কোটায় যারা আসে তারাও কিন্তু মেধাবী: সাবেক পিএসসি চেয়ারম্যান
১২ জুলাই ২০২৪কোটার নানা দিক নিয়ে নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন ২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এ টি এম আহমেদুল হক চৌধুরী৷
ডয়চে ভেলে : আপনি যখন পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন তখন তো কোটা ছিল। তখন কি ধরনের ছেলে মেয়েদের পেয়েছেন?
এ টি এম আহমেদুল হক চৌধুরী : আমি যখন চেয়ারম্যান ছিলাম তখন দেখেছি, যার কোটায় আসে, আর যারা মেধায় আসে তাদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য থাকে না। এই ধরেন যে মেধায় ফার্স্ট হয়েছে সে ৭০০ নম্বর পেয়েছে। আর যে কোটায় এসেছে সে ৬৩০ বা ৬৪০ পেয়েছে। এরাও কিন্তু মেধাবী। কিন্তু একটু পিছিয়ে থাকা। কোটায় যারা আসে তারাও কিন্তু সব ধরনের পরীক্ষা দিয়েই আসে।
আপনি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় যাদের নিয়োগ দিয়েছেন, তাদের মেধায় কি সন্তুষ্ট ছিলেন?
পাবলিক সার্ভিস কমিশন তো নিয়োগ দেয় না, সুপারিশ করে। তখন আমরা কোটায় যাদের সুপারিশ করেছি, কার্যক্ষেত্রে তো এখন তাদের দেখি কম যোগ্যতা দেখাচ্ছে না। তারাও ভালো করছে। আমি কিন্তু তাদের মেধায় সন্তুষ্ট ছিলাম। যাদের কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করেছি তারাও মেধাবী, আর যোগ্যতায় যারা এসেছে তারাও মেধাবী। যারা কোটায় এসেছে তারা হয়ত একটু পেছনে ছিল। নম্বর হয়ত একটু কম পেয়েছে। আমি দেখেছি, যারা মেধায় চাকরি পেয়েছে আর যারা কোটায় চাকরি পেয়েছে তাদের সবার মার্ক কিন্তু ৫০ এর মধ্যেই ছিল। আমি তাদের মেধায় সন্তুষ্ট ছিলাম।
২০১৮ সাল থেকে তো কোটা নেই, কোটা না থাকায় এই বছরগুলোতে কারা বঞ্চিত হয়েছে?
বঞ্চিত যদি বলেন, তাহলে সত্যিকার অর্থে বঞ্চিত হয়েছে আদিবাসীরা। বঞ্চিত হয়েছে যারা শারীরিকভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন তারা। আর বঞ্চিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের তো এখন কারও চাকরির বয়স নেই। আর মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম ধরলে তাদের আমি বঞ্চিত মনে করব না। এটা নিয়ে একটা বিতর্কও থাকতে পারে।
এখন তো কোটার বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে। তারপরও কোটা না থাকলে ভালো হবে, নাকি খারাপ হবে?
এখনও তো আদালত থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। আপিল বিভাগ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এলে বোঝা যাবে। এখন আদালত যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সেটা তো সাময়িক সময়ের জন্য। এটা হয়ত খুব বেশি দিন চলবে না। ওই যে, যাদের কথা বলছিলাম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এবং সত্যিকার অর্থে পিছিয়ে পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আরেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো নারীরা। তাদের যে ১০ শতাংশ ছিল, তার ফলে বেশ এগিয়ে আসছিল নারী সমাজ। এই কোটার কারণেই কিন্তু সরকারি চাকরিতে আমরা নারীদের বেশ দেখতে পাচ্ছিলাম। এরাও কিন্তু বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আমরা গত ১০টা বিসিএস অর্থাৎ কোটা উঠে যাওয়ার আগের ৫টা এবং পরের ৫টা পর্যালোচনা করে দেখেছি, নারীদের অংশগ্রহণ একই মাত্রায় আছে। আগেও ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ ছিল। এখনও তাই আছে। তাহলে কি নারী কোটার প্রয়োজনীয়তা আছে?
আমাদের তো ৫০ শতাংশ নারী। পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও কম থাকে না। সে হিসেবে তো ২৫ বা ৩০ না নারীদের অংশগ্রহণ তো ৫০ শতাংশ হওয়া উচিত। কোটা থাকলে এই সংখ্যাটা আরও বাড়ত। এখনও কিন্তু আমাদের নারীদের বিরাট একটা অংশ গ্রাম থেকে উঠে আসছে। কোটা থাকলে সরকারি চাকরিতে তাদের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে।
শিক্ষামন্ত্রী বলছিলেন, জেলা কোটা না থাকার কারণে অনেক জেলার মানুষ বাদ পড়ে যাচ্ছেন। জেলা থেকে ন্যূনতম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কি জেলা কোটার প্রয়োজনীয়তা আছে?
আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, সেই আলোকে বলছি, এখন আর জেলা কোটার প্রয়োজন নেই। সুযোগ থাকার পরও সিলেট থেকে তেমন কেউ অংশগ্রহণ করে না। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সিলেট বিভাগের খুব কম সংখ্যক মানুষ পরীক্ষা দেয়। অথচ তাদের প্রচুর সুযোগ আছে। তারপরও তারা অংশ নেয় কম। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলের কিছু জেলার মানুষ এখন কিন্তু প্রচুর অংশগ্রহণ করছে। আগে কতগুলো অসুবিধা ছিল। সেখানে ঢাকায় এসে ফরম ফিলাপ করা, পরীক্ষা দিতে আসা কঠিন ছিল। এখন সবকিছু অনলাইন হয়ে গেছে। পরীক্ষাও দেশের বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে। এখন আর জেলাকে আলাদাভাবে চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা নেই।
সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে যেসব জেলার মানুষ কম অগ্রসর, তাদের অংশগ্রহণও কম থাকে। তারা কোন কোন ক্ষেত্রে বাদ পড়ে যাচ্ছে। তাদের ন্যূনতম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য জেলা কোটার প্রয়োজন। আপনি কি মনে করেন?
আমি সেটা মনে করি না। কারণ দেখেন, ঢাকাতে যারা বসবাস করে তারা কি সবাই ঢাকার আদি বাসিন্দা? না। সারা দেশ থেকে এসেই ঢাকার বাসিন্দা হয়েছে। রংপুর, দিনাজপুর থেকেও তারা এসেছে। ঢাকার আদি বাসিন্দা কতজন চাকরি পাচ্ছেন? এখন আপনি যদি জেলা নিশ্চিত করতে চান তাহলে আপনাকে উপজেলায় যেতে হবে। কারণ অনেক উপজেলার মানুষ চাকরি পাই না। ওভাবে চিন্তা করলে তাদেরও তো আনতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী একদিন আগে বলেছেন কোটা না থাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোন কোন বিসিএসে তাদের অংশগ্রহণ একেবারেই নেই। তাদের জন্য কি কোটার প্রয়োজনীয়তা আছে?
অবশ্যই তাদের জন্য প্রয়োজনীয়তা আছে। কোটা সারা পৃথিবীতে আছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা বা সুযোগ সুবিধা রাখতে হবে সেটা তো আমাদের সংবিধানেও আছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সুযোগ সুবিধা রাখার কথা সংবিধানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। এটা কোটার মাধ্যমে হোক আর অন্য যে কোনভাবেই হোক তাদের সমাজের মূল ধারার সঙ্গে আনতে সুবিধা দিতেই হবে। আর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে যেটা হয়েছে, সেটা কিন্তু পিছিয়ে পড়ার কারণে নয়। তাদেরটা এসেছে চেতনা থেকে।
এখন তো কোটার পক্ষে-বিপক্ষে দু'টো পক্ষ দাঁড়িয়েছে। আপনি কি মনে করেন, কোটা কতটুকু থাকা উচিত বা উচিত না?
কোটা থাকা উচিত। তবে এটা সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হতে পারে। এর বেশি না। আর মুক্তিযোদ্ধা কোটা যেটা, সেটাতে কিন্তু ঝুঁকি আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করবে কিনা, সেটাও প্রশ্ন। অনেকে তো মনে করতে পারে পাকিস্তানই ভালো ছিল। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা তো থাকছে না। আরেকটা সমস্যা হলো, তৃতীয় প্রজন্মে এসে মেয়েদের বিয়ে হয়ে তো অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের দিকের নাতি কে সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও কিন্তু কঠিন। জটিল বিষয় হবে এটা। এতে অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত হওয়ার সুযোগ থাকবে। আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কিভাবে চিনি? আমরা যে ডকুমেন্ট নেই, সেখানে বাবার নাম থাকে। সার্টিফিকেটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সন্তানের সন্তানের ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতা হয়। মুক্তিযোদ্ধার তৃতীয় প্রজন্ম রাখতে পারেন, সেক্ষেত্রে যিনি অক্ষম, খুবই গরীব, অসহায় তাদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে। এর বেশি হওয়া উচিত না।