মাটির নীচে সবচেয়ে মহামূল্য যে বস্তুটি থাকে, তা হলো পানি৷ সমস্যা হলো: সে পানির খোঁজ পাওয়া যাবে কি করে? বিজ্ঞানীরা সোনোগ্রাম থেকে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ, সব কিছুই ব্যবহার করে দেখছেন৷
বিজ্ঞাপন
উর্বর কৃষিক্ষেত্র, চারণভূমি, মুক্ত প্রান্তর৷ তবে যে অমূল্য সম্পদটি রাখা আছে মাটির নীচে, সেটি হলো পানি৷ ভূতত্ত্ববিদরা ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে মাটির তলায় জলের খোঁজ চালাচ্ছেন৷ এক্ষেত্রে তাঁদের সহায় হল তথাকথিত সিসমিক্স৷ এই প্রক্রিয়ায় মাটির তলায় শব্দতরঙ্গ পাঠিয়ে একটির পর একটি স্তর পরখ করে দেখা হয়৷
পানির খোঁজ শুরু হবার আগে গোটা এলাকাটা ছক কেটে মেপে নেওয়া হয়৷ নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করে তার আর মাপার যন্ত্রগুলো জমির বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়৷ ২০ টন ওজনের ভিব্রোট্রাকগুলি ভাইব্রেশন, অর্থাৎ কম্পনের মাধ্যমে শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি করে৷ মাটির তলার স্তরগুলিতে ধাক্কা খেয়ে সেই কম্পন আবার ফিরে আসে – গবেষকরা যা থেকে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য পান৷ ইঞ্জিনিয়ার ব্যার্ন্ড হিল্ডেব্রান্ড জানালেন, ‘‘আমাদের কাজ করার ধরনটা অনেকটা ডাক্তারের সোনোগ্রাম করার মতো৷ এখানেও শব্দতরঙ্গ পাঠিয়ে, তার প্রতিধ্বনি ধরা হয়৷ তারপর সেই ডাটা একটি দ্বিমাত্রিক কিংবা ত্রিমাত্রিক ছবিতে পরিণত করা হয়৷''
একটি কনটেইনারে বসে শব্দতরঙ্গগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়৷ ডাটা থেকে গবেষকরা দেখতে পান, পাথরের মধ্যে কোথায় পানি আছে৷ মডেলটা সম্পূর্ণ হবার পর দেখা যায়, মাটির চার হাজার মিটার নীচে যে সব পাথরের স্তর রয়েছে, সেই সব স্তরের মাঝে মাঝে পানিও রয়েছে৷
জলপরি নয়, এরা হলো ‘জলপত্নী’
ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের বেশ কয়েকটি প্রত্যন্ত গ্রামে পুরুষরা শুধুমাত্র পানি এনে দেওয়ার জন্য বহুবিবাহ করেন! দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্ত্রীর কাজ বাড়িতে যথেষ্ট পরিমাণ পানির ব্যবস্থা করা৷ এরাই হলো ‘ওয়াটার ওয়াইফ’ বা ‘জলপত্নী’৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
একজন পুরুষের তিনজন স্ত্রী
৬৬ বছর বয়সি সাখারাম ভাগতের এখন মোট তিনজন স্ত্রী৷ ওঁদের একজনের নাম সাখরি, পরের জন টুকি এবং তৃতীয় বউ ভাগি৷ ‘‘আমার প্রথম স্ত্রীকে সন্তানদের দেখাশোনা করতে হয়, তাই পানি আনার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করি৷ কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী যখন অসুস্থ হয়ে যায়, তখন পানি আনতে ভীষণ সমস্যা হতো৷ তাই তৃতীয়বার বিয়ে করি আমি’’, বলেন শাখারাম৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
‘ওয়াটার ওয়াইফ’-এর সম্মান
ছবিতে ভাগত তাঁর দুই স্ত্রী ভাগি এবং সাখরিকে নিয়ে পানি আনতে যাচ্ছেন৷ এর জন্য তাঁদের গ্রাম ছাড়িয়ে অনেকটা পথ যেতে হয়৷ সংসারের প্রয়োজনে যাঁরা এতদূর থেকে পানি বয়ে আনেন, তাঁদের, অর্থাৎ এই ‘ওয়াটার ওয়াইফ’ বা ‘জলপত্নী’-দের গ্রামের মানুষরা কিন্তু খুবই সম্মানের চোখে দেখেন৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ
ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম ফেডারেল রাজ্য ‘মহারাষ্ট্রের’ এমনই একটি গ্রামর চিত্র এটি৷ কুয়ার সামনে স্থানীয় এক ‘জলপত্নী’ পানির পাত্র আর কলসিগুলোতো একে একে পানি ঢালছেন৷ সরকারি হিসেব অনুযায়ী, গত বছর ভারতের প্রায় ১৯ হাজার গ্রামে খাবার পানি ছিল না৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
বাঁচার জন্য পানি সঞ্চয়
মহারাষ্ট্রে খরা নতুন কিছু নয়৷ শেষবারের খরার সময় সাখারাম ভাগতের পরিবার জলকষ্টে ভীষণভাবে ভুগেছে৷ তাই আর জলের কষ্ট নয়! পিতলের কলসিগুলোতে আজকাল সব সময়েই যথেষ্ট পরিমাণে পানি ভরে রাখছে ওরা, যাতে আর ভোগান্তি না হয়৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
ভারতে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ
ভারতে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যন্ত এ সমস্ত গ্রামে ‘ওয়াটার ওয়াইফ’-এর রীতি বেড়ে চলেছে৷ তবে বেশিরভাগ সময়ই যেসব পুরুষ শুধু পানি আনার জন্য বিয়ে করেন, তাঁরা ‘জলপত্নী’-দের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো এক বিছানায় ঘুমান না৷ ঠিক সেরকমই একটি পরিবারের কর্তা নামদেব৷ তাঁর দুই স্ত্রী শিবারতি (বামে) এবং বাগাবাই৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
মাথায় পানি, কোলে নাতি
নামদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী শিবারতি অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাথায় পানি বহন করে ফিরে যাচ্ছেন গ্রামে৷ কোলে নাতিটিকেও সঙ্গে নিতে হয়েছে তাঁর৷ ‘ওয়াটার ওয়াইফ’ বা ‘জলপত্নী’-দের জীবন এরকমই৷ তাঁরা এক হয় বিধবা অথবা একক মা৷ আগের পক্ষের সন্তান বা নাতি-নাতনিকে বড় করে তোলার জন্য অনেকক্ষেত্রে একাই অভিভাবকের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে হয় তাঁদের৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
সাদা-কালো স্মৃতি চিহ্ন
নামদেবের প্রথম স্ত্রী বাগাবাই৷ তাঁর ঘরের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের পুরনো আমলের সাদা-কালো একটি ছবি৷ দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্ত্রীর মর্যাদা যে প্রথম স্ত্রীর সমান নয়, দেয়ালের ঠিক মাঝখানে টাঙানো ছবিটি সেটাই বলে দিচ্ছে৷ তারপরও স্বামীকে একেবারে নিজের বলার উপায় আছে কি?
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
7 ছবি1 | 7
মহার্ঘ পানীয়
ভূতত্ত্ববিদ প্রফেসর টোমাস হিমেল্সবাখ জানালেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা পৃথিবীতে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে৷ এর ফলে লবণাক্ত পানি ক্রমেই ভূখণ্ডের ভিতরে ঢুকে আসছে, যার ফলে আমাদের খাবার জল আর মাটির নীচের পানি প্রভাবিত হচ্ছে৷'' লবণাক্ত পানি থেকে মহার্ঘ পানীয় জল আলাদা করার জন্য বিজ্ঞানীদের আকাশে উঠতে হয়৷ হেলিকপ্টারে লাগানো একটি প্রোব থেকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ পাঠিয়ে জমির কন্ডাক্টিভিটি মাপা হয়৷ ভূতত্ত্ববিদরা এভাবে দেখতে পান, মাটির নীচে কোন ধরনের পানি রয়েছে, লবণাক্ত না বিশুদ্ধ, পানযোগ্য৷ এ থেকে বিশেষ করে সাগরের পানি ঢুকে লবণাক্তকরণের হদিশ পাওয়া যায়৷ পদ্ধতিটি বিশ্বের যে কোনো জায়গায় কাজে লাগানো যায়৷
পরীক্ষাগারে গবেষকরা সিমুলেশন করে দেখেন, মিষ্ট ও লবণাক্ত পানি কিভাবে মাটির নীচে প্রবাহিত হয়৷ দু'ধরনের পানিতে দু'ধরনের রং দেওয়া হয়৷ এই রং থেকে ভূতত্ত্ববিদরা বুঝতে পারেন, মাটির নীচে সাদাজল আর নোনাজল কিভাবে মিশে যায়৷ এটা জানা থাকলে মাটির নীচ থেকে পানীয় জল তোলার সময় খেয়াল রাখা যায় যে, তা-তে যেন কোনো সাগরের পানি মিশে না যায়৷ বিশেষ করে বিশ্বের শুষ্ক অঞ্চলগুলিতে তা জানা খুব জরুরি৷
সম্প্রতি ভূতত্ববিদরা নামিবিয়ায় মাটির নীচে এক সুবিশাল হ্রদের খোঁজ পেয়েছেন৷ সেই পানীয় জল যদি তোলা যায়, তাহলে নামিবিয়ার ৪০ শতাংশ মানুষের ৪০০ বছরের পানির প্রয়োজন মিটবে৷
ভারতে ভয়ানক খরা, পানির জন্য হাহাকার
গত কয়েক বছর কম বৃষ্টি হওয়ায় আবার ভয়াবহ খরা দেখা দিয়েছে ভারতে৷ খরায় আক্রান্ত প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ৷ পানির জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে ছুটছে মানুষ৷ গবাদি-পশু মরছে তৃষ্ণায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Seelam
পানির জন্য ঘর ছাড়ছে মানুষ
প্রচণ্ড খরায় বিপর্যয় নেমে এসেছে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে৷ অনাবৃষ্টিতে তপ্ত হয়ে উঠেছে প্রকৃতি৷ অনেক গ্রামে পানীয় জলের অভাবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং শিশুদের গ্রামের বাড়িতে রেখে শহরের দিকে ছুটছে প্রাপ্তবয়স্ক কর্মক্ষম মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Panthaky
পানির মহাসংকট
খরায় যে রাজ্যগুলো সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত মহারাষ্ট্র তাদের অন্যতম৷ পানি সংকটের কারণে কৃষিকাজেও ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক৷ ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে রাজ্যের এক হাজারেরও বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন৷ পানির অভাবে অনেক গবাদি পশুও মারা গেছে৷ এছাড়া কর্ণাটক রাজ্যের পরিস্থিতিও ভয়াবহ৷ ওপরের ছবিতে তেলেঙ্গানার খরায় আক্রান্ত এক কৃষক৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Seelam
দূষিত পানি পান
কোলের শিশুর বুক ফেটে যাচ্ছে তেষ্টায়৷ মা পানি পেয়েছেন৷ কিন্তু সেই পানিতে অনেক ময়লা৷ শাড়ির আঁচলে ময়লা ছেঁকে সন্তানের মুখে ঢালছেন মা৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Kanojia
কুয়োতেও পানি নেই
কুয়ো থেকে পানি তোলার আপ্রাণ চেষ্টা৷ খরায় পানি নেমে গেছে অনেক নীচে৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Seelam
কাদা মেখে একটু আরাম
নদীর পানি গরম৷ তাই কাদা তুলে সেই কাদা গায়ে মেখে শুয়ে আছে ওরা৷
ছবি: Reuters/J. Dey
গবাদি পশু বাঁচানো দায়
মানুষই পানি পায় না, গরুর তেষ্টা মেটাবে কে! ওপরের ছবিতে পানির তৃষ্ণায় জ্ঞান হারিয়েছে একটি গরু৷ গরুটির জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে এক কৃষক৷
ছবি: Getty Images/AFP/NJ. Kanojia
সুযোগের সদ্ব্যবহার
রাস্তার পাশের পানির পাইপ ফুটো হয়েছে৷ সেই ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসছে পানি৷ পাশের গ্রাম থেকে মেয়েরা ছুটে এসেছে পানি নিতে৷