আশির দশকে এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেন বুকে-পিঠে লিখেছিলেন, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক'৷ হালের কোটাবিরোধী আন্দোলনেও একই আদলে কেউ কেউ বুকে-পিঠে লিখছেন, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক'৷
বিজ্ঞাপন
জনপ্রিয় এই স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠছে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরও৷ এমন দাবির মুখে মেধাবীরা যদি মুক্তি পেয়ে যায়, তবেই কী মুক্তি পাবে দেশ?
বাংলাদেশ তো সেই কবে থেকে ঘুস-দুর্নীতি-অসততার শৃঙ্খলে বন্দি৷ এর জন্য কতটা দায়ী মেধাবীরা? আর কতটা অমেধাবীরা? পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি সংসদের এক ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর উত্তর কিন্তু অনেকটাই রেখে গিয়েছিলেন৷ সেদিন জাতীয় সংসদে তিনি বলেছিলেন, ‘‘করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না৷ করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ, যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি৷ আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন৷''
কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলনের পর এক পরিপত্রে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে সরকার৷ ৫ জুন এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করে উচ্চ আদালত৷ এরপর আবারও শুরু হয়েছে আন্দোলন৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
পদযাত্রা ও অবস্থান কর্মসূচি
২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল, রোববার৷ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে পদযাত্রাসহ নানা কমর্সূচি পালন করে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’৷ পদযাত্রা কর্মসূচি শেষে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা৷
ছবি: bdnews24.com
দিনব্যাপী বিক্ষোভ
ওইদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চলতে থাকে৷ এ সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের বেশ কয়েকবার উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও শিক্ষার্থীরা অনড় থাকে৷
ছবি: bdnews24.com
পুলিশের অ্যাকশন
রাত ৮টার দিকে লাঠিপেটা ও রাবার বুলেট-কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে অবরোধকারীদের উঠিয়ে দেয় পুলিশ৷ অবরোধকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দিকে পিছু হটলে তাদের উপর ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর চড়াও হওয়ার অভিযোগ ওঠে৷
ছবি: bdnews24.com
সংঘাত
শাহবাগ ছাড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন এলাকায় রাতে খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ চলে; পুলিশও তাদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে৷ দু’পক্ষের সংঘাত ছড়িয়ে পরে৷
ছবি: bdnews24.com
উপাচার্যের বাড়িতে ভাংচুর
গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে ভাঙচুর হয়৷ বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুরের পাশাপাশি দুটি গাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়৷ ভাংচুর শুরুর আগে সব সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
উপাচার্যের অভিযোগ
তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান৷ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তার প্রাণনাশের জন্যই বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে৷ তিনি আরো বলেন, এমন হামলা সাধারণ ছাত্ররা চালাতে পারে তার কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়৷
ছবি: bdnews24.com
সমঝোতা
২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল ওই সময়ের সড়ক যোগাযোগন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সরকারের একটি প্রতিনিধি দল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন৷ মীমাংসাও হয়৷ ফলে আলোচনায় অংশ নেয়া নেতারা আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন৷ তবে আন্দোলনকারীদের একাংশ আন্দোলনে থেকে সরে আসেনি৷
ছবি: bdnews24
নারী অংশগ্রহণ
সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ নারী কোটা থাকলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রচুর নারী অংশ নেন৷
ছবি: bdnews24
স্থবিরতা
ঢাকা তো বটেই পুরো দেশের অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানই একে একে অচল হয়ে পড়ে৷ রাস্তা বন্ধ করে শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ের আন্দোলন শুরু করেন৷
ছবি: bdnews24.com
প্রত্যাখ্যান ও প্রতিবাদ
দেশব্যাপী আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে যায়৷ আন্দোলনরতরা ছাত্রলীগের একাংশের নির্যাতন এবং সরকারের দুই মন্ত্রীর ‘আপত্তিকর’ বক্তব্যের প্রতিবাদে সমাবেশ ও প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে৷
ছবি: bdnews24.com
অপেক্ষা
কোটা বৈষম্যের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য দাবি করে আন্দোলনকারীরা৷ ১১ এপ্রিল বিকালে প্রধানমন্ত্রী সংসদে এ বিষয়ে কথা বলছেন জানালে শুরু হয় অপেক্ষার প্রহর৷
ছবি: bdnews24.com
অবশেষে অপেক্ষার অবসান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে সব কোটা তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিলে আন্দোলনকারীরা তার এবং বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে আনন্দ মিছিল করে৷
ছবি: bdnews24.com
উচ্চ আদালতের রায়
২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন৷ রিটের শুনানিতে ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়৷ এ বছরের ৫ জুন সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট৷ সেই রায় ১১ জুলাই প্রকাশিত হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আবারও আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা
উচ্চ আদালতের রায়ের পর তারা কোটা সংস্কার দাবিতে আবারো রাজপথে নেমেছে শিক্ষার্থীরা৷ সরকারি চাকরির সব পদে কোটা সংস্কারের দাবি করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা৷ তারা মনে করছেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়৷
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে স্থিতাবস্থা দিয়েছে আপিল বিভাগ৷ ১০ জুলাই প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ সিদ্ধান্ত দেয়৷ চার সপ্তাহ পর এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে৷ এ সময়কালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে সরকারের দেয়া পরিপত্র বহাল থাকবে৷
ছবি: Suvra Kanti Das/ABACAPRESS/IMAGO
আন্দোলনের সবশেষ অবস্থা
শিক্ষার্থীদের অবরোধে ১০ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে কার্যত অচল হয়ে পড়ে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ৷ সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্লকেড চলে৷ সারা দেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ঢাকা৷ দাবি আদায়ে ১১ জুলাই আবারও সারা দেশে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা৷
ছবি: Habibur Rahman/aal.photo/IMAGO
বাংলা ব্লকেড
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনের নাম দিয়েছে ‘বাংলা ব্লকেড’৷ এই কর্মসূচিতে শুরুতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোর অংশগ্রহণ ছিল৷ ধীরে ধীরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন৷
ছবি: Suvra Kanti/IMAGO/ABACAPRESS
17 ছবি1 | 17
কিন্তু এখনো যে কাগুজে মেধাবীরাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক হিসেবে চাকরি পাচ্ছেন, এটা নিশ্চিত৷ নয়-ছয় হলে শুধু বড় জোর রোল একের বদলে চার নম্বরে থাকা ব্যক্তিটি চাকরি পান৷ আর যারা ধাপে ধাপে উন্নতির শিখরে গিয়ে উপাচার্য হন, তারা মেধা-মননে যে অনেক এগিয়ে তা স্বীকার করতেই হবে৷ অথচ বছরজুড়ে উপাচার্যদের অনিয়ম-অনাচারের খবর আসতেই থাকে৷ কেউ উত্তরবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়ে দিনের পর দিন ঢাকায় কাটান৷ কেউবা অবসরে যাওয়ার আগেভাগে স্বজনদের নিয়োগ দিয়ে যান নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ ‘এমন মেধাবী লইয়া' আমরা তাহলে কী করবো?
কোটা নিপাতের জন্য যে বাংলা ব্লকেড করা হলো৷রাস্তাঘাট অচল করে দেওয়া হলো, যে কারণে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হলো আমজনতাকে৷ সেখানে আন্দোলনকারীরা সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে প্রচারপত্রে লিখেছেন: ‘রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে/ সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত৷' কোটার সংস্কার হলেই কী রাষ্ট্রের ভেতরে সংস্কার ঘটে যাবে?
প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা দুর্নীতির দায় শুধুই কোটাধারীদের কাঁধে চাপাতে হবে? আমাদের যেসব চিকিৎসক সরকারি দায়িত্বে ফাঁকি দেন, তারা কী মেধাবী নন? যে ভূমি কর্মকর্তা গুনে গুণে ঘুষ নেন, তিনি কোটার মারফতই এসেছেন চাকরিতে, সেটা কী নিশ্চিত? মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা ভোগ করতে যিনি ভুয়া সনদ নিয়েছেন, তার বেলায়ই-বা কী বলবো আমরা?
তবে কোটার সুযোগ নেওয়া ব্যক্তিটিকেও কিন্তু চাকরি পরীক্ষার প্রথম কয়েক ধাপ পাস করেই আসতে হয়৷ এই অর্থে তিনিও মেধাবী৷ কিন্তু যাদের হাতে পরীক্ষার আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র চলে আসে, তাদের কোটা থাকা, না থাকায় কিছু যায় আসে না৷ তারা আটঘাট বেঁধেই নামেন৷ টাকার বিনিময়ে চাকরি নিবেন, ঘুষ আদায় করে তার কয়েক গুণ বেশি আদায় করে নেবে৷ এমনি হয়ে থাকে তাদের পণ৷
তাই কোটার বিলোপেই কল্যাণ এক রাষ্ট্র হয়ে যাবে বাংলাদেশ, এমনটা মনে করবার কোনো কারণই নেই৷ যেখানে ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা', সেখানে তা পুরোপুরি সারাইয়ে প্রতিটি জায়গায়ই হাত দিতে হবে৷ স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে সবকিছুতেই৷ তখন এমনিতেই মেধাবীদের বঞ্চনাবোধ মিলিয়ে যাবে৷ কোটাবিরোধী হতে হবে না কাউকেই৷ তাই আমাদের মূল স্লোগান হওয়া উচিৎ: ‘দুর্নীতি নিপাত যাক, সততা মুক্তি পাক'৷