নাৎসি বিভীষিকার প্রতীক হচ্ছে আউশভিৎস৷ সেই কুখ্যাত বন্দিশিবির থেকে যাঁরা প্রাণে বেঁচেছেন, তাঁদের সঙ্গে শেষবারের মতো একটি স্মারক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করাকে বিরাট এক সুযোগ বলে মনে করেন ক্রিস্টফ স্ট্রাক৷
বিজ্ঞাপন
একটি বিভীষিকাময় স্থান: আউশভিৎস৷ মানুষ যে কতটা অমানুষিক হতে পারে, জার্মানরা যে বিভিন্ন দেশের মানুষদের কী পরিমাণ কষ্ট দিয়েছে, আউশভিৎস-এ এসে সে কথা ভাবলে নীরব হয়ে যেতে হয়৷
আউশভিৎস থেকে যাঁরা প্রাণে বেঁচেছেন, তাঁদের অনেকেই আর কখনো এখানে ফিরে আসেননি৷ জিন আমেরি, টাডেউস বোরোভস্কি, প্রিমো লেভি, এঁদের কেউই তাঁদের নিজেদের বেঁচে থাকাটাকে ক্ষমা করতে পারেননি এবং আউশভিৎস মুক্ত হবার বহু বছর কিংবা দশক পরেও আত্মহত্যা করেছেন৷ সে বিভীষিকার কোনো শেষ নেই, মুক্তি নেই৷ থেকে গেছে স্মৃতি ও বেদনা৷ বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আসছেন এখানে, যাঁরা শিশুবয়সে বাবা-মা, ভাইবোনকে হারিয়েছেন এবং এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যাননি, কখন সেই প্রিয়জনের হাত ছেড়ে দিতে হয়েছে৷
শেষবারের মতো
এই মঙ্গলবারেও আউশভিৎস-বির্কেনাউ-এর শত শত সাবেক বন্দি, যারা প্রাণে বেঁচেছেন, তাঁরা আবার সেই বিভীষিকার স্থলে ফিরেছেন – এদের অধিকাংশই ইহুদি, সেই সঙ্গে প্রায় একশো পোলিশ বন্দিও ফিরেছেন৷ শেষবারের মতো ‘‘কালের সাক্ষীরা'' এমন বিপুল সংখ্যায় এখানে সমবেত হয়েছেন৷ আমাদের উচিত, তাঁদের কাহিনি শোনা, যতোদিন পর্যন্ত সে কাহিনি না স্তব্ধ হয়ে যায়৷ তারপর সেই কাহিনি থাকবে আমাদের দায়িত্বে৷
আউশভিৎস-এর মুক্তিদিবসকে নাৎসি অপশাসনের শিকারদের স্মারক দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে জার্মানদের ৫০ বছর সময় লেগে গেছে৷ এবার সংসদে আউশভিৎস-এর কোনো সাবেক বন্দি নন, বরং জার্মান প্রেসিডেন্ট স্বয়ং বক্তব্য রাখবেন৷ এই স্মারক সভা কি সফল হবে? জার্মানরা কি সত্যিই তাদের চিরন্তনী দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন? একটি সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী ৮১ শতাংশ জার্মান ইহুদি নিপীড়নের ইতিহাসকে ‘‘পিছনে ফেলে দিতে'' চান৷ অপরদিকে জার্মানিতে যে সব নাৎসি বন্দিশিবিরের অবশেষ বর্তমান, সেখানে দর্শকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷ গত বছর ১৫ লক্ষ মানুষ আউশভিৎস-বির্কেনাউ-তে আসেন, যা কিনা একটা রেকর্ড৷ এর অর্থ: হলোকস্টের স্মৃতি আজও জাগরূক, কিন্তু তা আর স্বভাবসিদ্ধ নয়৷ আজও জার্মানিতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা যে কোনো না কোনো সময় একটি না একটি নাৎসি বন্দিশিবির পরিদর্শন করবে, সেটা স্বভাবসিদ্ধ নয়৷ কেন নয়?
সজাগ থাকো, শুধু ভঙ্গিমায়আটকে থেকো না
বিভিন্ন দক্ষিণপন্থি আন্দোলন, নতুন ধরনের প্রতিবাদ, ইন্টারনেটে অবলীলাক্রমে বহিরাগত-বিদ্বেষ কিংবা জাতিবাদী আক্রোশ প্রচার করা, প্রকাশ্য মঞ্চে মাইক-এর সামনেও – এ সব থেকে আজ বোঝা যাচ্ছে, নাৎসি নিপীড়নের সেই বিপর্যয়মূলক স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখাটা ঠিক কতোটা প্রয়োজন৷ শুধু বন্দিশিবিরে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই নয়, বরং আমাদের নিজেদের সমাজব্যবস্থার প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে, কেননা সেই সমাজকে মানবিক থাকতে হবে, অমানুষিক হলে চলবে না৷
নাৎসি লুটের সেই সংগ্রহ
মিউনিখের এক ফ্ল্যাটে ইউরোপীয় শিল্পীদের আঁকা ১,৪০০ অমূল্য ছবির সন্ধান পাওয়ার পর গত বছর আলোচনায় আসেন কর্নেলিয়াস গুরলিট, যাঁর বাবা হিল্ডেব্রান্ড গুরলিট ছিলেন নাৎসি আমলের আর্ট ডিলার৷ গত মঙ্গলবার ৮১ বছর বয়সে মারা গেছেন তিনি৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa
জানালার নর-নারী
ড্রেসডেনের শিল্পী উইলহেল্ম লাখনিট (১৮৯৯-১৯৬২) জলরংয়ে ‘ম্যান অ্যান্ড উইমেন ইন দ্য উইনডো’ আঁকেন ১৯২৩ সালে৷ নাৎসি প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী ইওসেফ গ্যোবেল্সের নির্দেশে অন্য অনেক ছবির সঙ্গে এ ছবিটিও ‘অধঃপতিত’ ঘোষণা করে সংগ্রহশালা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa
যুগল
‘যুগল’ শিরোনামে জলরংয়ের এই ছবিটি হান্স ক্রিস্টফ (১৯০১-১৯৯২) এঁকেছিলেন ১৯২৪ সালে৷ সে সময় তিনি খুব বেশি পরিচিতি না পেলেও এখন উইলহেল্ম লাখনিট, ওটো গ্রিবেল, ওটো ডিক্সের মতো শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa
সন্ত
ক্রিস্টফ ফল (১৮৯৭-১৯৩৯) সেই বিংশ শতকের গোড়ার দিকেই ভাস্কর্য আর ছবির জন্য খ্যাতি পান৷ কিন্তু নাৎসি সরকারের কোপে পড়ে তাঁর ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে, কারণ তাঁদের বিচারে এসব শিল্পকর্ম ছিল অ-জার্মান৷ ‘মংক’ ছবিটি তিনি আঁকেন ১৯২১ সালে৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa (Ausschnitt)
ড্রেসডেন জ্বলছে
ব্যার্নহার্ড ক্রেচমারও (১৮৮৯-১৯৭২) ছিলেন ড্রেসডেনের শিল্পী৷ জলরংয়ে ‘ট্রাম’ ছবিটি তিনি কবে এঁকেছিলেন, তার সঠিক তারিখ জানা যায় না৷ তাঁর আঁকা বহু ছবি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘অধঃপতিত’ আখ্যা দিয়ে গ্যালারি থেকে সরিয়ে নেয়া হয়৷ ১৯৪৫ সালে ড্রেসডেনে ‘মিত্রবাহিনীর’ বোমা হামলায় তাঁর বহু শিল্পকর্ম ধ্বংস হয়ে যায়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa
ভিন্নমত
ওটো গ্রিবেল (১৮৯৫-১৯৭২) জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির জন্য লিফলেট ও পোস্টার তৈরি করতেন৷ সামরিক বাহনীর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন ছবি এঁকেও৷ স্বাভাবিকভাবেই এসব কাজ নাৎসি নেতাদের পছন্দ হয়নি৷ সে সময় ওটো গ্রিবেলের আঁকা বহু ছবি ধ্বংস করে ফেলা হয়৷ তবে ‘চৌপায়ায় শিশু’ শিরোনামের এই ছবিটি কোনোভাবে রক্ষা পেয়ে যায় এবং বহু বছর পর এর সন্ধান মেলে কর্নেলিয়াস গুরলিটের গোপন সংগ্রহশালায়৷
ছবি: picture-alliance/AP(Ausschnitt)
সমালোচকের কণ্ঠরোধ
বাঁয়ের ছবিতে দেখা যাচ্ছে অগাস্ট রঁদার (১৮৪০-১৯১৭) একটি ড্রয়িং৷ ডানে ওটো ডিক্সের (১৮৯১-১৯৬৯) আঁকা ‘দ্য ফিমেল লায়ন ট্যামার’৷ ওটো ডিক্স ছিলেন নাৎসি আমলের একজন প্রতিবাদী কণ্ঠ, যিনি সেই সময়ের বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন তুলির রূঢ় আঁচড়ে৷ ১৯৩৪ সালে ওটো ডিক্সের ছবি প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়৷ বিভিন্ন জাদুঘর থেকে তুলে নেয়া হয় তাঁর আঁকা শতাধিক ছবি৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa (Ausschnitt)
ড্রেসডেনের প্রতিবাদ
ওটো গ্রিবেল ও ওটো ডিক্সের মতো ড্রেসডেনের শিল্পী কনরাড ফেলিক্সম্যুলারও ছিলেন নাৎসি কর্মকাণ্ডের একজন কড়া সমালোচক৷ এ কারণে তাঁকেও রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে হয়৷ ‘রিয়েলিস্ট’ ধারার এই শিল্পী ‘কাপল ইন দ্য ল্যান্ডস্কেপ’ ছবিটি আঁকেন ১৯২৪ সালে৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa (Ausschnitt)
‘ক্যামেরা অবসকিউরা’
ইটালির শিল্পী আন্তোনিও কানালেত্তো (১৬৯৭-১৭৬৮) চিত্রকলার ইতিহাসে বিখ্যাত তাঁর আঁকা ল্যান্ডস্কেপের জন্য৷ এ সব ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তিনি ‘ক্যামেরা অবসকিউরা’ নামের একটি যন্ত্র ব্যবহার করতেন, যা আধুনিক ক্যামেরার পূর্বসূরি৷ তাঁর করা এই ছাঁপচিত্রটি পাওয়া গেছে কর্নেলিয়াস গুরলিটের সংগ্রহশালায়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa
দেলাক্রোয়ার স্কেচ
ফ্রান্সে রোমান্টিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী শিল্পী ইউজিন দেলাক্রোয়ার (১৭৯৮-১৮৬৩) ছাঁপচিত্রগুলো তাঁর জিবদ্দশাতেই দারুণভাবে আলোচিত হয়৷ ইতিহাস বা পুরাননির্ভর ছবি, স্টিল লাইফ ও পোর্ট্রেট – সবই তিনি করেছেন৷ কর্নেলিয়াস গুরলিটের ফ্ল্যাটে পাওয়া শিল্পকর্মের মধ্যে দেলাক্রোয়ার এই পেনসিল স্কেচটিও ছিল৷