আর্থিক সঙ্গতি থাক বা না থাক, স্ট্যাটাসের দিকে মধ্যবিত্তের নজর সবচেয়ে বেশি৷ ‘পাছে লোকে কিছু বলে' চিন্তাটা নিম্ন ও উচ্চবিত্তের মধ্য যতটা না দেখা যায়, মধ্যবিত্ত এ মানসিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ভোগে।
বিজ্ঞাপন
ফলে অন্যান্য ধর্মীয় বা জাতীয় উৎসবের মতো কোরবানিতেও দেখা যায় মধ্যবিত্তকে ‘স্ট্যাটাস' সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগতে৷ ধর্মমতে যদিও কোরবানি শো অফ নয়, বরং আত্মত্যাগের জন্য হওয়ার কথা, কিন্তু অনেককেই এখন রীতিমত সবচেয়ে ভালো ও বেশি দাম দিয়ে গরু কেনার প্রতিযোগিতায় মত্ত হতে দেখা যায়।
কিন্তু শ্রেণি হিসেবে মধ্যবিত্তের আরেকটি চরিত্রের উল্লেখ করে থাকেন বিশ্লেষকেরা৷ নিম্ন ও উচ্চবিত্ত যেমন নিজের আর্থিক অবস্থানকে ও সুবিধাকে বেশি প্রাধান্য দেয়, মধ্যবিত্ত এর পাশাপাশি মান-সম্মানকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন৷ ফলে আমরা করোনার সময়েওদেখে থাকি, নিম্নবিত্ত গার্মেন্টস শ্রমিকেরা বেতন-বোনাসের দাবিতে রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছেন, উচ্চবিত্ত গার্মেন্টস মালিকেরা টিভি-পত্রিকায় বাণী দিয়ে বেড়াচ্ছেন, সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা নিচ্ছেন৷ কিন্তু মধ্যবিত্তের মতামত ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷
মধ্যবিত্ত আর্থিক অসঙ্গতি থাকলেও মানসম্মানের ভয়ে কারো কাছে সাহায্য চাইতেও যাবে না৷ আবার আর্থিক অসঙ্গতি যাতে অন্য কেউ বুঝতে না পারে, সেজন্য নিজের খরচ না কমিয়ে ঠাটবাটটাও ঠিকই বজায় রাখতে চাইবে৷ এমন ঘটনা আমাদের আশেপাশে বা খুব খেয়াল করলে নিজের মধ্যেও টের পাওয়া যাবে।
ফলে কোরবানি যখন কেউধর্মীয় দৃষ্টি থেকে না ‘নিজেকে জাহির করার মাধ্যম' হিসেবে নিবেন, এবার তাদের ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি হবে৷ সেটা কেমন? হাতে কলমে জানতে মধ্যবিত্তদের সবচেয়ে বড় বিচরণের স্থান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলাম মতামত৷ আশঙ্কা ছিল কেউ আসলেই নিজের অবস্থান জানাতে চাইবেন কিনা।
তবে বেশ কয়েকজন নিজের মত জানিয়েছেন৷ সামর্থ্য না থাকলে কোরবানি বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু তারপরও অনেকে লোকলজ্জা বা সামাজিক চাপে কোরবানি দিতে বাধ্য হতে পারে বলে মনে করেন অনেকেই।
আরশাদ জামিন লাবিব মনে করেন, বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কাটা যাওয়া বা অনেকের চাকরি চলে যাওয়ার ফলে অনেকে এবার কোরবানিই দিতে পারবেন না৷
তালুকদার তুহিন মনে করেন, যারা আগে একাই কোরবানি দিতেন তারা অনেকে এবার শরিকের সঙ্গে মিলে কোরবানি দিতে বাধ্য হবেন৷ তিনি অবশ্য সামাজিক চাপের কোনো ব্যাপার রয়েছে বলে মনে করেন না৷ কিন্তু অনেকের মধ্যে হতাশা তৈরি হতে পারে বলে মত তার।
মোহাম্মদ জোনায়েদ আহমেদ এবং আলিন তারেক মনে করেন এ ব্যাপারে ইসলামে সুস্পষ্ট বলা রয়েছে, সামর্থ্য না থাকলে কোরবানি বাধ্যতামূলক নয়৷ ফলে এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই।
তবে অনেকে আবার বলছেন, সামর্থ্য না থাকলে বাধ্যতামূলক না হলেও অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে বাধ্য হবেন৷ তানজিম আহমেদ খান এবং আনোয়ার হোসেন ধার করে বা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কোরবানি দেয়ার উদাহরণ তুলে ধরেছেন।
তবে কোরবানিকে কেন্দ্র করে যে মধ্যবিত্তের আর্থিক সমস্যা দেখা দেবে, এ বিষয়ে একমত সবাই৷
যেমন ইফতেখার আলম বলছেন, এবার তিনি কোরবানি নিয়ে কিছু ভাবছেনই না৷
এবার হাটে বেচাকেনা কম হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এর প্রভাব যে অন্যদিকেও পড়তে পারে, সে ইঙ্গিতও দিয়েছেন অনেকে৷ কোরবানি কমে যাওয়ায় চামড়ার দাম বাড়ার আশঙ্কা তালুকদার তুহিনের৷ অন্যদিকে আয়াজ রহমান অনলাইনে কেনাবেচার ফলে অন্য এক অংশের লাভবান হওয়ার কথাও তুলে ধরেছেন মন্তব্যে।
মাহফুজুল ইসলাম তারেক আহ্বান জানিয়েছেন, অন্তত এবার যাতে, ‘কী কোরবানি দিয়েছেন' জাতীয় প্রশ্ন করে কেউ কাউকে বিব্রত না করেন৷
করোনা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চলে যাচ্ছে না, এমনটা প্রায় নিশ্চিত হয়েই বলা যায়৷ ফলে আরো একটি ঈদের আনন্দ অনেকটাই ঘরে বসেই উপভোগ করতে হবে৷
তবে এ অবস্থা একদিন কেটে যাবে, ভাইরাস মানুষের কাছে পরাজিত হবেই৷ তখন নিশ্চয়ই আমরা সব উৎসব আগের চেয়েও বেশি আনন্দে পালন করব। ফলে এবার অন্তত মধ্যবিত্তের ওপর সেই বাড়তি চাপটা তৈরি না হোক৷
কাল্পনিক সাহেবের কোরবানি ভাবনা
কাল্পনিক সাহেব ঢাকায় থাকেন৷ মধ্যবিত্ত মানুষটি ইতিমধ্যে করোনায় কাহিল হয়ে পড়েছেন৷ এই অবস্থায় সামনে আসছে কোরবানির ঈদ৷ তবে কষ্টের মধ্যেও সুখ খোঁজার চেষ্টা করছেন তিনি৷ কারণ, এটাই তার জীবনদর্শন৷
ছবি: digitalhaat.net
করোনায় কাহিল
অন্য অনেক মধ্যবিত্তের মতোই কাল্পনিক সাহেবের অবস্থাও করোনায় সঙ্গিন হয়ে উঠেছে৷ পরিবার নিয়ে কষ্টে থাকলেও সবাইকে তা বুঝতে দিতে চান না৷ তিনি যে বাঙালি মধ্যবিত্তদের একজন! লোকে কী বলবে, সেটাই তার কাছে বড়৷
ছবি: bdnews24
আসছে কোরবানি
গতবছর অংশীদারদের সঙ্গে গরু কিনতে হাটে গিয়েছিলেন৷ লোকজনকে যেন বলতে পারেন সেজন্য গরুর ভাগা কিনতে সাধ্যের একটু বেশিই খরচ করেছিলেন৷ তাই গরু কিনে ফেরার পথে বুক ফুলিয়ে পথচারীদের গরুর দাম জানাতে জানাতে বাসায় ফিরেছিলেন৷ কিন্তু এবার কী হবে? ছবিটি প্রতীকী৷
ছবি: bdnews24.com
কোরবানি দেবো, নাকি দেবো না
কাল্পনিক সাহেবের আর্থিক অবস্থা এখন এমন যে, কোরবানি না দিতে হলেই ভালো হতো৷ কিন্তু ঐ যে মধ্যবিত্ত মন! লোকজন কী বলবে, সেটা ভেবেই ঠিক করেছেন যে, যেমন করেই হোক কোরবানি দেবেন৷ তবে এবার বেশি টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই৷
ছবি: bdnews24.com
আরেক চিন্তা
করোনার কারণে এবার ঢাকায় গাবতলী ও সারুলিয়ার দুটি স্থায়ী হাটসহ মাত্র ১২টি স্থানে হাট বসতে দেয়া হবে৷ তাই হাটে গিয়ে গরু-ছাগল কেনার চিন্তা বোধ হয় বাদ দিতে হবে৷ সেক্ষেত্রে অনলাইনে পশু কিনতে হবে৷ কিন্তু এর আগে কখনো অনলাইনে গরু কেনেননি কাল্পনিক সাহেব৷ তাই তিনি চিন্তিত৷ কারণ, তার মনে প্রশ্ন: অনলাইনে কেনা একটি পণ্য পছন্দ না হলে ফেরত দেয়া সম্ভব হলেও গরুর ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন হবে?
ছবি: AP
সরকারি, বেসরকারি ওয়েবসাইট
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে পশু কেনাবেচার জন্য ডিজিটাল হাট (https://foodfornation.gov.bd/qurbani2020/) চালু হয়েছে৷ এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনও একটি ডিজিটাল হাট (www.digitalhaat.net) চালু করেছে৷ বেসরকারি অনেক অনলাইন পোর্টালেও পশু কেনাবেচা হচ্ছে৷
ছবি: foodfornation.gov.bd/qurbani2020
দাম কি বেশি?
অনলাইনে গরু-ছাগল কেনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা কী বলছেন, সেদিকে খেয়াল রাখছেন কাল্পনিক সাহেব৷ এখন পর্যন্ত গরু-ছাগলের দাম একটু বেশি রাখা হচ্ছে বলে মনে করছেন ক্রেতারা৷ তবে করোনার সময়ে হাটে যেতে হবে না ভেবে স্বস্তিও পাচ্ছেন অনেকে৷ তাই একটু বেশি টাকা খরচ করতেও সমস্যা নেই তাদের৷ কিন্তু কাল্পনিক সাহেবের তো আর বেশি খরচ করার সামর্থ্য নেই৷ তার কী হবে?
ছবি: digitalhaat.net
মন্ত্রীদের খবর পড়ে স্বস্তি!
একদিন তিন মন্ত্রীর অনলাইনে গরু কেনার খবর পড়ে মনে যেন কিছুটা স্বস্তি (!) পেয়েছিলেন কাল্পনিক সাহেব৷ কারণ, মন্ত্রী হয়েও একজন মাত্র এক লাখ ২৮ হাজার টাকা, বাকি দুজন মাত্র এক লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনেছেন৷ এর মধ্যে একজন নিজের জন্য মাত্র ২০ শতাংশ মাংস রাখতে চেয়েছেন, আর আরেকজন পুরোটাই দান করতে চেয়েছেন৷ করোনার সময়ে নিজ দেশের মন্ত্রীদের এমন বদান্যতার খবরে স্বস্তি না পেয়ে উপায় আছে! আরও জানতে ‘+’-এ ক্লিক করুন৷
ছবি: www.digitalhaat.net/faq
কেনার সময় সতর্কতা
কাল্পনিক সাহেব যেহেতু অনলাইনে গরু কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাই এক্ষেত্রে কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, তা জানতে চান তিনি৷ ঢাকা উত্তর সিটির ‘ডিজিটাল হাট’-এর সঙ্গে সহযোগিতায় আছে ‘ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’৷ এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলছেন, এই হাটের মাধ্যমে পশু কিনলে তার দায়িত্ব ই-ক্যাব নেবে৷ এছাড়া বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইট থেকে গরু-ছাগল কেনার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: www.deshigorubd.com
ভিন্ন অভিজ্ঞতা
করোনা সবার জন্য এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে৷ কাল্পনিক সাহেবও এবার প্রথমবারের মতো অনলাইনে গরু কিনতে চলেছেন৷ অভিজ্ঞতাটা যদি সুখের হয় তাহলে কে জানে ভবিষ্যতে হয়ত এটাই তার জন্য ‘নিউ নরমাল’ হয়ে উঠবে৷ সেক্ষেত্রে দাম বলে বুক ফোলানোর বিষয়টি রাস্তা থেকে ফেসবুকে চলে আসবে, এই আর কী৷ অবশ্য সেটা ভালোই হবে৷ কারণ রাস্তায় আর কয়জনকে দাম বলা যেত, ফেসবুকেতো তার চেয়ে বেশি মানুষকে জানানো যাবে!