করোনায় এই অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়েছে৷ ক্ষতির মুখে এর সঙ্গে জড়িত খামারি, গৃহস্থ, চামড়া ব্যবসায়ী এবং গরিব মানুষ৷ চামড়ার দাম কম থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এতিম ও অসহায় মানুষেরা৷
বিজ্ঞাপন
এ বছর দেশে গরু ছাগলের উৎপাদন বেড়েছে৷ কিন্তু কোরবানির বাজারে চাহিদা কম থাকায় যারা এই সময়ে গবাদি পশু বিক্রি করেন তারা বেশ অসুবিধায় আছেন৷ রোববার থেকে শুরু হয়েছে গরুর হাট৷ ঈদকে সামনে রেখে গবাদি পশু লালন পালনকারী গৃহস্থ থেকে খামারিরা সারা বছর ধরে অপেক্ষা করেন কোরবানির হাটে তাদের পশু বিক্রির জন্য৷
পশু বিক্রেতাদের দুশ্চিন্তা
ঢাকার আফতাব নগর হাটে এখলাস উদ্দিন মাত্র একটি গরু নিয়ে এসেছেন গাজীপুরের কাপাশিয়া থেকে৷ এক বছর আগে ৮০ হাজার টাকায় তিনি সেটি কিনেছিলেন৷ এরপর তার বিনিয়োগ এক লাখ টাকার বেশি৷ গরুটির দাম চাইছেন তিনি চার লাখ টাকা৷ জানালেন এই দামে বিক্রি করতে না পারলে তিনি লোকসানে পড়বেন৷
গাবতলীর হাটে মনিকগঞ্জের সাটুরিয়া এলাকা থেকে ৫০টি গরু নিয়ে আসা খামারি হাজি মো. মাহবুবুর রহমানও শঙ্কায় আছেন৷ তিনি এখনো পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন না৷ গত বছর করোনার মধ্যে প্রথম কোরবানিতে তাকে গরু ফেরত নিয়ে যেতে হয়েছে৷ এবারও সেরকম হলে অনেক ক্ষতি হবে বলে জানান৷
গত বছর করোনায় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে৷ তার মধ্যে ৪০ লাখ গরু৷ তবে তার আগের বছর স্বাভাবিক সময় কোরাবানি হয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ গবাদি পশু৷ তার অর্ধেকই ছিলো গরু৷ করোনার কারণে কোরবানি দেয়া কমেছে৷ তার মধ্যে আবার গরু বাদ দিয়ে ছাগল কোরবানি দেয়ার প্রবণতা বাড়ছে৷ এবার কোরবানি আরো কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ( খামার) জিনাত সুলতানা জানান, ‘‘করোনার কারনে কোরবানির গরু বিক্রি কমে গেছে৷ এই তিন-চারদিনের হাটে সব গরু বিক্রিও হয় না৷ করোনার আগে এই ঢাকা শহরে একেকটি অ্যাপার্টমেন্টের সামনে আমরা ২০-২৫টি গরু দেখতাম৷ এখন সেটা দেখা যায় না৷ ফলে খামারি এবং গৃহস্থ যারা গরু বিক্রি করেন তারা উভয়ই ক্ষতির মুখে পড়ছেন৷ আর মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও কমে গেছে৷”
তিনি জানান, তাদের ধারণা অনুযায়ী এবার পাঁচ থেকে ১০ ভাগ গবাদি পশু বিক্রি কম হবে৷ গরু বিক্রি আরো কম হবে৷
জিনাত সুলতানা বলেন, ‘‘যারা খামারি তাদের কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই৷ আর গৃহস্থও প্রণোদনা পান না৷ তাই করোনায় তাদের ক্ষতি হলে তা কাটানের কোনা উপায় আপতত নেই৷”
গরু লালন পালনের সময় অবশ্য তারা কৃষি ঋণ পান৷ কিন্তু কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই৷
চামড়া নিয়ে শঙ্কা
এদিকে কোরবানি কম হওয়ায় চামড়াও পাাওয়া যায় কম৷ বাংলাদেশে চামড়ার বড় একটি অংশ সংগ্রহ করা হয় এই কোরবানির সময়৷ কিন্তু তারচেয়েও বড় সংকট তৈরি হয়েছে কাঁচা চামড়ার দাম নিয়ে৷ বাংলাদেশে কোরবানির চামড়া প্রধানত দান করা হয়৷ এই চামড়া এতিম খানা ও মসজিদ মাদ্রাসায় দেন মুসলমানরা৷ গরিব মানুষকেও দান করেন৷ চামড়া বিক্রির টাকায় এইসব প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের একটি অংশ নির্বাহ করা হয়৷ বিশেষ করে এতিম ও গরিব মানুষ এখান থেকে কিছু অর্থ পান৷ কিন্তু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে করোনার অজুহাত দেখিয়ে দাম কমিয়ে দেয়ার তারা বঞ্চিত হচ্ছেন৷
বাংলাদেশে করোনায় চামড়া রপ্তানি বাধা কাটিয়ে উঠেছে৷ তারপরও সিন্ডিকেট করে কাঁচা চামড়ার দাম কমানো হচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রকৃত চামড়া ব্যবসায়ীরা এক থাকলে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারত না৷ এবার চামড়া বিক্রি হবে না বলে গুজব ছাড়ানো হয়েছে৷ গত বছর চামড়া জমিয়ে সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে৷''
এবছর অবশ্য সরকার কাঁচা চামড়ার দাম বিছুটা বাড়িয়েছে৷ গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ঢাকায় ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে৷ প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা, বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে৷
প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে মোটামুটি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়৷ তার মধ্যে ৬০ ভাগ চামড়া আসে এই কোরবানির ঈদে৷ বছরে রপ্তানি হয় ৩৩ হাজার কোটি টাকার চামড়া৷এই করোনায় যেহেতু চামড়া সংগ্রহ ১০-১৫ ভাগ কম হবে তাই সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন জিনাত সুলতানা৷
করোনা: সরকারের অঙ্গীকার, বাস্তবতা ও অব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই সরকারের নানা অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে৷ অনেক ক্ষেত্রে কথা ও কাজের মিল থাকেনি, কেন কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে সেটি বোঝাও দুরুহ হয়েছে অনেক সময়৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Harun-Or-Rashi/Zuma/picture alliance
‘প্রস্তুতির ঘাটতি নেই’
গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে৷ তখন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই৷ অথচ সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলে দেশের চিকিৎসা খাতে চরম অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়৷ করোনায় সংক্রমিত ছাড়া অন্য রোগীদেরও চিকিৎসা বঞ্চিত হওয়ার চিত্র উঠে আসে গণমাধ্যমে৷ এমনকি করোনাকালীন চিকিৎসা সরঞ্জামের কেনাকাটা নিয়ে দুর্নীতির খবরও বেরোয়৷
ছবি: bdnews24.com
ছুটি ও লকডাউন বিড়ম্বনা
করোনা সংক্রমণ রোধে বিভিন্ন দেশ যখন লকডাউন আরোপ করে, বাংলাদেশ সেসময় সরকারি ছুটি ঘোষণা করে৷ এতে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা৷ এরপরও কয়েক দফা কখনো বিধিনিষেধ আরোপ, কখনো শিথিলতা চলতে থাকে৷ ‘লকডাউনে’ শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে কিন্তু বন্ধ থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ গণপরিবহন বন্ধ থাকে, চলে ব্যক্তিগত যান৷ ঈদযাত্রায় ফেরিঘাটে পদপৃষ্ঠ হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
‘করোনা দূর হয়ে যাবে’
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে কেনা টিকা দিয়ে সাত ফেব্রুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি চালু করে সরকার৷ সেসময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘‘আমরা আশা করছি করোনা ভাইরাস দূর হয়ে যাবে। ফাইনাল ব্লো-টা আমরা দেবো ভ্যাকসিনের মাধ্যমে৷’’ বাস্তবতা হলো, ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় কয়েক মাসের মধ্যেই টিকা নিয়ে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ৷
ছবি: Rashed Mortuza/DW
দ্বিতীয় ডোজের অনিশ্চয়তা
দুই চালানে ৭০ লাখ ডোজ পাঠানোর পর ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। অন্য কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি না থাকায় ২৫ এপ্রিল দেশে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। যারা কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ নেন তাদের মধ্যে ১৫ লাখ যথাসময়ে দ্বিতীয় ডোজ পাননি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘সব ব্যবস্থা আছে’
করোনা সংক্রমণ বাড়ার প্রেক্ষিতে গত ১১ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কথা হয়েছে, তারা যেন তাদের হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখে। হাসপাতালে যে বেড বরাদ্দ ছিল, সেগুলো আবারও প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে৷ এছাড়া চিকিৎসার জন্য যা লাগে, সব ব্যবস্থা করা আছে৷”
ছবি: bdnews24.com
তবু আইসিইউ সংকট
বাসস্তবতা হলো, করোনা সংক্রমণ শুরুর দেড় বছর পরও দেশের শতকরা ৫২ ভাগ কোভিড হাসপাতালে আইসিইউ নেই৷ আইসিইউ সুবিধা নেই এমন হাসপাতালের ৩৫টিই আবার ঢাকার বাইরের জেলা সদরগুলোতে৷ এরমধ্যে সারাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় ঢাকার বাইরের জেলা ও গ্রামে করোনা চিকিৎসা নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে৷ কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে অক্সিজেন সংকটে রোগীরা মৃত্যুবরণ করছেন৷
ছবি: bdnews24
বাজেট ব্যবহারে অক্ষমতা
৯ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, “বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ কম- এটা বাড়াতে হবে। ...যদি আমরা ব্যয় না বাড়াই, লোকবল, যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা না করি, হাসপাতালের ব্যবস্থা না করি, তাহলে কী যে হবে তা করোনা ভাইরাস শিখিয়ে দিয়ে গেল৷’’ বাস্তবতা হলো গত অর্থবছরের বাজেটে এডিপিতে এই খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তার মাত্র ২৫ ভাগ ব্যয় হয়েছে দশ মাসে৷ গবেষণার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল তা-ও ব্যবহার করা হয়নি৷
ছবি: PID
গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোয় ব্যর্থতা
শুরুতে করোনা সংক্রমণ শহর পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে৷ এর মধ্যে গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা ও সক্ষমতা গড়ে তুলতে দৃশ্যত তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার৷ ১২ জুলাই উল্টো স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘গ্রামের মানুষের ধারণা ছিল, তাদের করোনা হবে না৷ কিন্তু এখন গ্রামের মানুষের করোনা সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/Reuters
মানুষের জীবিকা
করোনা বিধিনিষেধ বা লকডাউনের জেরে বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্র হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জরিপে৷ কিন্তু লকডাউন বা বিধিনিষেধ দেওয়ার আগে নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের কথাও মাথায় রাখা হয় না৷ ১৩ জুলাই নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার পাঁচটি নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও কবে নাগাদ, কিভাবে বিতরণ হবে তা এখনও পরিস্কার নয়৷
ছবি: Mortuza Rashed
কেন কড়াকড়ি, কেন শিথিল
১ জুলাই থেকে বাংলাদেশে কঠোর লকডাউন শুরু হয়৷ সেদিন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল আট হাজারের উপরে, মৃতের সংখ্যা ১৪৩৷ সেটি বেড়ে ১৪ জুলাই আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়েছে, মৃত্যু প্রতিদিন গড়ে ২০০ জনের উপরে৷ অথচ ঈদের কারণে বিধিনিষেধ শিথিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ করোনা ভাইরাসে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার যখন বেড়ে চলেছে, তখন বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ায় বিশেষজ্ঞরাও বিস্মিত, উদ্বিগ্ন৷