমিও বেঁচে গেলাম৷
এরকম আরো অনেক অভিজ্ঞতা আছে আমার৷ একবার তো এক পত্রিকার মালিক পোশাক কারখানার সুপারভাইজারকে সাংবাদিক বানাতে বলেছিলেন৷ কারণ, ওই কারখানায় তাকে রাখা যাচ্ছে না৷ ঝামেলা হচ্ছে৷ আমি সাহস করে বলেছিলাম তাকে বরং ওই কারখানার এমডি বানিয়ে দেন৷ তাহলে কেউ আর তার সাথে ঝামেলা করবে না৷
এই চিত্র এখন বাংলাদেশের সব পেশাতেই কমবেশি পওয়া যাবে৷ যেমন ধরুন, প্রশাসনে ডেপুটেশন বলতে একটা কথা আছে৷ আর তার কল্যাণে দেখা যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে যারা থাকেন, তাদের সেই বিষয়ে তেমন জ্ঞান নেই৷ ফায়ার সার্ভিসের ডিজি থেকে শুরু করে বিটিভির মহাপরিচালক তদের কারুরই ওই বিষয়ে আগের কোনো অভিজ্ঞতা নেই৷ কিন্তু তারপরও তারা ওইসব বিভাগের প্রধান৷ তারাই সর্বোচ্চ ব্যক্তি৷
এগুলো তো মামুলি উদাহরণ৷ আরো বড় উদহরণ আছে৷ শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাবিদ নন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী চিকিৎসক নন, ধর্মমন্ত্রী সব ধর্ম সম্পর্কে ভালো জানেন এমন তথ্য নেই৷ আর মৎস্যমন্ত্রী হলেন আইনে বিশেষজ্ঞ৷ কিন্তু এখন সবচেয়ে আলোচিত হলো রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন না৷ আমলারা রাজনীতিতে বেজায় উৎসাহী৷ ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷
শুধু আমলা বা ব্যবসায়ী কেন? শিক্ষক, সাংবাদিক, সমাজ সেবক সবাই রাজনীতিবিদ৷ রিজেন্ট সাহেদ থেকে শুরু করে হেলেনা জাহাঙ্গীর কাউকেই রাজনীতি থেকে দূরে রাখা যায়নি৷ তাদের কেউ কেউ আবার শখের রাজনৈতিক নেতা৷
আমলারা সরকারি চাকরিতে থাকতেই রাজনীতি শুরু করেন৷ এলাকায় যান৷ সভা-সমিতিতে বক্তৃতা করেন৷ ক্লাব , মসজিদ তৈরি করেন আর অবসরের পর নেমে যান রাজনীতিতে৷ তাদের কাছে রাজনীতি হলো অবসরে নতুনভাবে ক্ষমতায় থাকা৷
জাতীয় সংসদেও এখন রাজনীতিবিদরা কোণঠাসা৷ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন-এর দেয়া তথ্য মতে বর্তমান জাতীয় সংসদের ১৮২ জন এমপিই হলেন ব্যবসায়ী, যা মোট সংসদ সদস্যের শতকরা ৬১.৪ ভাগ৷ আইনজীবী শতকরা ১৩ ভাগ, চিকিৎসক, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশাজীবী আট ভাগ, কৃষিতে জড়িত চার ভাগ এবং অন্যান্য পেশায় জড়িত সাত ভাগ৷ রাজনীতিই পেশা এমন সংসদ সদস্য আছেন শতকরা মাত্র চার ভাগ৷
এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট যে, রাজনীতিবিদরা শুধু কোণঠাসা নয়, বিলুপ্ত প্রায়৷ আর সংসদে যারা ব্যবসায়ী আছেন, তাদের মধ্যে মাছ, মুরগির খামারিও আছেন৷ বাণিজ্যমন্ত্রী দেশের বড় ব্যবসায়ী৷ খাদ্যমন্ত্রীর নিজের চালের ব্যবসা আছে৷ তাহলে দেশের মানুষের ব্যবসা কে দেখবে?
আরেকটি কথা বলি রাজনীতির বাইরে৷ তা হলো দুদক৷ দুদকের চেয়ারম্যানসহ কমিশনাররা সবাই সাবেক আমলা৷ এটা আমলাতন্ত্রের একটি এক্সটেনশনে পরিণত হয়েছে৷ আমার মনে হয় সে কারণেই আমলাদের দুর্নীতি হয়তো তারা বুঝতে পারছেন না৷ দেখতে পান না৷
দেখা যাচ্ছে যার সেখানে থাকার কথা, সে সেখানে নেই৷ এটা এখন বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ তারা মানুষের কল্যাণে মুক্ত চিন্তা না করে যার যার দলের চিন্তা করেন৷ দলীয় উন্নয়ন ও চিন্তায় ব্যাপক ভূমিকা রাখেন৷ এখন কেউই আর সাধারণের জন্য নন৷ শিক্ষক দলীয় নেতা-কর্মীদের কল্যাণে নিবেদিত৷ সাংবাদিক নিবেদিত নিজের উন্নয়নে৷ ফলে এখন তারা বিভিন্ন সরকারি কমিটির সদস্য, যেখানে থাকার কথা ছিল ওই বিষয়ে বিষেজ্ঞদের৷
সমস্যা নেই! এখন আমরা সবাই সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ৷ টেলিভিশনের টকশো দেখলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে৷ চিকিৎসক বলছেন রাজনীতি নিয়ে, রাজনীতিবিদ বলছেন সাংবাদিকতা নিয়ে, পোশাক ব্যবসায়ী বলছেন রকেট সায়েন্স নিয়ে৷ ভালো তো! ভালো না! এমন বিশেষজ্ঞের দেশ আপনি আর কোথাও খুঁজে পাবেন?